ডিভোর্স সমস্যা নয়- তসলিমা নাসরিন
বিয়েটা যতটা না জরুরি, তার চেয়ে জরুরি ডিভোর্স। নারী-পুরুষের যদি পরস্পরের প্রতি প্রচুর প্রেম থাকে, বিয়ে না করেও একত্রবাস সম্ভব, সন্তানকে স্বাগত জানানোও সম্ভব। কিন্তু এক ছাদের নিচে ভালোবাসাহীন জীবন বড় দুঃসহ। ডিভোর্স চাই-ই চাই। এ তো গেল সভ্য এবং সংবেদনশীল নরনারীর কাহিনী। অন্য নরনারীদের অন্য গল্প। তারা বিয়ে করে যাকে একবার স্বামী বা স্ত্রী বলে মেনে নেয়, তাকে আর ত্যাগ করতে পারে না। বিশেষ করে নারীরা। সংসার অসুখে বিবর্ণ হয়ে থাকলেও, অশান্তিতে ঘরবাড়ির পরিবেশ শ্বাসরুদ্ধকর হলেও অধিকাংশ নারী স্বামীকে তালাক দেয় না, কারণ এক হচ্ছে সংস্কারের বাধা, লোকে কী বলবে; দুই হচ্ছে সন্তানের ভাবনা, পিতার সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হবে; তিন হচ্ছে অর্থনৈতিক অনিরাপত্তা, কোথায় থাকবো, কী খাবো। ভারতে তিন তালাকের শরিয়া আইনটি উঠে যায় যায় অবস্থা। যে পুরুষেরা তাদের স্ত্রীকে ‘তালাক তালাক তালাক’ বলে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেবে মুহূর্তে, তাদের তিন বছরের জেল হবে।
তিন তালাক-বিরোধী এরকম একটি আইন ভারত সরকার ভারতের মুসলিম মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য তৈরি করতে চাইছে। কারণ মেয়েরা সাধারণত স্বামীর ওপর নির্ভর করে, স্বামী তাদের হুটহাট ত্যাগ করলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তারা রীতিমতো পথে বসে। আমি অবশ্য বলি, ঘৃণা আর নির্যাতনের সংসারের চাইতে তালাক অনেক ভালো। তালাকের সংখ্যা বেশি সভ্য সমাজে, যে সমাজে মেয়েরা সাধারণত শিক্ষিত, সচেতন, স্বনির্ভর। স্বনির্ভর মেয়েদের আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে পরনির্ভর মেয়েদের মতো বেঁচে থাকতে অনীহা। তাই যত সহজে স্বনির্ভর মেয়েরা অত্যাচারী স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে, তত সহজে পরনির্ভর মেয়েরা পারে না। শুধু স্বনির্ভর হলেই অবশ্য হয় না, সচেতন হতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়া স্বনির্ভর মেয়ে মেলে, কিন্তু সচেতন মেয়ে খুব মেলে না। অত্যাচারী স্বামীর সঙ্গে বাস করাটা বা ধর্ষক এবং নির্যাতকের সঙ্গে সংসার করাটা যে শখের নরক যাপন এবং এটির যে কোনও প্রয়োজন তাদের নেই— এই সচেতনতাটা মেয়েদের মধ্যে খুব বেশি দেখা যায় না। কারণ সচেতনভাবেই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদের এই সচেতনতাটা শেখায় না বা শিখতে বাধা দেয়, কেউ শিখে ফেললে তাকে সমাজচ্যুত করে।
ভারতের মুসলিম মেয়েরা অধিকাংশই শিক্ষিত নয়, সচেতনও নয়, স্বনির্ভর তো নয়ই। তাই স্বামী দ্বারা অত্যাচারিত হওয়াতে তাদের আপত্তি না থাকলেও তালাকপ্রাপ্তা হওয়াতে আপত্তি। প্রগতিশীল লোকেরা, এমনকি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে মেয়েদের রক্ষা করতে। তারা তিন তালাক বাতিল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যে পুরুষেরা তিন তালাকের শরিয়া আইন ব্যবহার করে স্ত্রীদের তাড়াতে চায়, সেই স্ত্রীরা, আমি বুঝি না, কী করে স্বামীর বাড়ির মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায়! নিজের মানমর্যাদা বিকিয়ে দিয়েই তো! এই বিকিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে মেয়ে স্বনির্ভর নয় বলেই। আসলে উত্তেজিত হয়ে কেউ তিন তালাক উচ্চারণ করতে পারে, পরে ভেবেচিন্তে সেটি বাতিল করার ইচ্ছে করতে পারে, কিন্তু হিল্লা বিয়ের বাজে একটি নিয়ম আছে বলে সহজে পারে না। সে ক্ষেত্রে এভাবে মুহূর্তের মৌখিক তালাক বাঞ্ছনীয় নয়। অনেক মুসলিম দেশেই তিন তালাকের আইন বাতিল হয়ে গেছে পাকিস্তানে, বাংলাদেশে, ইন্দোনেশিয়ায়, মালয়েশিয়ায়। ভারতেও হওয়া উচিত। তাই বলে কিন্তু তালাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন একেবারেই উচিত নয়। স্বামীকে তালাক দেওয়া নারীর জন্য যেমন দরকারী, স্ত্রীকে তালাক দেওয়া পুরুষের জন্যও দরকারী। ভালো না বাসলে, ঘৃণা গভীর হলে, সমঝোতা বিফলে গেলে, আপসে কাজ না হলে তালাকই সঠিক পথ। প্রায়ই খবরের কাগজে পড়ছি স্ত্রীকে বিষ খাইয়ে, কুপিয়ে, কুচি কুচি করে কেটে, গলা টিপে, গুলি করে হত্যা করছে পুরুষেরা। খবরের কাগজ কিন্তু প্রতিদিন কত লক্ষ মেয়ে মানসিক পীড়নের শিকার হচ্ছে তা জানায় না।
বাংলাদেশের সিনেমা-নায়ক শাকিব তালাক দিচ্ছে নায়িকা অপু বিশ্বাসকে। অপুর দোষ, অপু তার স্বামী শাকিবের আদেশ নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেনি। শাকিবকে ভালোবেসে অপু কিন্তু নিজের ধর্ম ছেড়ে শাকিবের ধর্ম গ্রহণ করেছে, শাকিবের বাড়িতে ঝি-চাকরের মতো কাজ করেছে, শাকিব বিয়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখতে বলেছে বলে লুকিয়ে রেখেছে, একবার দু’বার তিনবার গর্ভপাত করানোর আদেশ দিয়েছে বলে একবার, দু’বার, তিনবার গর্ভপাত করিয়েছে, তবে চতুর্থবার গর্ভপাতের আদেশ অপু মানতে পারেনি। বাচ্চা হওয়ার খবরটাও শাকিব লুকিয়ে রাখতে বলেছে বলে দীর্ঘকাল লুকিয়ে রেখেছে অপু, বাচ্চা হওয়ার সময় শাকিব হাসপাতালে যায়নি তারপরও শাকিবের জন্য অপুর ভালোবাসা কিছু কমেনি। এই অপুকে এখন তালাকনামা পাঠিয়েছে শাকিব। শাকিবের মতো আত্মম্ভরী পুরুষের সঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়া অবশ্য ভালো।
স্বনির্ভর মেয়ে অপু নিজের দেখভাল নিজেই করতে পারবে। কিন্তু শাকিবের জন্য কান্নাকাটি হাহুতাশ বন্ধ করতে হবে অপুকে। নিজেকে অপাঙেক্তয় ভাবার অভ্যেসটাও দূর করতে হবে। অপু স্বনির্ভর হলেও সচেতন নয়। মানমর্যাদা খুইয়েও হয়তো সে চেয়েছে শাকিবের স্ত্রী হয়ে থাকতে। সচেতন মেয়েরা স্বামীর অপমান অত্যাচার সয় না। কিন্তু অপুর অপমান অত্যাচার সইতে আপত্তি নেই। অপু নিজেকে বারবার ছোট করেছে শাকিবের ভালোবাসা পেতে, সামান্য করুণা পেতে। এমনকী সিনেমা জগৎ ছেড়ে মনপ্রাণ ঢেলে শাকিবের ধর্ম ইসলামকে শুধু বরণ করা নয়, একে চর্চা করারও প্রতিজ্ঞা করেছে। নামাজ রোজা বাদ দিচ্ছে না, হজ করবে বলেও মনস্থির করেছে অপু। তারপরও কিন্তু শাকিবের মন পাচ্ছে না। শুধু অপু নয়, প্রচুর স্বনির্ভর মেয়েই সচেতন নয়। সত্যি বলতে, স্বনির্ভরতা যতটা জরুরি, সচেতনতা ততটাই জরুরি।
অনেক সময় পরনির্ভর মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা দেখি। তারা স্বামীর অত্যাচার সইবে না বলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, স্বামীকে তালাক দেয়। এবং কঠোর কঠিন কণ্টকাকীর্ণ পথে রক্তাক্ত হতে হতে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তোলে। স্বনির্ভর হওয়ার চেয়ে সম্ভবত সচেতন হওয়াটাই আর আত্মমর্যাদাবোধ থাকাটাই বেশি কাঙ্ক্ষিত। তবে এও ঠিক, সব বয়সে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। সমাজের পরিবেশ নারীর জন্য নিরাপদ হলে সমস্যা কিছু কম থাকে। বয়স বৈষম্যের শিকার পুরুষের চেয়ে নারীই বেশি।
শাকিবের সঙ্গে অপুর ডিভোর্স হওয়াই ভালো। অপু বাঁচবে শাকিবের নিরন্তর নির্যাতন থেকে। যে লোক বলে আমার কথা শোনেনি বলে আমি ওকে ডিভোর্স দিচ্ছি, আমার আদেশ মানেনি বলে ওকে আমি বিদেয় করে দিচ্ছি— সে নিশ্চিতই নারীবিরোধী লোক। নিশ্চয়ই নারীর সমানাধিকারে সে বিশ্বাস করে না, পুরুষকেই সর্বময় কর্তা বলে মানে, নারীকে পুরুষের দাসী বলে মনে করে। এমন ভয়ঙ্কর পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার লোকের সঙ্গে বাস করলে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে যাবে। অপু যথেষ্ট অসুস্থ হয়েছে, এবার নিজেকে ও সুস্থ আবহাওয়া দিক। আমি খুশি হতাম, যদি অপু শাকিবকে ডিভোর্স দিত। মেয়েদেরই উচিত বদ মানসিকতার লোকগুলোকে ডিভোর্স করা। প্রশ্ন উঠবে, বিয়ে করার সময় দেখে শুনে নেয়নি কেন। বিয়ের আগে পুরুষগুলো ন্যাকামো করে আসল চরিত্র ঢেকে রাখে। বিয়ের পর ধীরে ধীরে তাদের বর্বরতা প্রকাশ পেতে থাকে। তা ছাড়া মানুষ তো সময়ের সঙ্গে পাল্টায়। আমরা আশা করি খারাপ পুরুষ ভালো পুরুষে পরিণত হবে। কিন্তু আমাদের আশায় আবর্জনা ছুড়ে দিয়ে অনেক ভালো পুরুষেরই খারাপ পুরুষে রূপান্তর ঘটে।
আমি নিজেও তো এই ভুল করেছি। না বুঝে ভুল পুরুষকে বিয়ে করেছিলাম। যখন টের পেলাম ভুল করেছি, দেরি না করে তালাকনামা পাঠিয়েছি। হ্যাঁ আমি পাঠিয়েছি। অন্য কেউ আমাকে পাঠায়নি। যদি না পাঠাতাম, সর্বনাশ হয়ে যেত। আত্মসম্মান বলে আমার কিছু থাকতো না। আমি আর আমি হতাম না, নিজের মতো করে বাঁচা আমার আর হয়ে উঠতো না। অপুর মতো স্বামীর আদেশ নির্দেশ মেনে চলতে চলতেই জীবন ফুরোতো। অপু তার নিজের মতো করে বাঁচার সুযোগ পেয়েছে। স্বাধীনতার চেয়ে বড় কিছু দুনিয়াতে নেই। নিজের জীবনে কী করবে না করবে তার সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার মতো জরুরি কাজ আর কিছু নেই, খাঁচা খুলে বেরিয়ে এসে বিশাল আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নেওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। গ্লানিময় জীবনের ইতি ঘটিয়ে সুস্থ সুন্দর সহমর্মিতার জীবনকে বরণ করে নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কাজ আর কিছু নেই।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন