চলন্ত গাড়িতে খুন করা হয় কোটিপতি সইবনকে
ওয়েছ খছরু ও মিলাদ জয়নুল-
বিয়ানীবাজারের কোটিপতি ব্যবসায়ী সইবন আহমদকে চলন্ত গাড়িতে গলা কেটে হত্যা করা হয়। সইবনের গলায় ছুরি চালায় গ্রেপ্তার হওয়া জাকির হোসেন। অপর সহযোগীরা তাকে সহযোগিতা করছিল। খুনের ঘটনার সময় ফিনকি দিয়ে রক্ত গোটা গাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। গাড়ির মেঝে রক্তে সয়লাব হয়ে যায়। এরপর তারা সুযোগ বুঝে গাছতলায় লাশ ফেলে দিয়ে আসে। বিয়ানীবাজারের পুলিশের কাছে হত্যার ঘটনায় এমন লোমহর্ষক বর্ণনা ঘাতক জাকির দিলেও সে আদালতে স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হয়নি। বিয়ানীবাজার থানার ওসি শাহজালাল মুন্সি শনিবার রাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ওদিকে গতকাল পুলিশ জাকিরকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডে চেয়ে আদালতে পাঠিয়েছে। তবে গতকাল আদালতে তার রিমান্ড শুনানি হয়নি। জাকিরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে কারাগারে। পুলিশ বলছে, খুনের ঘটনার মূল নায়ক জাকির নিজ মুখে সব ঘটনা স্বীকার করেছে। ঘটনাটি পরিষ্কার। এখন তার সহযোগিদের আটক করাই হচ্ছে মূল কাজ। বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, বড়লেখা, জকিগঞ্জজুড়েই এখন সইবন খুনের ঘটনা নিয়ে সব মাতামাতি। ধনাঢ্য শহর বিয়ানীবাজারের সবার পরিচিত এক ব্যবসায়ী তিনি। কয়েকটি কাপড়ের দোকানের মালিক। সইবন মৃত্যুর পর সিলেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আতঙ্ক নেমেছে। অপরদিকে ঘাতকদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন বিয়ানীবাজারবাসী। জাকির হোসেনের বাড়ি সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকায়। বিয়ানীবাজারে বিয়ে করেছেন। উপজেলার সড়ক ভাঙ্গনী এলাকায় তার শ্বশুরবাড়ি।
জাকির জমি ব্যবসার পাশাপাশি আদম ব্যবসায়ও জড়িত। ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর নামে সে টাকা লুট করেছে। বিয়ানীবাজার যাওয়া আসার সুবাদে চতুর জাকির ব্যবসায়ী সইবনের সঙ্গে সর্ম্পক গড়ে তোলে। ধীরে-ধীরে তাদের সর্ম্পক গভীর হয়। এরপর জাকির ব্যবসায়ী সইবনকে সপরিবারে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব দেন। এতে রাজি হন সইবন। সম্পর্কের ভিত্তিতে তিনি পর্যায়ক্রমে জাকির হোসেনকে প্রায় দেড় কোটি টাকা দেন। এরপরও পরিবারসহ আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছিল না। জাকিরের পক্ষ থেকেও কোনো প্রক্রিয়া চালানো হয়নি। জানুয়ারি মাস থেকে জাকিরের প্রতারণার বিষয়টি সইবনের নজরে আসে। এরপর তিনি জাকিরকে টাকা ফেরত দেয়ার জন্য চাপ দেন। তবে, টাকার জন্য চাপ দিলেও তাদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরেনি। বৃহস্পতিবার টাকা নেয়ার জন্য সইবনকে মোবাইল ফোনে সিলেট শহরে নিয়ে যায় জাকির ও তার সহযোগিরা। ওই দিন সইবন বিকাল ৪টার দিকে একটি প্রাইভেট কারে সিলেট নগরীতে আসেন। রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ওসি শাহজালাল মুন্সি জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা জেনেছেন রাত ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে খুন করা হয়েছে সইবনকে। জাকির প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে খুনের দায় স্বীকার করেছে। এবং সে নিজেই চলন্ত গাড়িতে সইবনের গলা কেটে খুন করে। পরে লাশ গাছতলায় ফেলে দেয়। তিনি বলেন, খুনের ঘটনার পরপরই আমরা প্রযুক্তিগত অনুসন্ধান চালাই। এর মধ্যে দেখি নিহত সইবনের সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ করা হয় জাকিরের সঙ্গে এবং জাকিরের কাছে তিনি প্রায় দেড় কোটি টাকা পাবেন। সপরিবারে আমেরিকা নেয়ার কথা বলে জাকির ওই টাকা লুটে নেয়। এরপর তাদের আমেরিকা পাঠাতে টালবাহানা করেন। টাকা ফেরত না দিতে সইবনকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে জেনেছে বলে জানান তিনি। ওসি বলেন, খুনের ঘটনার সঙ্গে আরো ৪-৫ জনের সম্পৃক্ততা মিলেছে। তাদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এদিকে, পুলিশ রক্তমাখা মাইক্রোবাস উদ্ধার করতে পারলেও খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত ছুরি গতকাল পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি।
বেপরোয়া জাকির: সিলেট নগরীর বাসিন্দা জাকির হোসেন বেপরোয়া ছিল। রাজনৈতিক পরিচয়ে আড়ালে সে নিজেকে পরিণত করেছিল আদম ব্যবসার গডফাদার হিসেবে। তার স্বজনদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। গতকাল জাকির সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এলাকা সূত্রে বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য। এসব তথ্যে জানা গেছে, পৌরশহরের ব্যবসায়ী সইবন আহমদ (৫০) হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন ঘাতক জাকির হোসেন জোরপূর্বক বিয়ে করে তার আপন খালাতো বোনকে। সিলেট নগরীর আখালিয়ায় শ্বশুর আফতাব উদ্দিনের ক্রয় করা ৩০শতক জমিও সে অন্যায়ভাবে দখল করে রেখেছে। ভাগ্নের দখল থেকে জমি পুনঃরুদ্ধারের আশায় নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে অনেকটা বাধ্য হন আমেরিকা প্রবাসী আফতাব উদ্দিন এবং তার স্ত্রী সুল তানা বেগম। এ ছাড়াও যুবলীগ নেতা জাকির হোসেন রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠায় কিশোর বয়স থেকেই বেপরোয়া। সর্বশেষ বিয়ানীবাজার পৌরশহরের ব্যবসায়ী সইবন আহমদ হত্যায় জড়িত হিসেবে তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তাকে গ্রেপ্তারের পরই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ঘাতক জাকিরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। নগরীর মদিনা মার্কেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয় গেট পর্যন্ত সব ছিনতাই ও অপরাধ রাজ্যের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক সে। এ ছাড়াও জাকির চোরাই গাড়ি কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত।তার হেফাজত থেকে রক্তমাখা যে মাইক্রো বাসটি পুলিশ উদ্ধার করে সেটিও একটি চোরাই গাড়ি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জাকির তার শ্বশুরবাড়ির এলাকা থেকে সালেহ আহমদ নামের এক আদম ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে নিয়ে যেতে চায়। পরে সামাজিক শালিসে বিষয়টি আর বেশিদূর গড়ায়নি। জাকিরের স্ত্রীর বড় বোন সিপা বেগম জানান, সে আমাদের বাড়িতে আসলে দিনরাত শুধু ঘুমিয়ে কাটাত। বাড়ির বাইরে বেশি বের হতো না। সিপার কথার সূত্র ধরে সিলেটের বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানা যায়, নগরীতে অপরাধ কর্মকাণ্ড শেষে সে আত্মগোপনে থাকতে শ্বশুর বাড়ি চলে আসে। তার স্ত্রী রিপা বেগমও বেশিরভাগ সময় বাপের বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার খশির সড়কভাংনী এলাকায় থাকেন। স্বামীর সব অপরাধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তিনি অবগত।