গেমের আড়ালে মরনফাঁদ ব্লু হোয়েল
তাওসিফ মুনায়ার-
প্রযুক্তি যখন আজকের মতো এত সহজলভ্য ছিল না, তখন তরুণদের একটা সময় বরাদ্দ থাকত মাঠে খেলাধুলা করার জন্য। যুগের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি বদলাল। নগরায়নের কারণে বড় শহরগুলোতে খেলার মাঠ বা খোলা জায়গাগুলো হারিয়ে গেল। ফলে বাধ্য হয়ে ছেলেমেয়েদেরকে বিনোদনের জন্য বেছে নিতে হলো ভার্চুয়াল গেমস। তবে শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, শখ করেও ভার্চুয়াল গেমস খেলেন বিভিন্ন বয়সী মানুষ। কম্পিউটার বা নানাধরনের ডিভাইসের মাধ্যমে ফুটবল, ক্রিকেট, কার রেসিং কিংবা যুদ্ধ ভিত্তিক গেমসের জনপ্রিয়তার কথা সবারই জানা। গেমসে সাধারণত কিছু ধাপ থাকে, যা এক এক করে খেলতে হয়। যেমন ফুটবলের গেম খেলতে খেলতে এক পর্যায়ে জয় করা যায় বিশ্বকাপ। তবে হ্যাঁ, তা বাস্তবে নয়, কম্পিউটারের ভিতরেই। কিন্তু কেউ কি কখনো ভেবেছেন, একটা গেম খেলার চূড়ান্ত ধাপ হবে আত্মহত্যা করা? যা অবিশ্বাস্য এবং ভয়ঙ্কর! অথচ, বাস্তবে ঘটেছে এমন ঘটনাই!
কথা হচ্ছে আলোচিত গেম ‘ব্লু হোয়েল’ নিয়ে। সম্প্রতি ঢাকায় এক স্কুুলপড়ুয়া কিশোরীর আত্মহত্যার ঘটনার মধ্য দিয়ে বিষয়টি সবার নজর কাড়ে। গেমটি আসলে ভয়ঙ্কর মরণফাঁদ! অনলাইনভিত্তিক গেমের আদলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ব্লু হোয়েলের লিঙ্ক। এটির কারণে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের প্রায় ১৩০ জন আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ভারতেও কয়েকজনের আত্মহত্যার খবর শোনা গেলেও বাংলাদেশে এমন ঘটনা এই প্রথম।
প্রচলিত আছে, মৃত্যুর আগে ‘ব্লু হোয়েল’ বা নীল তিমিরা নাকি আত্মহত্যার জন্য ডাঙ্গায় উঠে আসে। এই ধারণা থেকেই কলেজ থেকে বহিষ্কার হওয়া ফিলিপ বুদেকিন নামের এক রাশিয়ান তরুণ এটি তৈরি করেন। মরণ নেশার এ গেম দিয়ে তারাই প্রভাবিত হন; যারা সাধারণত নিজেকে দুর্বল ভাবেন, একাকীত্ব, মানসিক অবসাদ বা হীনম্মন্যতায় ভোগেন। অনেকে কৌতূহল থেকেও জড়িয়ে পড়েন। আবার অল্প বয়স্ক অনেক কিশোর-কিশোরীর মনে ‘অ্যাডভেঞ্চারাস’ হওয়ার বাসনা থাকে।
রাশিয়ায় ১৬ জন কিশোর-কিশোরীর ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের কারণে আত্মহত্যা করার খবর পাওয়ার পর ফিলিপকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানসিক বিকারগ্রস্ত এ তরুণের বক্তব্য ছিল, যারা আত্মহত্যা করতে চায় তাদেরকে সহজে আত্মহত্যার সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার জন্য এটি তৈরি করেছেন তিনি। কিংবা যাদের সমাজে কোনো দাম নেই, তারা যেন ‘সাফ’ হয়ে যায়, সে ব্যবস্থা করেছেন ফিলিপ। কিন্তু ফিলিপ আটক থাকার পরও বন্ধ হয়নি ‘ব্লু হোয়েল’।
জানা যায়, ‘ব্লু হোয়েল’ খেলতে যারা ঢোকে, তাদেরকে বিভিন্ন ‘টাস্ক’ দেয় একজন অ্যাডমিন। প্রতিদিন সেগুলো শেষ করতে হয়। প্রথম পর্যায়ে অ্যাডমিন গেমারের ব্যক্তিগত পরিচিতি ও ছবি সংগ্রহ করে নেয় এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতা করে। জেনে নেয় অনেক ব্যক্তিগত তথ্য। এরপর থেকে অ্যাডমিন বিভিন্ন নির্দেশনা দেয়। যেমন, রাতে কবরস্থানে একা ঘুরে আসা, হরর ছবি দেখা কিংবা গভীর রাতে ছাদে গিয়ে ছাদের কার্নিশের ওপর হাঁটা। এসবের ছবিও তুলে পাঠাতে হয় অ্যাডমিনকে। ধীরে ধীরে এভাবে আসক্তি তৈরি করা হয় এবং পাশাপাশি চলতে থাকে গেমারের নিজের ও তার পরিবারের গোপন কথা জেনে নেওয়া। পরবর্তীতে আরও কঠিন ‘চ্যালেঞ্জ’ দিয়ে বলা হয়, ছুরি ব্যবহার করে নিজেকে রক্তাক্ত করতে হবে বা হাত কেঁটে হাতে তিমি মাছ আঁকতে হবে। এ পর্যায়ে এসে অস্বীকৃতি জানালে গেমারকে হুমকি দিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। বলা হয়, নির্দেশ না মানলে গোপন কথা ফাঁস করা হবে। পরিবারের ক্ষতি করা হবে। এতে গেমার বাধ্য হয়ে মেনে নেয় অ্যাডমিনের নির্দেশ। এভাবে পর্যায়ক্রমে ৫০তম বা শেষ পর্বের নির্দেশনায় বলা হয় আত্মহত্যা করতে। যারা আত্মহত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন তারা বলেছেন, একবার জড়িয়ে পড়লে এই মরণফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা যায় না।
ব্লু হোয়েলের প্রভাবে কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটার কারণে ভারত সরকার কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক থেকে এটির লিঙ্ক মুছে ফেলতে নির্দেশ দিয়েছে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকেও এমন পদক্ষেপ নিতে হবে। এটিকে ইন্টারনেট থেকে মুছে ফেলতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের বাড়তি নজর রাখতে হবে। কিশোর-কিশোরীরা যাতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার না করে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অভিভাবকরা সচেতন হলে সম্ভব এসব মরণফাঁদ ঠেকানো। সুতরাং সাবধান হতে হবে সবাইকেই।