ক্রীড়া প্রতিবেদক : ফুটবলে কী দিনকাল পড়েছে। দেশি ফরোয়ার্ডরা গোলপোস্ট ছেড়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বল তুলে দেন আকাশে। ক্ষয়ে যাওয়া ফুটবল জমানায় তাই খালেকুরজামান সবুজের একটি শট সেদিন সবাইকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ফুটবলের সোনালি অতীতে।

সেখানে আসলামের পায়ে ছিল অমন শট। সালাউদ্দিনের ছিল দুর্দান্ত ফিনিশিং। এর সঙ্গে অবধারিতভাবে চলে আসে এনায়েতের কীর্তি। এসব দিন কবেই ফুরিয়ে গেছে, এখন ফুটবল বেঁচে আছে সেই ‘হারানো দিনের’ গল্পে। কারণ হালের ফুটবল ‘গোল-কানা’, গোলের খেলায় প্রায়ই গোলপোস্ট খুঁজে পায় না দেশি ফরোয়ার্ডরা। চলছে আকাশের ঠিকানায় উড়িয়ে মারার প্রতিযোগিতা। তাই ঠিকানা বদলে শেখ জামালের জালে খালেকের আগুনে গোলার মতো শটটি অভিভূত করেছিল সবাইকে। গোলরক্ষককে হতভম্ব করে বলটি পৌঁছে গিয়েছিল জামালের জালে।

গত মঙ্গলবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বল্পসংখ্যক দর্শক আর সাংবাদিকরা যেন কী এক নতুন জিনিস দেখেছেন প্রিমিয়ার লিগের তৃতীয় রাউন্ডে। এখনো পর্যন্ত লিগের সেরা গোল এটি। সুবাদে রেশও থেকে যাবে অনেক দিন। কিন্তু সদ্য এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবল খেলা শেখ রাসেলের এই উইঙ্গারের কাছে এ যেন সাধারণ ব্যাপার, ‘হঠাৎ গোলে শট করেছি বাঁ পায়ে। এটা আমার অভ্যাস। গত লিগেও দূরপাল্লার শটে দুটি গোল আছে, কিন্তু ছোট দলে ছিলাম বলে সেগুলো কারো চোখে পড়েনি। ’ গতবার তিনি খেলেছেন উত্তর বারিধারায়, লেফট ব্যাক পজিশনে খেলেই করেছেন পাঁচ গোল। এর মধ্যে দুটি দূরপাল্লার শটে চট্টগ্রাম আবাহনী ও রহমতগঞ্জের বিপক্ষে। মানে এটা তালেগোলে হওয়া গোল নয়। ‘প্রিমিয়ার লিগে আসার আগে আমি প্রচুর খেপ খেলতাম। সেখানে এ রকম অসংখ্য গোল করেছি। মাঠে ভালো পজিশনে থাকলে আমি শট করি। আমার ক্ষমতা আমি জানি, দুপায়ে প্রচণ্ড জোরে শট করতে পারি। বারিধারার হয়ে ওই গোল দুটি করেছিলাম ডান পায়ে। আমার কাছে মনে হয়, শটই গোলের বড় অস্ত্র। অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় না’—নিজের দুই পায়ের ওপর কতটা বিশ্বাস থাকলে ২৩ বছর বয়সী এক ফুটবলার এভাবে গোলের সরলীকরণ করতে পারেন!

তাঁর এই গোল দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ সাইফুল বারী টিটু, ‘গোলটা আমি টিভিতে দেখেছি। খুবই বুদ্ধিদীপ্ত এবং সাহসী শট। অত দূর এবং ওই কোণ থেকে গোলরক্ষককে পরাস্ত করা কঠিন কাজ। কিন্তু তার শটে প্রচণ্ড জোর ছিল এবং শেষদিকে বলটা হঠাৎ নিচু হয়ে গেছে, এটার কারণ শটের ফলো থ্রু। আমাদের দেশি ফুটবলারদের পায়ে এ রকম গোল সচরাচর দেখা যায় না। ’ শেখ রাসেল তখন এক গোলে পিছিয়ে। খালেক খেলছেন বাঁ-দিকের উইংয়ে, ৩০ গজ দূর থেকে হঠাৎ শট করে উসকে দিলেন নানমুখী আলোচনা। জাতীয় দলে দীর্ঘদিন কোচিং করানোর সুবাদে টিটু দেখেছেন, ‘দেশি ফুটবলাররা বক্সের ভেতরে গিয়েও শট মারতে চায় না, বাইরে থেকে তো শটের চিন্তাই করা যায় না। আসলে শটে তাদের বিশ্বাস নেই। কারণ শ্যুটিং প্র্যাকটিস করে করে রপ্ত করতে হয়, সেটাই তারা করে না। এমনকি বক্সের ভেতরও ‘অ্যাক্রস দ্য কিপার’ শটও করতে পারে না তারা। অর্থাৎ গোলরক্ষক কাছের পোস্ট কাভার করে ফেললে দূরের পোস্টে শট মারতে জানে না। তখন গোলরক্ষকের গায়ে মেরে সুন্দর সুযোগটা নষ্ট করে। অথচ সালাউদ্দিন ভাই অহরহ এ রকম গোল করতেন। ’ ’৮৫ সালে এই মাঠে ভারতীয় গোলরক্ষক অতনুকে পরাস্ত করা শেখ মোহাম্মদ আসলামের দূরপাল্লার শটের কথা অনেকের মনে আছে। এই শ্যুটিং দক্ষতা এক দিনে হয়নি, ক্লাবের নিয়মিত ট্রেনিং শেষে নিজে শ্যুটিং প্র্যাকটিস করতেন আরো এক ঘণ্টা। এই বাড়তি পরিশ্রমের ঝোঁকটাই নেই হালের ফুটবলারদের মধ্যে।

গোলের বড় একটা অস্ত্র যে শ্যুটিং—এটাই আমাদের ফুটবল পাঠ্য থেকে হারিয়ে গেছে। তাই কুড়িগ্রামের উঠতি ফুটবলারের শটটি এত মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। তাতে বুলেটের গতি আর বারুদের ঝাঁজ দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হয় জাতীয় দলের ফুটবলারদের শটের সামর্থ্য। ১১ বছর জাতীয় দলে খেলা শেখ রাসেলের আতিকুর রহমানের কাছে খালেকের গোলটি ‘বিশ্বমানের’ হলেও জাতীয় দলের বেলায় ভিন্ন উপলব্ধি, ‘শ্যুটিং দিয়ে বিচার করলে আমরা প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে। ভারত-মালদ্বীপের ফুটবলাররা যখন-তখন পোস্টে শট করে। শুধু জাতীয় দল নয়, ক্লাব ফুটবলেও আমাদের শ্যুটিংয়ের অভ্যাস নেই। জাহিদ ভাই খুব ভালো শট করতেন, কিন্তু ইদানীং দেখি না। শ্যুটিং একটা টেকনিক, কৈশোর থেকে প্র্যাকটিস করে করে এটা রপ্ত করতে হয়। তা করি না বলে আমরা ম্যাচে গিয়ে শট করার সাহস পাই না। ’

দুঃসাহসী হয়ে শট করলে উঠে যায় আকাশে। দর্শকরা হাসাহাসি করে। আবার পায়ে শট না থাকলে ফুটবলার হয়েই-বা লাভ কী। এই সংকট থেকে মুক্তির উপায় নিজের ভেতরে শ্যুটিংয়ের নেশা তৈরি করা। খালেক নাকি তা-ই করেছিলেন, ‘ফুটবল খেলা শুরুর পর থেকেই আমার শটের নেশা, শট করে গোল করতে হবে। কেউ আমাকে শেখায়নি, শ্যুটিং প্র্যাকটিস করতে করতে আত্মবিশ্বাস জন্মেছে। রোনালদোর শ্যুটিং আমি ফলো করি। প্রত্যেক শটে তো আর গোল হয় না, প্রচণ্ড গতির সঙ্গে নিশানা ঠিক রাখাটাই চ্যালেঞ্জিং। ’ কিন্তু এই চ্যালেঞ্জে যে উৎসাহী ফুটবলারের সংখ্যা খুব কম। তাহলে ফুটবলের ‘গোল-কানা’ রোগ সারবে কী করে!

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn