যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকাশ্য। কেন্দ্র থেকে তা ছড়িয়ে পড়েছে দলটির তৃণমূলেও। জামায়াত অধ্যুষিত প্রায় প্রত্যেকটি আসনেই প্রার্থী বাছাই নিয়ে চলছে বিষোদগার। আর সেই কোন্দলে পক্ষাবলম্বন করে আগুনে ঘি ঢালছেন দলটির ছাত্রসংগঠন শিবিরের শীর্ষ নেতারাও। এমন অবস্থা থেকে উত্তরণে নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন সংস্কারের দাবিতে থাকা অংশটি। তবে তাদের সেই পরিকল্পনা ধোপে টেকেনি। যে কোনোভাবেই আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে দলটি। ইতোমধ্যে প্রার্থী মনোনয়ন, প্রচার টিম ও নির্বাচন নিয়ে কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করা হয়েছে। আসন সংখ্যার হিসাবে অতীতের সব রেকর্ড ভাঙার জন্যও গ্রহণ করা হয়েছে দ্বিস্তরের প্ল্যান। এদিকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে কমিশনের সংলাপে অংশ নিতে না পারলেও ১৬টি প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে জামায়াত। নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক করার দাবি জানিয়ে গত বুধবার এ চিঠি দেওয়া হয়। পাঁচ পৃষ্ঠার এই প্রস্তাবনায় স্থান পেয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালীকরণ ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণের পরামর্শ, প্রশাসনবিষয়ক পরামর্শ, সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত, নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাস, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, মনোনয়নপত্র দাখিল ও প্রচারের সময়সীমা, ভোটকেন্দ্র ও ভোটগ্রহণ, ভোট গণনা ও ফল প্রকাশ, নির্বাচনী এলাকা ও ভোটকেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োগ, দেশি ও বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ, গণমাধ্যম ও মোবাইল নেটওয়ার্ক, ভোটগ্রহণে যন্ত্র ব্যবহার, কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার রোধ এবং জাতীয় সংলাপ।

জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ বা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিও জানানো হয়। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের বিচারিক বা ম্যাজিস্ট্রিয়াল ক্ষমতা দেওয়ার জন্যও বলা হয়। তবে সারা দেশে নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে দিন কাটালেও কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্বাচনমুখী কার্যক্রমে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তৃণমূলকর্মীদের ধারণা, নির্বাচন কেন্দ্র করে আবারও ধরপাকড় ও নির্যাতনের শিকার হবেন তারা। অবশ্য জামায়াতের অংশগ্রহণের শপথের নিয়মানুসারে দলটির অভ্যন্তরীণ কোনো তথ্য অপর কারো সঙ্গে আলোচনায় রয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। এমনকি কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত মানার ক্ষেত্রেও রয়েছে বাধ্যবাধকতা। এর থেকে ব্যত্যয় ঘটলে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। সম্প্রতি জামায়াতের নির্বাচনমুখী অংশটি মনে করছে, নির্বাচনে গেলে অপেক্ষাকৃত ভালো করবে দল। এ লক্ষ্যে তারা জামায়াত অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে প্রার্থীদের সবুজ সংকেত দিচ্ছেন। অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন গণসংযোগ। আবার বিপত্তিও বেঁধেছে বেশ কিছু আসনে একাধিক প্রার্থী নিয়ে। রাজশাহী, গাইবান্ধা, সিলেট ও চট্টগ্রামের একটি আসনে এ দ্বন্দ্ব অনেকটাই প্রকাশ্যে। রাজধানীর দুটি আসন নিয়েও চলছে পাল্টাপাল্টি গ্রুপিং। কক্সবাজারের দুটি আসন ঘিরেও রয়েছে নির্বাচনী উত্তাপ। দলীয় সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগর থেকে আগামী নির্বাচনে অন্তত একটি আসনে নির্বাচন করার টার্গেট জামায়াতের। এক্ষেত্রে পল্টন ও যাত্রাবাড়ী এলাকা বেছে নিয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। পল্টন এলাকায় দীর্ঘদিন কাউন্সিলর ছিলেন জামায়াত নেতা আবদুর রব।

অন্যদিকে যাত্রাবাড়ীতে তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসাসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু দুই আসনের প্রার্থী নির্বাচনে সিদ্ধান্তহীনতায় দলটি। একইভাবে চট্টগ্রামে জামায়াতের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায়ও মনোনয়ন নিয়ে বিবাদ দীর্ঘদিনের। মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হন সাবেক এমপি ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী। মনোনয়ন দেওয়া হয় নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলামকে। তিনি নির্বাচিতও হন। আসন্ন নির্বাচনেও তাকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় জামায়াত। তবে বিষয়টি নিয়ে মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েন কেন্দ্রীয় ও জেলা নেতারা। কারণ কেন্দ্র ও চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের বড় অংশ শামসুল ইসলামের পক্ষে, আর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ও স্থানীয় নেতৃত্ব শাহজাহান চৌধুরীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। যদিও কেন্দ্র থেকে অপেক্ষাকৃত জামায়াতের শক্ত ভোটব্যাংক চট্টগ্রাম মহানগরীর হালিশহর-ডবলমুরিং আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অনুরোধ করা হয় শাহজাহান চৌধুরীকে। কিন্তু তিনি এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে সাতকানিয়ায় নির্বাচনী প্রচার অব্যাহত রাখেন। এমন দ্বন্দ্বের মধ্যে নতুন করে রসদ দেন শিবিরের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত। তিনি প্রকাশ্যই সমর্থন দেন শামসুল ইসলামকে।

কক্সবাজার-৩ (রামু-কক্সবাজার সদর) আসনে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম রহিমুল্লাহ গণসসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি প্রচার চালাচ্ছেন জামায়াত নেতা সলিম উল্লাহ বাহাদুরও। এ ছাড়া কুমিল্লা ও সিরাজগঞ্জের জামায়াত প্রভাবিত দুটি আসনেও রয়েছে একাধিক প্রার্থী। দলটির অতীত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নির্দিষ্ট কিছু আসনকে ঘিরেই জামায়াতের ভোটব্যাংক। বিভিন্ন সময় এসব আসন থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন দলের মনোনীত প্রার্থীরা। এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন নেতা বলেন, আমরা জোটবদ্ধভাবে ৫১ আসনে নির্বাচন করার চিন্তা করেছি। এর মধ্যে যেসব আসনে অতীতে জয়ের রেকর্ড রয়েছে, সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী, সেগুলোকেই বাছাই করা হয়েছে। এর বাইরে যেসব আসনে গত দুটি উপজেলা নির্বাচনে আমাদের প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন, সেগুলোও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে রংপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, ফেনীতে প্রার্থী থাকতে পারে জামায়াতের। দলীয় সূত্র জানায়, ৪০ আসনে জয়ের জন্য জামায়াতের নেতাকর্মীরা মরণপণ লড়াই করবেন। এক্ষেত্রে তারা জোটের প্রধান শরিক বিএনপিকেও ছাড় দেবে না। প্রয়োজনে এ রকম চারটি আসনে প্রার্থিতার ক্ষেত্রে জোটমুক্ত থাকবে।

এমন একটি প্রস্তাবনাও তৈরি করা হয়েছে দল থেকে। এক্ষেত্রে বগুড়াকেই গুরুত্ব দিচ্ছে জামায়াত। বিভিন্ন উপজেলা নির্বাচনে সেখানে বিএনপির চেয়েও ভালো করেছে। এতেই বেড়ে গেছে আত্মবিশ্বাস। তবে বগুড়ার প্রায় প্রতিটি আসনেই বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছে। তাই এসব আসন জামায়াতকে ছাড়বে না বিএনপি। এর বাইরে রংপুরেও জোটমুক্ত থাকতে চায় জামায়াত। মূলত বেশ কিছু আসন কেন্দ্র করে শুরু হওয়া দ্বন্দকে চাপা দিতে কেন্দ্রীয় আমির ও সেক্রেটারি জেনারেল বৈঠক আহ্বান করেছিলেন। উত্তরার একটি বাসায় আয়োজিত ওই বৈঠক থেকেই পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তারা। একইভাবে ঢাকার একটি আসনে প্রার্থিতা নিশ্চিত করতেই বৈঠকে বসেছিল ঢাকা দক্ষিণ জামায়াত। সেখান থেকেও গ্রেপ্তার হন দক্ষিণের আমির ও সেক্রেটারি জেনারেলসহ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতা। দলের ঢাকা অঞ্চলের দায়িত্বশীল এক নেতা জানান, গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তারের পর নির্বাচন কেন্দ্র করে হাতে নেওয়া হয়েছে ভিন্ন কৌশল। নির্দেশনা তৈরি করে তা কর্মীদের কাছে অনলাইনে পাঠিয়ে দেবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। আপাতত কোনো বৈঠক ডাকা হবে না। আর নির্বাচনে জরিপ ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে শিবিরের ওপর। এই ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা ৫১ আসনকে টার্গেট করে প্রতি আসনে ২০ জনের টিমও করে দিয়েছেন। তারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভোটের রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করবেন। দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তাও পর্যবেক্ষণ করবেন। তাদের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই চূড়ান্তভাবে প্রার্থী মনোনয়ন দেবে জামায়াত। আগামী জানুয়ারির শুরুর দিকেই প্রার্থী চূ’ড়ান্ত করে ভোটের মাঠে নামবে দলটি।

জানা যায়, জামায়াতের অভ্যন্তরে থাকা প্রভাবশালী গ্রুপটি ৫১ আসনকে টার্গেট করে প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা তৈরি করেছে। আসনভেদে সেখানে তিন থেকে ছয়জনের নামও রয়েছে। তবে এ তালিকায় দলের অভ্যন্তরে সংস্কার দাবি করা কোনো প্রার্থীর নাম নেই। এমনকি এসব নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন জেলা ও মহানগর নেতাদের নামও বাদ দেওয়া হয়েছে। এদিকে জামায়াতের বেশিরভাগ সক্রিয় নেতাই মামলা-হামলায় বিপর্যস্ত। এর বাইরে অনেকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। অনেকে বিচারে কারান্তরীণ। অনেকের ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। বলতে গেলে সক্রিয় নেতারা অনেকেই নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। এক্ষেত্রে বিকল্পও ভেবে রেখেছে জামায়াত। দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য এমন কিছু ক্লিন ইমেজধারী নেতার তালিকা তৈরি করেছে দলটি। আগামী নির্বাচনে এসব নেতাকে দিয়েও দলটি মনোনয়নপত্র দাখিল করাবেন। কারণ স্বতন্ত্রভাবে মনোনয়ন দাখিলে বাধা নেই। এক্ষেত্রে জামায়াতের প্রার্থিতা সংকটের শঙ্কা এড়াতেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গুরুত্ব বোঝে কোনো আসনে দুজন আবার কোনো কোনো আসনে তিনজনকেও মাঠে নামাতে চায় দলটি। যাতে নির্বাচনের মনোনয়ন বৈধতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা আবু মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, নির্যাতন-নিপীড়নে মানুষের সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছে জামায়াতের ওপর। বিএনপির একাধিক প্রার্থী থাকলেও বেশিরভাগ স্থানেই জামায়াতের কেবল কেন্দ্র মনোনীত প্রার্থী। ফলে ভোটের মাঠে এগিয়ে থাকবেন জামায়াত প্রার্থীরাই। এ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার ও মামলার কথা বিবেচনায় নিয়েই একাধিক প্রার্থী বাছাই করা হচ্ছে।-আমাদের সময়

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn