দিনভর টানা বৃষ্টিতে নগরবাসীর চরম দুর্ভোগ
থই থই পানি। কোথাও হাঁটু সমান, কোথাও তারও বেশি। কোথাও পানি আর নর্দমা একাকার। দিনভর টানা বৃষ্টিতে এমন অবস্থা ছিল রাজধানীর প্রায় সব এলাকার। আর এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে নগরবাসীকে। পানি, ময়লা, কাদা মাড়িয়ে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় দিনভর সড়কে ছিল তীব্র যানজট। নগরীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়ক পর্যন্ত ছিল জলাবদ্ধতার চিত্র। ভুক্তভোগীরা বলছেন, বিগত কয়েক মাসে নগরজুড়ে ধারাবাহিক খোঁড়াখুঁড়িতে দুর্ভোগের মাত্রা ছিল চরমে। গতকাল সকালে নগরের কর্মজীবী মানুষেরা কর্মস্থলে যাওয়ার পথেই পড়েন বিপত্তিতে। কাকভেজা হয়ে গন্তব্যে যাওয়ার জন্য গণপরিবহনের অপেক্ষায় থাকলেও তাদের অপেক্ষাই বিফল হয়েছে। যানজটের কারণে গণপরিবহনের গতি যেমন শ্লথ ছিল, তেমনি কোথাও কোথাও যানজটে আটকা পড়ে নষ্ট হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ কর্মঘণ্টা। কর্ম শেষে বাসায় ফিরতে বিকালে ও সন্ধ্যায়ও ছিল সেই একই চিত্র। আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসেবে গতকাল ঢাকায় সর্বোচ্চ ৬৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আজও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আজও বৃষ্টিতে দুর্ভোগে পড়তে পারেন নগরবাসী। চলছে মাহে রমজান। পবিত্র ঈদুল-ফিতরও আসন্ন। রোববার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বিপণিবিতান ও ফুটপাথগুলোতে ঈদের কেনাকাটার ভর সময়। কিন্তু গতকাল ছিল এর ব্যতিক্রম। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে অনেকেই ঘর থেকে বের হতে পারেননি। গুরুত্বপূর্ণ কাজও অনেকে সারতে পারেননি একই কারণে। গতকাল রাজধানীর ফার্মগেট, তেজকুনীপাড়া, কাওরানবাজার, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, শাহজানপুর, খিলগাঁও, বাসাবো, মাদারটেক, মিরপুর, কালশি, মতিঝিল, কমলাপুর, নাজিমউদ্দিন রোড, পুরান ঢাকার একাধিক এলাকায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কোথাও কোথাও বিপণিবিতান ও বাসা বাড়িতেও উঠেছে বৃষ্টির পানি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, সৃষ্ট জলাবদ্ধতা ও যানজটের কারণে ওই সব এলাকার সাধারণ মানুষ একপ্রকার অবরুদ্ধ দিন পার করেছেন। আর দিনভর বৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষের কষ্টও ছিল সীমাহীন। দুপুরে মিরপুরের কালশি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টির পানি জমেছে সেখানকার প্রধান সড়কগুলোতে। আর সৃষ্ট জলজটে প্রায় দিনভর ওই এলাকার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতে পারেননি। মূল সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বাদ যায়নি এলাকার অলিগলিও। সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল করলেও যানজট ছিল দিনভর। ধীর গতিতে যানবাহন চলাচলের কারণে এই এলাকায় চলাচলকারী যাত্রীদের যানজটে পড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করতে হয়েছে। কালশি বাজার এলাকার আফিয়া জানান, রোববার রাত থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আজ (গতকাল) দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। তিনি বলেন, আমার স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু বৃষ্টির কারণে তিনি ঘর থেকে বের হতে পারেননি। সামনে ঈদ আর এখন যদি কাজে যেতে না পারেন তবে আমরা ঈদ করবো কিভাবে? আর এই কালশি এলাকায় সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে থাকে। নাজিম উদ্দিন রোডে দেখা যায়, নাজিম উদ্দিন রোড থেকে পুরাতন কেন্দ্রীয় কারাগার রোড হয়ে চকবাজার পর্যন্ত রাস্তায় পানি জমে আছে। পানি জমে থাকার কারণে এই এলাকার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। এমনকি রাস্তার এই পার থেকে ওই পার যেতে রিকশা ব্যবহার করতে হচ্ছে। ড্রেন থেকে ময়লা পানি উঠে চারদিকে ছড়িয়ে আছে। আর এই ময়লা পানির মধ্য দিয়েই অনেকে রাস্তা পার হচ্ছেন। রাস্তায় পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হওয়ার কারণে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে ব্যবসায়ীরা দোকান খোলেননি। খিলগাঁও, শাহজাহানপুরে একাধিক এলাকার বাসিন্দারা গতকাল জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়েছেন। ওই এলাকায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় ফুটপাথ, ড্রেন আর সড়ক যেন একাকার হয়ে গেছে।
এদিকে রাজধানীতে জলাবদ্ধতার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজের ধীরগতিকে দায়ী করছেন নগরবাসী। ধারাবাহিকভাবে সড়ক, ফুটপাথ খোঁড়াখুঁড়ির মধ্যে বৃষ্টি হানা দেয়ায় নগরজীবনে দুর্ভোগ চরমে উঠেছে বলে মনে করেন নগরবাসী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, সিটি করপোরেশন, মেট্ররেল, ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি চলছে অনেকদিন ধরেই। খোঁড়াখুঁড়িতে সৃষ্ট গর্তে জমে থাকা পানি, আর সড়ক ও পাশের ফুটপাথে পড়ে থাকা নির্মাণ সামগ্রী ও জমে থাকা কাদা মাটির স্তূপ দুর্ভোগ আরো বাড়িয়েছে। আগারগাঁওয়ের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অফিসের প্রধান ফটকের সামনে থেকে শুরু হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর অভিমুখী তালতলা, রোকেয়া সরনি, শেওড়াপাড়া পর্যন্ত রাস্তায় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে অনেকদিন ধরেই। এলাকাবাসী জানান, আগারগাঁওয়ে কিছুদিন পরপরই উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। গত কয়েক মাস ধরে এই এলাকা দিয়ে চলাচলরত পথচারী এবং যানবাহনের দুর্ভোগের শেষ নেই। আর এখন যোগ হয়েছে বৃষ্টি। সব মিলিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছেন এই এলাকার বাসিন্দারা। গতকাল বৃষ্টিতে দিনভর যানজট ও কাদা পানিতে মাখামাখি হয়ে ওই এলাকার বাসিন্দাসহ গণপরিবহনে চলাচলকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাকাল হয়েছেন। মৌচাক মালিবাগ এবং শান্তি নগরের অবস্থাও একই। ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ এবং সিটি করপোরেশন ওয়াসার উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি গর্ত, সড়ক ও ফুটপাথে ফেলে রাখা কাদার কারণে এই এলাকায় যানবাহন চলাচলের স্বাভাবিক গতি ফিরে আসেনি। রোববার রাত এবং সোমবার সারাদিনের বৃষ্টিতে ওই এলাকার মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহান। সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে যানবাহনও চলতে পারেনি স্বাভাবিক গতিতে। মৌচাক এলাকার ফুটপাথের পোশাক বিক্রেতা মো. ওমর ফারুক বলেন, রমজান শুরুর পর থেকেই ঈদের বিক্রি ভালো ছিল। কিন্তু রোববারের বৃষ্টি এই এলাকায় আবার জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে আজ (গতকাল) সারাদিন দুইশ টাকার বেশি বিক্রি হয়নি।
ফার্মগেট দ্বিতীয় ওভারব্রিজ (পথচারি সেতু) থেকে পান্থপথ অভিমুখী সড়কের প্রজাপতি আন্ডারপাস পর্যন্ত ফুটপাথ পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। ওই সড়কের পাশের দোকানদার, চলাচলকারী বিভিন্ন গণপরিবহনের চালক ও এর সহকারীরা জানান অন্তত তিন মাস ধরে ফুটপাথ পুনর্নির্মাণের কাজ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে, একটু বৃষ্টি হলেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। গত দুদিনের বৃষ্টিতেও একই অবস্থা। মুষলধারে বৃষ্টির কারণে ওই এলাকার সড়কে থই থই করছে পানি। আবার ওই পানি আশপাশের অলি গলি হয়ে ছড়িয়েছে পুরো কাওরানবাজারে। সেখানেও সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এ অবস্থা চলে। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েন এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী সাধারণ মানুষ ও গণপরিবহনের চালক ও যাত্রীরা।
গতকাল দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ফার্মগেট দ্বিতীয় পথচারী সেতু থেকে কাওরানবাজার প্রজাপতি আন্ডারপাস পর্যন্ত ফুটপাথজুড়ে ইট, পাটাতন, বালু, সিমেন্টের স্তূপ। যা বৃষ্টির পানিতে উপচে পড়ছে মূল সড়ক পর্যন্ত। হাঁটুসমান বৃষ্টির পানি ও নির্মাণ সামগ্রী মূল সড়কে পড়ে থাকায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে যান চলাচল। গণপরিবহনগুলোর গতিও যাচ্ছে কমে। যে কারণে যানজটও এখানকার নিত্য দৃশ্য। ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে যানজট ফার্মগেট থেকে প্রজাপতি আন্ডারপাস হয়ে পান্থপথ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ওই সড়কের নর্দান ইউনিভার্সিটির সামনের ফুটপাথের অবস্থা আরো ভয়াবহ। নির্মাণকাজ শেষ না করায় ফুটপাথের বেশকিছু জায়গায় তৈরি হয়েছে ছোটবড় গর্ত। কিছু কিছু গর্তে লাল নিশান দিয়ে বিপদ সংকেত দেয়া হলেও অনেক গর্তেই তা নেই। দুর্ঘটনারোধে সচেতন অনেকেই নির্মাণকাজের জন্য ফেলে রাখা পাটাতন ও ইট দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে সাধারণের চলাচলের উপযোগী করছেন ফুটপাথটি। এই ফুটপাথ দিয়ে প্রতিনিয়ত চলাচলকারী কয়েকজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সময়মতো কাজ শেষ না করা, নির্মাণ সামগ্রী ফুটপাথ ও মূল সড়কে ফেলে রাখার কারণে এই ফুটপাথে চলাচল করতে গিয়ে প্রতিনিয়তই তাদের দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। গতকালের মুষলধারার বৃষ্টি তাদের দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছু দুই বন্ধু আতিক ও সাকিব বলেন, প্রতিদিনই এই ফুটপাথ দিয়ে আমাদের চলাচল করতে হয়। প্রতিনিয়তই আমরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি। আজকের (গতকাল) বৃষ্টিতে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। পাশের এম আর ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. আক্তার হোসেন বলেন, তিন মাস ধরে এই ফুটপাথের কাজ চলছে। কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। আর প্রতিনিয়তই মানুষ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ড্রেনের পানি, বৃষ্টির পানি একাকার হয়ে গেছে মূল সড়কে। ফুটপাথ ছেড়ে মানুষ মূল সড়ক দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আজকের (গতকাল) বৃষ্টিতে অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। সারাদিনে বেশকিছু ছোট বড় দুর্ঘটনাও ঘটেছে। তিনি জানান, এই ফুটপাথের বিপজ্জনক জায়গাগুলোতে তারা কয়েকজন মিলে নিজ উদ্যোগে পাটাতন ও ইট বিছিয়ে দিয়েছেন। ফুটপাথের সাফায়াত কনফেকশনারির মো. হোসাইন বলেন, নির্মাণ সামগ্রী ফুটপাথ ও সড়কের পাশে ফেলে রাখাতে বৃষ্টিতে দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। এতে করে আমাদের ব্যবসারও ক্ষতি হচ্ছে। এই সড়কে চলাচলকারী বেশকিছু গণপরিবহনের চালকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এমনিতে এই সড়কের ফুটপাথের পুনর্নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে যানজট বেড়েছে। গতকালের বৃষ্টিতে যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। দিনের বেশির ভাগ সময়ই ফার্মগেট থেকে পান্থপথ যেতে ১০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময় লেগেছে বলে জানান কয়েকজন চালক। তারা আরো জানান, ফুটপাথের নির্মাণ সামগ্রী মূল সড়কে পড়ে থাকা এবং বৃষ্টির কারণে হাঁটু সমান পানিতে গাড়ি চালাতে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। মিরপুর-১২ থেকে মতিঝিল চলাচলকারী ল্যামস পরিবহনের চালক মো. সোহেল রানা বলেন, ফার্মগেট থেকে পান্থপথ যেতেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টিতে যানজট আরো বেড়েছে। এই ফুটপাথের কাজ যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই তাদের জন্য মঙ্গল বলে জানান তিনি।