ছরওয়ার হোসেন, নিউ ইয়র্ক-

এক.
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৭০বছর পূর্তি বিশ্বের প্রগতিশীল ছাত্রআন্দোলনের ইতিহাসে অনন্যসাধারণ ঘটনা।  পাকিস্থানী শাসকগোষ্টির শোষনের নাঁগপাশ ছিন্ন করে বাঙালীর মুক্তি ও স্বাধীনতার লক্ষে দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপিড়িত মানুষের মহান নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালী, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮সালের ৪ঠা জানুয়ারী প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্টালাভ করে পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ; যা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় ১৯৫৩সালেই নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগ’ নামে বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশালতা অর্জন করে।  বঙ্গবন্ধুর বিপ্লবী আদর্শে দীক্ষিত ও বাংলার স্বাধীনতার লক্ষে নিবেদিত পূর্বপাকিস্থান ছাত্রলীগ জাতিকে স্বাধীনতার তরে চুড়ান্ত উজ্জীবিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে ১৯৭১সালের ৮ই মার্চ থেকে সংগঠনের নামের পেছনের ‘পূর্ব পাকিস্থান’ শব্দ ঝেড়ে ফেলে শুধুমাত্র ‘ছাত্রলীগ’ নাম ধারণ করে এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্নত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামে সংগঠনের গৌরবময় আত্নপ্রকাশ ঘটে।

বাংলা ও বাঙালির সোনালী অর্জন, বাংলার প্রগতিশীল ছাত্রআন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিঁকাগার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জন্ম থেকে অদ্যাবধি দেশ ও জাতিকে প্রতিটি অমানিশার অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘোর সংকটে  প্রগতিশীলতার দিকে উত্তরণে নেতৃত্বদান করেছে।  ছাত্রলীগ কোন গতানুগতিক ছাত্র সংগঠন নয়; বিশ্বের শোষিত মানুষের মহান নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিপ্লবী চিন্তা-চেতনার আলোয় আদর্শিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ পৃথিবীতে একমাত্র ছাত্রসংগঠন হিসেবে একটি জাতির জাতীয়তাবোধের জাগরণ ও সুদীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দেওয়ার অনন্য গৌরবে মহীয়ান।  রক্তপিচ্ছিল সংগ্রামী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছাত্রলীগের অসংখ্য যুগান্তকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কখনো দিশেহারা জাতিকে দিয়েছে ঘুরে দাড়ানোর সাহস আবার কখনো দিয়েছে শোষকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি প্রদর্শন করে সংগ্রামের শক্তি ও প্রত্যয়।  কন্ঠকাকীর্ণ পথে লড়াইয়ে-সংগ্রামে নানান চড়াই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে শিক্ষা শান্তি প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আজও ধর্মান্ধতা, কুপমন্ডুকতা, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অশুভ রাজনৈতিক তৎপরতার বিপরিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় প্রদীপ্ত অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল সুখি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার চেতনায় অগ্রণ্মূখ বাঙালির শেষ ভরসাস্থল।  কিন্তু, মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রলীগের প্রাতিষ্টানিক কর্মসূচি সম্প্রসারণের অতি সাম্প্রতিক রাজনীতিচিন্তা (নিকট ভবিষ্যতে যা অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের বেলায়ও উন্মুক্ত হতে পারে) দেশের ছাত্র, শিক্ষক অভিভাবকমন্ডলী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ ও সাধারণ মানুষকে চিন্তামগ্ন করেছে, যার ঢেউ দেশের গন্ডি পেরিয়ে প্রবাসেও আছড়ে পড়েছে।  বাংলাদেশ সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে বসবাসরত প্রবাসীদেরও জন্মভূমি।  সুখে-দূঃখে নিখাঁদ ভালোবাসায় দেশের প্রতিটি সংকট উত্তরণে তারা সর্বদা দেশের পাশে থাকেন।  দেশে থাকা পরিবার-পরিজন, প্রজন্মদের বেড়ে ওঠায়, শিক্ষা-দীক্ষায় অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার জন্য প্রবাসীরা উপার্জিত অর্থের বড় একটি অংশ প্রদান করেন।  প্রাসঙ্গিকভাবেই তাদের ভাবনাটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বটে।  ইতোমধ্যে যদিও ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল কাদের এম পি, ছাত্রলীগকে এ কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন এবং তদানুসারে ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষনাও দিয়েছেন কিন্তু, যেসব স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি ইতোমধ্যে ঘোষিত হয়েছে সেসব বলবৎ রাখারও ইঙ্গিত প্রদান করেছেন; যাতে অনেক প্রশ্ন থেকে গেলো। এর প্রয়োজনীয়তা কি সত্যিই অপরিহার্য্য? এছাড়া অন্য কোনভাবে কি উদ্দেশ্যসিদ্ধি সম্ভব নয়? মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্ররাজনীতি চর্চার পক্ষে বা বিপক্ষে রাষ্ট্রের অবস্থান কি হওয়া উচিত? এসব নানা প্রশ্ন আজ দেশে-বিদেশে মানুষের মধ্যে বিরাজমান।  এমনকি ছাত্রলীগেরও প্রাক্তন-বর্তমান ব্যাপকসংখ্যক নেতাকর্মীরা এ বিষয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

মুল আলোচনার পূর্বে একটি ছোট বিষয় উল্লেখ করতে চাই।  নিউ ইয়র্কে আমার কর্মস্থলে নিয়োগপ্রাপ্ত নতুন ম্যানেজার তাঁর কর্মদক্ষতার গুনে গত তিন মাসে প্রতিষ্টানের আমূল পরিবর্তন করেছেন।  তিনি তার নতুন পরিকল্পনার নাম দিয়েছেন ‘মিশন প্লাস’।  এর মাধ্যমে তিনি প্রাচিন অথচ নুঁয়ে পড়া এ প্রতিষ্টানকে নিউ ইয়র্কের সেরা সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চান।  মূলতঃ প্রতিষ্টানের অন্যান্য বিষয়ের সাথে কর্মীদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনয়নই তাঁর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।  তাঁর চিন্তা ও দর্শন হচ্ছে, প্রতিষ্টানের সর্বোচ্চ মানসম্মত সার্ভিস উপযোগী দক্ষ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা এবং এটা সম্ভব হলে বর্তমানের চেয়ে অর্ধেক বিনিয়োগ ও পরিশ্রমে প্রতিষ্টানের মুনাফা এবং কর্মীদের আয়-রোজগার কয়েকগুন বৃদ্ধি পাবে।  সত্যিই এ ক্ষেত্রে তিনি রাতারাতি সফল হচ্ছেন।  আমরা (ষ্টাফরা) এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত ও আমাদের কাজের গুণগত মান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু পরিশ্রমের পরিমান কমেছে।  কয়েকদিন পূর্বে প্রি শিফট মিটিংয়ে কর্মীদের দেওয়া নোটে লেখা ছিলো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইনের কালজয়ী বানী “The world as we have created it is a process of our thinking. It cannot be changed without changing our thinking.” যার উপর তিনি আমাদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য গ্রহন করেন।  মূলতঃ এরকম চিন্তাশক্তিই আমাদের ম্যানেজার হেনরি ভাল্ডারেজের কর্ম ও দর্শনের মূল ভিত্তি।  আমার সাথে কাজ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক তুখোড় নেতা আব্দুর রহমান। কেমিষ্ট্রিতে মাষ্টার্স করে এদেশে এসেছেন।  বয়সে তিনি আমার খুব বেশী বড় না হলেও আমি তাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি।  প্রবাসের নানা বিষয়ের পাশাপাশি প্রায়ই তিনি আমার সঙ্গে দেশের নানা সমস্যা, সম্ভাবনা ও রাজনৈতিক আলাপ করেন।  সেদিন প্রি শিফট মিটিংয়ের পর তিনি আমাকে বললেন “ আজ আমি হেনরির উপর খুব খুশি, কারন সে আইনষ্টাইনের একটি অমর বাণী আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।  আমার মন বলছে, আমি এই নোটের কয়েকটি কপি বাংলাদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোকে পাঠিয়ে দিই, আর তারা দেশজুড়ে একটি পরিবর্তনের ডাক দিক”।  আমি বললাম, “তারাতো রাতারাতি পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।  আগে ছিলো কলেজ-ভার্সিটি পর্যায়ে আর এখন যাচ্ছে স্কুল পর্যায়ে”।  তিনি বললেন, “আমিতো এজন্যই বলছি, তারা যেন নিম্নদিকে অবরোহনের মানসিকতায়ই পরিবর্তন এনে উপরের দিকে আরোহন করতে পারে”।   তিনি বললেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে গত কয়েকদিনে দেশে-বিদেশে অনেকের সাথে তার আলাপ হয়েছে কিন্তু একজনও পাননি যিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির চর্চাকে সমর্থন করেন।  ।

গত ২১শে নভেম্বর, মঙ্গলবার ২০১৭ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্টিত সভায় গৃহিত সিদ্ধান্তের আলোকে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে সংগঠনের প্রাতিষ্টানিক কার্যক্রম পরিচালনার  উদ্যোগ গ্রহন করে।  ২২শে নভেম্বর অনলাইনে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত দৈনিক মানবজমিন, ঢাকা ট্রিভিউন এবং ডেইলি ষ্টার’এ এ সংক্রান্ত নিউজ পাঠে বিশ্বাসযোগ্য না হওয়াতে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের ফেইসবুক প্রোফাইলে এক চিলতে ঢু’মারি।  সেখানে শিক্ষা শান্তি প্রগতির পতাকাবাহী পেডে এ সংক্রান্ত সাংগঠনিক নির্দেশনায় তাদের সীলচাপ্পড় দেখে তরুণসমাজের ভবিষ্যত চিন্তায় ভারাক্রান্ত হলাম।  নিজেকে সান্তনা দিতে মনে মনে বললাম, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দেশের তরুণসমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিতে এর চেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ বাংলার জমিনে আর নাই”! মনে পড়ে গেলো ইউক্রেনীয়ান ধনকুবের ও মানবতাবাদী জনসেবক Pinchuk (Victor Mikhailovich Pinchuk)এর বাণী “Art, freedom and creativity will change society faster than politics”. কল্পনায় মিষ্টার পিন্চুককে ডেকে বললাম, “ওহে মিষ্টার, দুঃখিত চিত্তে আপনাকে বলতে চাই, আপনার কথা ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশের বেলায় নয়।  এখানে রাজনীতিই যেন সকল শক্তি ও পরিবর্তনের উৎস, আর আমরা অন্ধভাবে তাই মনে করি।” পরে ঠান্ডা মাথায় অনুসন্ধিৎসুচিত্তে অনেক অনুসন্ধানের পরও একমাত্র ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’কে তরুনসমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য ব্যতিত এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু কোথাও পাইনি।  হ্যাঁ, এ উদ্যোগের লক্ষ্য যাই হোক না কেন ভবিষ্যতে দেশব্যাপী এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে সমাজের উপর এর সুফল-কুফলের প্রভাব কল্পনায় বিন্দু পরিমান সামাজিক জ্ঞান এবং ছাত্রলীগের  একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে কিঞ্চিৎ পরিমান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে ছাত্রলীগের এ সিদ্ধান্তে অন্যদের মতো আমিও মর্মাহত হয়েছি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চর্চার বিরুদ্ধাচারণ পূর্বক তা যে বর্তমান যুগে মানুষের প্রগতিশীল চাহিদার সঙ্গে বেমানান ও অপরাজনীতি চর্চার শামিল সে অভিমত ব্যক্ত করে গত ২২শে নভেম্বর ২০১৭ নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে একটি ষ্ট্যাটাস পোষ্টের পর দেশ ও বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে অনেকে ইনবক্স ম্যাসেজে এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করে তাদের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন এবং এ ধরণের কর্মসূচির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দেশের সামাজিক অবক্ষয় ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের ব্যাপক ক্ষতির বিষয়ে তাদের আশংকা ব্যক্ত করেছেন।  উক্ত শঙ্কিতদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী বা সমর্থক যারা অতীতে ছাত্রলীগেরও নেতাকর্মী ছিলেন।  ফেসবুকে দেশের নানা প্রান্তের অনেক ত্যাগী আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দকেও এ সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করতে দেখছি।  বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার প্রথিতযষা ব্যক্তিবর্গ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাত্রলীগের এ সিদ্ধান্তে হতাশাগ্রস্থ।  মূলতঃ সকলেই কলেজ-ইউনিভার্সিটির মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ছাত্রসংগঠনসমূহের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, হানাহানী ও অস্থির রাজনীতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি হলে ফলশ্রুতিতে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও তরুনসমাজের চারিত্রিক ধ্বস নামার আশংকা ব্যক্ত করেছেন।

এবার দেখা যাক, ছাত্রলীগের এ উদ্যোগের ভিত্তি কি।  ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের বক্তব্য অনুসারে, দেশব্যাপী ধর্মান্ধ মৌলবাদী জামাত- শিবির ও অন্যান্য সংগঠন সমূহের সুশৃংখল মৌলবাদী রাজনৈতিক প্রচারণা দেশের  তরুণসমাজকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গীবাদের দিকে যেভাবে প্রভাবিত করছে, সেখানে অবলীলায় দেশের কিশোর তরুনদের বিরাট অংশের নিকট মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনার পক্ষের শক্তির রাজনৈতিক দর্শনের শিক্ষা ও প্রচারণা অনুপস্থিত।  এটা দিবালোকের মতো সত্য যে, দেশে চলমান নানা ধরনের অধিকাংশ ধর্মীয় মাদ্রাসায় শিশু-কিশোরদের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া হয়ে থাকে। শিক্ষার্থীদের নিকট বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসকে অনেকাংশে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়।  এমনকি অনেক মাদ্রাসায় কোনদিন লাখো শহীদের আত্নত্যাগে অর্জিত স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা পর্যন্ত উত্তোলন করা হয়নি কিংবা বেশির ভাগ মাদ্রাসায়ই জাতীয় পতাকাকে যথাযত সম্মান প্রদর্শন করা হয়না, বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড শতভাগ ধারণকৃত আমাদের  জাতীয় সঙ্গিতটুকুও বাজানো হয়না, এমনকি বাঙালি জাতিসত্বা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে মাদ্রাসাসমূহে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়।  যার মধ্যদিয়ে দেশের তরুনসমাজের একটি বড় অংশ মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনাবিরোধী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক চিন্তায় আবিষ্ট হচ্ছে যা একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জন্য মারাত্নক হুমকী স্বরুপ।  এছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী, ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ক্রিড়নক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির তাদের ক্যাডারভিত্তিক সুশৃংখল সাংগঠনিক কাঠামোর মাধ্যমে ছলে বলে কৌশলে নানাভাবে দেশের কিশোর-তরুনদের সাম্প্রদায়িক চিন্তায় মোহাবিষ্ট করার তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে।  দেশের হাজার হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র শিবির গোপনে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।  এসকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ছাত্রসংগঠনগুলোর অনুপস্থিতিতে ছাত্রশিবির তাদের কার্যক্রমকে বিকশিত করতে ব্যাপক সফলতা লাভ করছে বটে। এতে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত দেশের তরুনসমাজের একটি বড় অংশ ব্রেন ওয়াশের মাধ্যমে মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছে।  যা একটি প্রগতিশীল জাতির জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর।  তাই মূলতঃ ধর্মাশ্রয়ী জামাত শিবিরসহ মৌলবাদী চক্রের অপরাজনীতির হাত থেকে দেশের তরুন সমাজকে রক্ষার তাগিদেই ছাত্রলীগ দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে সংগঠনের রাজনীতিকে অবারিত করার উদ্যোগ গ্রহন করেছে।

মূলতঃ স্কুল পর্যায়ে ছাত্র শিবিরের রাজনৈতিক কর্মকান্ড মোকাবেলা করতেই অনেকে ছাত্রলীগের এ সিদ্ধান্তকে প্রানোচ্ছাসে স্বাগত জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের স্কুল বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন এর বক্তব্যে ছাত্রলীগের বর্তমান অবস্থান ফুঁটে উঠেছে “ Islami Chatra Shibir has been trying to spread militancy among school students for years. In a bid counter them, Chatra league will form school level committee at every school in the country.  ( Dhaka Tribune, November 23, 2017)।  আবার সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনেকের ভাষ্য এরকম যে, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রাণপণে ছাত্র শিবিরের এধরনের কাজকে প্রতিহত করেছি।  কারণ, আমরা ছাত্রলীগ কর্মীরা বিশ্বাস করতাম, বর্তমান প্রেক্ষাপটে স্কুল পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি সামাজিক সংকট সৃষ্টি করবে, ঘরে ঘরে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে ইত্যাদি যা সামাজিকভাবে অশোভনীয় ও অকল্যানকর’।  এক্ষেত্রে দেশের বুদ্ধিজীবি ও শিক্ষাবিদদের মতামত হচ্ছে যে, কোন কারনেই যদি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি আনুষ্টানিকভাবে প্রতিষ্ঠালাভ করে তবে শিশু-কিশোররা অল্প বয়সে রাজনীতি চর্চায় মেতে উঠবে, নেতৃত্ব বিকাশের লোভে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে উঠবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের মেধার বিকাশ অঙ্কুরেই ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে।  আর কচি ছাত্রদের মাঝে দলবাজি নিয়ে মারামারি, সংঘাত ও সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়তো অবশিষ্ট থাকলো বটে।  ইন্টারনেটের বদৌলতে পত্রপত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে এসব বিষয় অবলোকনে এবং নিজের রাজনৈতিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতার আলোয় ছাত্রলীগের একজন প্রাক্তন কর্মী হিসেবে বর্তমান প্রেক্ষাপঠ বিবেচনায় ছাত্রলীগের সমকালীন রাজনীতিচিন্তার প্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য পেশ করছি।

দুই.
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস অনেক পুরোনো।  ছাত্রসমাজের সংগ্রামী হাত ধরেই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভ করেছে।  পাকিস্থানী আমলে পূর্ব বাংলায় কলেজ ও ইউনিভার্সিটির পাশাপাশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহ প্রথমবারের মতো ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে পুলিশ, ই পি আর’র গুলিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলো।  এসময় ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’  শ্লোগানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবীতে ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে দেশব্যাপী ছাত্র আন্দোলন রৌদ্ররুপ ধারণ করে।  এসময় কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রথমবারের মতো প্রতিবাদী মিছিলে অংশগ্রহন করেন।

ষাটের দশকেই প্রথম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি সম্প্রসারিত হয়।  পাকিস্থানী শোষকগোষ্টির চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দেশের ছাত্রসমাজের সূদীর্ঘ আন্দোলন এ ক্ষেত্রে প্রধানত ভূমিকা রাখে। ১৯৬৬’র ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের পর বাঙালি জাতির উপর পাক শাসকগোষ্টির নির্যাতনের ষ্টিমরোলার পরিচালিত হলে জাতির অবিসংবাদিত নেতা, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ হাজার হাজার রাজবন্দিদের মুক্তির দাবীতে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষে, সহজলভ্য শিক্ষা ও স্বাধীকারের দাবিতে এবং সর্বোপরি বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে দ্রুতপদে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ব্যাপক জনসমর্থন গঠনের তাগিদেই তখন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সংগঠনগুলোর প্রাতিষ্টানিক শাখা সম্প্রসারিত হয়।  ৬৯’র ছাত্রসমাজের সফল ১১দফা আন্দোলন ও গণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও স্বৈরশাসক আইয়ুব খাঁনের পতনের ফলে একদিকে বাংলার জাতীয়তাবাদী ও স্বাধীকার আন্দোলন অনন্য উচ্চতায় অধিষ্টিত হয় এবং একই সাথে দেশব্যাপী ছাত্ররাজনীতি তথা ছাত্রআন্দোলন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তায় অধিষ্ঠিত হয়।  ১৯৭০সালে পাকিস্থানের প্রাক্তন সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খাঁন রচিত ‘পাকিস্থান দেশ ও কৃষ্টি’ গ্রন্থ সমগ্র পাকিস্থানে নবম শ্রেনীর পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত হলে গ্রন্থে পাকিস্থানের ইতিহাস বিকৃতি ও বাঙালি জাতির জন্ম ইতিহাসকে নেতিবাচক ভাবে উপস্থাপনের অভিযোগে উক্ত গ্রন্থ বাতিলের দাবীতে দেশব্যাপী তীব্র ছাত্রআন্দোলন গর্জে উঠে।  পূর্ব বাংলার প্রতিটি  মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠে।  আন্দোলনের তীব্রতায় সরকার ছাত্রদের দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়।  এ আন্দোলন মূলতঃ মাধ্যমিক বিদ্যালয়কেন্দ্রিক জাগরণ হলেও কোথাও কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়।  এ সুদীর্ঘ ও সফল আন্দোলন শেষে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি সফলভাবে প্রাতিষ্টানিক রুপলাভ করে।  যা ১৯৭০’র ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে দেশব্যাপী গণজাগরণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৯৭১সালের ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অবদান অনস্বীকার্য।  মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতির স্বাধীনতার বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীরা বয়সের কারনে সরাসরি মুক্তিবাহিনীতে অংশগ্রহন করতে না পারলেও ব্যাপকভাবে মুক্তিযুদ্ধের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে অংশ নিয়েছিলেন।  শারীরিক সক্ষমতায় অনেকে সরাসরি মুক্তিবাহিনীতেও অংশগ্রহন করেন।

প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে স্বাধীনতা পরবর্তীতে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে  ছাত্ররাজনীতির চর্চা বন্ধ হয়ে যায়।  আবার আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে জোরালো করতে পূনঃরায় মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্ররাজনীতি সম্প্রসারিত হয়।  ১৯৮৩সালে স্বৈরাচার এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খাঁনের নেতৃত্বে প্রণীত কুখ্যাত ‘মজিদ খাঁন শিক্ষানীতি’র বিরুদ্ধে গর্জে উঠা ছাত্রআন্দোলন থেকে এর সূচনা ঘটে।  ১৯৯০’র গণ অভ্যুত্থানে মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক অংশগ্রহন থাকলেও ছাত্রসংগঠনসমূহের প্রাতিষ্টানিক ব্যাপকরণ ঘটেনি।  ৯০’র দশকের শুরুতে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের পর মাধ্যমিক স্কুল থেকে ছাত্ররাজনীতি বিদায় গ্রহন করে।  পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তনে দেশের ছাত্রসংগঠনগুলো অঘোষিতভাবেই মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্ররাজনীতি বিকাশের যে কোন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকে।  অর্থাৎ, ৯০’র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের পর থেকে আজ অবদি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট কোনক্রমেই মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্রআন্দোলন গড়ে তোলার অনুকুলে নয় বরং প্রয়োজনীয়তার মৌলিক প্রশ্নে অপ্রাসঙ্গিক ও অযাচিত।  দলমত নির্বিশেষে দেশের অধিকাংশ চিন্তাবিদ ও সাধারণ জনগণ তাই মনে করেন।

এমতাবস্থায় ৯০’র দশকের শেষলগ্নে ধর্মাশ্রয়ী ইসলামী ছাত্র শিবির মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে গোপনে তাদের দলীয় প্রচার শুরু করে।  এ ক্ষেত্রে তাদের দলীয় প্রচারপত্র সাপ্তাহিক কিশোর কন্ঠ শিশু-কিশোরদের অনেকের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে।  স্কুলের শিশুদের কাছে কিশোর কন্ঠ বিলি করতে জামায়াত-শিবির সমর্থক শিক্ষকরাও গোপনে জড়িত হন।  এসময় শিবির একধাপ এগিয়ে সংগঠনের জেলা, থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিটি শাখায় ফলচক্র, কিশোর কন্ঠ ক্রিড়া প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতা, শিক্ষা সফরপ্রভৃতি নামে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্টানাদিতে স্কুলের ছাত্রদেরও জড়িত করে।  কিন্তু তা কখনোই সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণীয়তা লাভ করেনী।  উপরন্তু, তাদের এরকম কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে দেশের ভিবিন্ন এলাকায় অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।  অনেক স্থানে স্কুল ছাত্রদের কাছে দলীয় প্রচারপত্র, কিশোর কন্ঠ, ছাত্র সংবাদপ্রভৃতি বিলিরত অবস্থায় নেতাকর্মীরা স্থানীয় জনগণের প্রতিরোধের শিকার হন এবং এসব নিয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সাথে সংঘর্ষেরও ঘটনা ঘটে। এসময় জামাত-শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে স্কুলের শিক্ষার্থীদের কাছে দলীয় প্রচারপত্র বিলি বা শিক্ষার্থীদের দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত করার অভিযোগে অনেক শিক্ষকও এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েন এবং অনেককে এসব অপরাধে চাকুরীচ্যুতও করা হয়।  অর্থাৎ দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের কাছে এধরনের কার্যক্রম নেতিবাচক রুপে আভির্ভূত হয়।  অন্যথায়, আজকের প্রেক্ষাপটে ছাত্র শিবিরের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতো।  প্রশ্ন থেকে যায়, কেন সাধারণ মানুষ পর্যন্ত ছাত্র শিবিরের স্কুল ভিত্তিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ালো? যদিও তাদের কার্যক্রমগুলো সৃষ্টিশীল ছিলো তথাপি কেন মানুষের সমর্থন পায়নি? শুধুই কি সাম্প্রদায়িক ভাবধারায় দেশের তরুনসমাজকে আসক্ত করার হীনমন্যতায় পরিচালিত হয়েছিলো বলে? না, তা মোটেই নয়।  মূলতঃ দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট কোনক্রমেই মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার উপযোগী ও অপরিহার্য্য নয় তাই।

বর্তমানে বাংলাদেশের ছাত্রআন্দোলন কোনক্রমেই ষাটের দশক বা আশির দশকের পর্যায়ে নেই, এখানে নেই তখনকার মতো ভদ্রতা ও মেধার পরিবেশ, দেশের মানুষের কল্যানের চিন্তা এখানে অনেকাংশেই অনুপস্থিত, এখানে ছাত্রকর্মীদের জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্ন অভিভাবকদের তাড়িত করে সর্বদা এবং প্রতিটি ছাত্রসংগঠন কর্তৃক তাদের অভিভাবক গণসংগঠন বা পিতৃসংগঠনের অযাচিত লেজুড়বৃত্তি প্রতিটি সংগঠনকে ক্ষুরে ক্ষুরে খাচ্ছে তাই ছাত্রকর্মীদের সম্মূখে নেই সঠিক রাজনৈতিক লক্ষ্য।  ফলে অভিভাবকগণ তাদের ক্ষুদে শিশুদের জন্য শিক্ষার সুষ্টু পরিবেশের নিশ্চয়তা চান, তাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য মেধাবী ও কার্যকর নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চান, কিন্তু প্রেক্ষাপট বিবেচনায় মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের দলীয় কর্মী হিসেবে দেখতে ঘৃণাবোধ করেন।  এটাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যে কোন ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষেপিত হওয়ার প্রধান কারণ।  আমি মনে করি, ভবিষ্যতেও এরকম গণচিন্তার কোন হেরফের হবেনা।

যারা অন্ধভাবে কেবলমাত্র রাজনৈতিক জিঘাংসাবশতঃ নানান প্রক্ষাপঠের ইতিহাস টেনে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিকে হালাল করে নিতে অতি আগ্রহী কয়েকটি উজ্জলতম উদাহরণকে সামনে রেখে তাদের উদ্দ্যেশ্যে বলতে চাই, (ক) একাত্তরের ঐতিহাসিক স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রধান নেতা, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নুরে আলম সিদ্দীকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় যখন ৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারী ভাষার প্রশ্নে ঢাকায় ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন, একজন শিশুর কন্ঠে যখন শোভা পাচ্ছিলো “ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগান, তখন পুলিশ, ইপিআর এর গুলিতে ছেলের বুক ঝাঝরা হওয়ার ভয়ে এতো শংকিত হননি তার রাজনীতি সচেতন বাবা।  কারণ, সে আন্দোলন ছিলো জাতির অস্থিত্বের সংগ্রাম।  (খ) ডামুড্যা হাই স্কুলের নবম শ্রেনীর ছাত্র থাকাবস্থায় ছাত্রলীগ ও বঙ্গবন্ধুকে অনুধাবন করতে কিশোর আব্দুর রাজ্জাক যে অসীম প্রেরণা লাভ করেছিলেন হয়তো তাই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অফুরন্ত শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করেছিলো বলেই পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের কেবলমাত্র পর পর দু’বারের সাধারণ সম্পাদকই হননি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর বিস্বস্থ সিপাহশালার ও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা।  (গ ) বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ, চেতনা, সংগ্রাম ও অফুরন্ত শক্তির আকর্ষনে কিশোর সুলতান মোহাম্মদ মনসুরের মৌলভীবাজার বহুমুখি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান ছাত্রলীগের সভাপতি ও ৬৯’র ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক আব্দুর রউফের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রলীগে যোগদান করেছিলেন এবং নবম শ্রেনীর ছাত্র থাকাবস্থায় নিজ স্কুলে ছাত্রলীগের প্রতিষ্টা করেছিলেন এবং স্কুল ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন; সে অপার শক্তিতে বলীয়ান হয়েই কিশোর সুলতান মনসুর মুক্তিযুদ্ধেই শুধু যোগ দেননি স্বাধীনতা পরবর্তীতে ৭৫’র ১৫ই আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নৃসংশভাবে স্বপরিবারে হত্যার পর পিতা হত্যার বদলা নিতে প্রতিশোধস্পৃহায় কাঁতর হয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, কালক্রমে হয়েছিলেন ডাকসু’র নির্বাচিত ভিপি।  কিংবদন্তী ছাত্রলীগনেতা আব্দুর রাজ্জাক ও সুলতান মনসুরের জন্মদাতা পিতা নবম শ্রেনীর ছাত্র কিশোর পুত্রের ছাত্ররাজনীতিতে অংশগ্রহনের সংবাদে হয়তো এতোটুকু বিচলিত হননি কারন, সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিলো জাতির অস্থিত্বের সংগ্রাম।  হাজার হাজার পিতা জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির প্রশ্নে সেদিন বুকের ধন, কলিজার টুকরা সন্তানদের সংগ্রামের ময়দানে ঠেলে দিয়েছিলেন যে অনুপ্রেরণায় আজ কি জাতির সম্মূখে সে আদর্শ, সে রক্তিম চেতনা বা সে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপঠ উপস্থিত? কিংবা আশির দশকে দূর্নীতিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে দেশের প্রগতির সমূহ সম্ভাবনাকে ধুলিস্যাৎ করে জগদ্দল পাঁথর হয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকা স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গর্জে উঠা ছাত্রআন্দোলনে অংশ নেওয়া মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীর সম্মূখে জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির তরে যে আকাশসম স্বপ্ন প্রেরণার মশাল জ্বেলে দিয়েছিলো আজ কি সে প্রক্ষাপট বিদ্যমান? আজ কি রাজপথে সংসার সাজাতে একজন কোমলমতি কিশোর শিক্ষার্থী খুবই অপরিহার্য্য? সচেতনভাবে দেখলে অবশ্যই তা নয়। তবে কেন তাকে ঘিরে এ উদগ্র আস্ফালন? সাধারণ জনগণ তাই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির বিকাশ মেনে নেয়নি।  দুনিয়াজুড়ে রাজনীতিতে এটাই সত্য যে, কার্যকর প্রেক্ষাপটই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে গণমানুষের কাছে গ্রহনীয় করে তুলে।  তাই যৌক্তিক কারণেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির প্রশ্নে সমর্থন ব্যক্ত করার মতো রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রেক্ষাপট আজকের বাংলাদেশে অনুপস্থিত একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়।

বর্তমান প্রজন্মের অনেক ছাত্রলীগকর্মীর চিন্তা ও আবেগ অনুযায়ী যদি কোন পঠভূমির উদ্রেক হয় তবে তা হচ্ছে প্রথমতঃ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের কর্মকান্ডকে প্রতিহত করার মানসে।  দ্বিতীয়তঃ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময় থেকে দেশের একজন ভবিষ্যত নাগরিককে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্নে সচেতন করে গড়ে তোলা।  যা একটি জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক চিন্তামুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।  যদি এ দুটি কারণই মূখ্য বিষয় হয় তবে রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসাবে আমার প্রশ্ন, ভবিষ্যত প্রজন্মকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র এর চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ করতে পারে কিনা সেটা ভেবে দেখা জরুরী।  ছাত্র সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যদি উপরোক্ত চিন্তা বা এর কাছাকাছি কোন চিন্তায়ও আবিষ্ট হয় তবে তাদেরকেও ভেবে দেখা উচিত যে, আধুনিক বিশ্বে মানবসমাজের চিন্তা-চেতনা ও প্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন হিসেবে দেশের ছাত্র ও যুবসমাজের সম্মূখে ছাত্রলীগ এর চেয়ে অধিকতর কার্যকর, জ্ঞানধারী, বৈজ্ঞানিক চিন্তা-চেতনাসমৃদ্ধ কোন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারে কিনা।  ছাত্রলীগ যেভাবেই সাংগঠনিক কাঠামোর বিন্যাস করুক না কেন মাধ্যমিক স্কুলে আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির চর্চা ও প্রতিদ্ধন্ধিতাপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করে কোনক্রমেই  জ্ঞান-বিজ্ঞানে কার্যকর ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব নয়।  ছাত্ররাজনীতির যথাযতো  কার্যকর প্রেক্ষাপটের অনুপস্থিতির দরুন ও অধিকতর দলীয় লেজুড়বৃত্তির ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো যখন প্রাণহীন, সাংগঠনিক কাঠামো ও কার্যক্রম যখন বিশৃংলাপূর্ণ, মেধাবী ভবিষ্যত নেতৃত্ব ও কার্যকর সুনাগরিক সৃষ্টির সৃজনশীল কার্যক্রমে যখন ছাত্রসংগঠনগুলোর উদ্যোগ ও অগ্রগতি ম্রীয়মান এবং যখন সংগঠনগুলোর মধ্যকার অপরাজনৈতিক কর্মকান্ডে দেশব্যাপী ছাত্রআন্দোলনের অস্থিত্বই স্বয়ং প্রশ্নবিদ্ধ তখন মাধ্যমিক স্কুলে দলীয় আদর্শিক ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগ কখনোই শুভ হবে না।  দেশব্যাপী এ ধরনের উদ্যোগ মেধাবী শিক্ষার্থী, শিক্ষকমন্ডলী ও অভিভাবকগণকে চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করেছে।  ভবিষ্যতে যা তিরস্কৃত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।  কেননা যে উদ্যোগ বা কর্মসূচি গণমানুষের হৃদয় উৎসারিত কল্পনায় সমৃদ্ধ নয় তা কখনোই সফল হতে পারেনী, পারবেও না।  বাংলাদেশের ছাত্রআন্দোলনের ইতিহাস আমাদের সে শিক্ষাই প্রদান করে।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা আর নিরাপদ পরিবেশে বেচেঁ থাকার নিশ্চয়তা একটি শিশু বা কিশোরের মৌলিক অধিকার।  তার রাষ্ট্র, সমাজ বা অভিভাবক এজন্য তার নিকট দায়বদ্ধ।  সৃজনশীল শিক্ষার পরিবেশ তার স্বপ্নের পৃথিবী।  তাঁর মেধা-মননকে বিকশিত করার সৃষ্টিশীল পরিবেশের নিশ্চয়তাই তার স্বপ্নময় ভবিষ্যতের আতুড়ঘর।  আটারো বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে শিশু-কিশোরদের সম্মূখে রাজনীতি নামক অদৃশ্য ব্যাপক বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়না।  তবে তা কেন আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে হবে? যখন একটি কিশোরের সম্মূখে জ্ঞান- বিজ্ঞানের বিশ্বে এপার থেকে ওপারে যাওয়ার স্বপ্নময় শিক্ষার ভান্ডার উপচে পড়ার কথা, নব নব বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের কল্পকাহিনী যখন তাকে পূলকিত করবে, স্পন্দিত মনে যখন সে কল্পনা করবে একদিন সেই হবে বিশ্বের শ্রেষ্ট মানুষ, যখন সে কল্পনা করবে সেই হবে দুনিয়ার সেরা কবি, সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, যুদ্ধবিশারদ, গবেষক, নাবিক বা রাষ্ট্রপ্রধান এসময় আমরা তার সম্মূখে অবারিত স্বপ্ন আর ঊচ্ছাসের বদলে যেমন কখনো রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মকে প্রাধান্য দিতে পারিনা তেমনি তার কাঁধে নেতৃত্ব নামক প্রতিযোগিতার ভাঁর তুলে দিতে পারিনা।  তার পড়ালেখার নেশা ও সময়কে সংগঠনের আদর্শিক কর্মী রিক্রুট ও ম্যানেজমেন্টের যাতাকলে পিষ্ট হতে দিতে পারিনা।  যা হবে অপরাজনীতি।  যে রাজনীতির যাতাকলে প্রাণস্পন্ধনে পূর্ণ ঐ কিশোর ভবিষ্যতের স্বপ্নীল বিশ্ব জ্ঞানের প্রদীপ্ত আলোয় অবলোকনের পূর্বে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে কৈশোরেই বিপন্ন হতে পারে।  এটা হবে তার প্রতি আমাদের অন্যায় ও অবিচার।  তাই যদি ঘটে তবে তার ও তার অভিভাবকের বুকভরা স্বপ্নের অপমৃত্যুর জন্য রাষ্ট্রও দায়ী হবে।

কোন চিন্তা-চেতনা বা আচার একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে দিনের পর দিন প্রচলিত থাকতেই তা একসময় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।  মাধ্যমিক স্কুলে ছাত্ররাজনীতি সত্যিকারেই প্রচলিত হলে একসময় তা সংস্কৃতিতে পরিণত হবে।  ফলে তা সহজে বন্ধ করাও রাষ্ট্রের পক্ষে যদি সম্ভব না হয় তবে এর মধ্যদিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতেও কলেজ-ভার্সিটির ন্যায় রাজনৈতিক প্রতিদ্ধন্ধিতাপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হবে, ছাত্র সংগঠনগুলোর দলীয় ও উপদলীয় গ্রুপিংয়ে শিক্ষাঙ্গন হবে কুরুক্ষেত্র, শিক্ষকমন্ডলী, স্থানীয় ম্যানেজমেন্ট কমিটি বা অভিভাবকমন্ডলী হবে বিভাজিত ও দল-উপদলে ভিবক্ত।  ফলে স্কুলগুলির শিক্ষার পরিবেশ ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে।  এভাবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস নেমে আসবে।  ফলে অগনিত শিশু-কিশোরের স্বপ্নীল ভবিষ্যত ও দেশের তরুন সমাজের মেধা-মননশীলতা ধ্বংস হতে পারে।  এর মাধ্যমে একটি মেধাহীন উচ্চাকাংখি, মোসাহেবী ও লেজুড়বৃত্তির মনোবৃত্তি সম্পন্ন ভবিষ্যত প্রজন্ম বেড়ে উঠবে যা দেশের উন্নতি ও প্রগতির অন্তরায়।  তাই এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় উদ্যোগ জরুরী।  যে কোন ছাত্রসংগঠন তার সাংগঠনিক কর্মসূচির বিষয়ে আজ বা ভবিষ্যতেও যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সামাজিক ক্ষতিকারক সিদ্ধান্তগুলোকে প্রতিহত করার এখতিয়ার রাষ্ট্রের।  এমতাবস্থায় আজ ও অনাগতকালের জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে ছাত্ররাজনীতি চর্চার যে কোন অপচেষ্টাকে কঠোর হস্তে নিষিদ্ধ করতে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোয় দেশের উন্নয়ন যখন অগ্রণ্মূখ, শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নয়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্টিত, দেশে যখন বহুমূখি শিল্প বিপ্লবের শুরু হয়েছে, শত শত অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্টা করা হচ্ছে, যখন তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশের সাথে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মেধা-মননের বিকাশ অত্যাবশ্যকীয়, যখন জেলায় জেলায় স্থাপিত হচ্ছে তথ্য-প্রযুক্তি অনুশীলন কেন্দ্র, যখন কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষন ও প্রাচুর্যতায় নব নব বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের দিকে আমাদের তরুন প্রজন্ম ধাবমান, যখন নানান ধরনের অর্থনৈতিক প্রতিকুলতার মধ্যেও দেশের লক্ষ লক্ষ বেকার যুবকদের বিভিন্ন বিষয়ে যথাযত প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কার্যকর ও দক্ষ করে তোলা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব, যখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দর্শন ‘ভিশন ২০২১’ বাস্তবায়নে প্রয়োজন সুশিক্ষিত মেধাবী ও কার্যকর ভবিষ্যত প্রজন্ম গড়ে তোলা, যখন দেশ-বিদেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার মধ্যদিয়ে একজন তরুন আধুনিক মন মানসিকতা সম্পন্ন বিশ্ব নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা অপরিহার্য তখন অনাগতকালের তরুণ প্রজন্মের সম্মুখে কিশোর বয়সে ছাত্ররাজনীতির শিক্ষা নয়; প্রয়োজন যুগোপোযোগী, মানসম্মত মানবিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষা প্রদানের নিশ্চয়তা, তাকে উচ্চ মানবিক স্বপ্নকাঁতর হয়ে গড়ে উঠার সুষ্টু পরিবেশের নিশ্চয়তা, তার মধ্যে লুকায়িত মেধার বিকাশের নিশ্চয়তা যা একজন কিশোর কিশোরীকে উচ্চ মানবিক স্বপ্নে বিভোর করে তুলবে, তার অভিভাবককে অনুপ্রাণীত করবে এবং দেশের সামাজিক পরিবেশের শান্তি ও স্নীগ্ধতা মনোরমভাবে ফুটে উঠবে।  অল্প আয়তনের বিশাল জনগোষ্টির দেশে শিক্ষাঙ্গনসমূহে এরকম পরিবেশের নিশ্চয়তা বিধান করতে পারলেই ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্টির সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে দেশবাসীর স্বপ্নীল সুখি-সমৃদ্ধ প্রগতিশীল বাংলাদেশ প্রতিষ্টা করা সম্ভব।

এ লক্ষ্যে আজকের বাংলাদেশে মৌলিক চিন্তা-চেতনায় দৈন্যদশায় উপনীত হওয়া ছাত্ররাজনীতিকে কলেজ-ভার্সিটি থেকে নিম্নদিকে বর্ধিত না করে ছাত্রআন্দোলনের ঐতিহাসিক ও মৌলিক চেতনার আলোকে যুগোপোযোগী পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে ছাত্রদের কল্যানে নিযুক্ত করা সময়ের শ্র্রেষ্ঠ দাবী।  প্রতিটি ছাত্র সংগঠনকে পিতৃসংগঠনের অপ্রয়োজনীয়, অযাচিত ও অনাহুত লেজুড়বৃত্তি পরিহার করে ছাত্রদের মৌলিক দাবীদাওয়া আদায়ে নিযুক্ত হওয়া বাঞ্চনীয়।  বিশ্বায়নের সাথে তাল রেখে দেশে গুণগত মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্টা, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির আধুনিকায়ন ও সংস্কার, ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধ এবং শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্টার আন্দোলনই আজকের ছাত্ররাজনীতির মূল প্রতিপাদ্য হওয়া বাঞ্চনীয়।  এক্ষেত্রে সর্ববৃহৎ ও প্রাচিনতম ছাত্রসংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের হাত ধরেই দেশের ছাত্ররাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন সাধন সম্ভব।  তাই ছাত্রলীগকেই প্রথমে আধুনিক ও বিজ্ঞানমুখি চিন্তা-চেতনায় অগ্রণ্মূখ হতে হবে।  কিন্তু, চলমান সাংগঠনিক কাঠামোয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের ছাত্ররাজনীতিতে কোনধরনের পরিবর্তন আনতে পারবে না।  যখন সংগঠনের গোটা সাংগঠনিক কাঠামো (কেন্দ্র, জেলা, ইউনিভার্সিটি, কলেজ, থানা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড) পিতৃসংগঠন আওয়ামী লীগ তোষনে ব্যতিব্যস্ত, সমগ্র দেশে সংগঠনের শাখাগুলোর কার্যক্রম যেখানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত এম পি, মন্ত্রীদের লেজুড়বৃত্তির উপর নির্ভরশীল, তৃণমূলে সংগঠনের নিয়মিত কাউন্সিল যখন একটি দুঃস্বপ্নের নাম, শাখাগুলোর নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়াতে সংগঠন যখন উপদলীয় কোন্দলে জর্জরিত, যখন দেশের সমূহ কলেজ-ইউনিভার্সিটিগুলোতে শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকারে প্রশ্ন দলীয় বাতাবরণে সীমাবদ্ধ, যখন ছাত্র সংসদগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে অথচ ছাত্রলীগ নির্বিকার তখন দেশের ছাত্রআন্দোলনের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশব্যাপী ছাত্রলীগের কর্মসূচি ও সাংগঠনিক বিন্যাসে ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তন জরুরী।  কিন্তু, তা না করে দেশের হাজার হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কর্মসূচির বিস্তারে ছাত্রলীগের স্কুল কমিটি গঠনের পরিকল্পনা ছিলো দেশব্যাপী ছাত্রলীগকে সাংগঠনিকভাবে মহাপ্রলয়ের সম্মূখিন করার নামান্তর।  অচিরেই এ উদ্যোগ সমূলে বন্ধ করা উচিত।  অন্যথায় এর পূন:প্রতিষ্টার মাধ্যমে দেশব্যাপী মাধ্যমিক বিদ্যালয়সমূহে আছড়ে পড়া ছাত্ররাজনীতির প্রতিযোগিতার ঢেউ গোটা মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধ্বংস ডেকে আনবে।  ফলে একদিন ছাত্রলীগকেও ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি আদর্শিক ছাত্র সংগঠন।  সংগঠনের সংগ্রামী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে ছাত্রলীগের অনেক রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক চিন্তার সংস্কার ও সিদ্ধান্ত বাংলার ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণালী অক্ষরে গ্রথিত।  সময়ের প্রয়োজনে আজও সংগঠনের ব্যাপক রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকেে চিন্তা ও কর্মের দিক দিয়ে একটি আধুনিক ছাত্রসংগঠনে পরিণত হওয়া অনস্বীকার্য্য।  যা গোটা দেশের ছাত্রআন্দোলনকে চিন্তাশক্তির দিক দিয়ে পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করবে।  কেননা, যুগে যুগে ছাত্রলীগই বাঙালি জাতিকে প্রগতিশীলতার পথে অগ্রযাত্রায় নেতৃত্বদান করেছে।  হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রলীগকে এই অভিধায়ই গৌরবান্বিত করেছেন যে, “ ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস”।  স্বাধীন বাংলাদেশে ৭৫’র ১৫ই আগষ্টের কালো রাত্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার পর প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্টির নির্যাতনের ষ্টিমরোলারের যাতাকল থেকে ছাত্রলীগই এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পূনরুজ্জীবনে নেতৃত্বদান করেছে।  আশির দশকের স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও নেতাকর্মীদের বুকের তাঁজা রক্তের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক পথ ধরে ফিনিক্স পাখির মতো যে ছাত্রলীগ গর্জে উঠেছিলো সে ছাত্রলীগই আবার ১৯৯৬’এ দেশে গণতন্ত্র রক্ষা এবং মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্টার দাবিতে সমগ্র জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার পরম গৌরবে সিক্ত হয়েছে।  এদেশে ধর্মাশ্রয়ী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশ বিনির্মানের আন্দোলনে প্রতিষ্টাকাল থেকে বিগত ৭০বছর যাবৎ ছাত্রলীগই এদেশে ছাত্রজনতার শেষ ভরসাস্থল।  বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মানে এবং জাতির রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমূহসংকট উত্তরণে অনাদিকাল পর্যন্ত ছাত্রলীগ দেশের ছাত্র-জনতার আস্থা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সমর্থনে গরীয়ান হোক- সংগঠনের ৭০তম প্রতিষ্টাবার্ষিকীতে এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

দেশের অগণিত বিবেকবান মানুষের এ আশা পূর্ণ হোক।  প্রগতিশীল বাংলাদেশে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও পশ্চাৎপদ চিন্তা-চেতনার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধিভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনার আলোকে মেধামননে প্রজ্ঞাবান নেতৃত্বে বিকশিত হোক আগামীর বাংলাদেশ।  এ প্রত্যাশায় শুভবুদ্ধির উদয় হোক সকলের।  জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ।

লেখক.
ছরওয়ার হোসেন, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। 

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn