ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম’
হায়াৎ অ্যানা কলিন্স ওসামা: আমি বড় হয়েছি আমেরিকার একটি কট্টর খ্রিষ্টান পরিবারে। ওই সময় প্রায় সবাই নিয়ম করে প্রতি রোববার চার্চে যেতো প্রার্থনা করতো। আর আমার পরিবার তখন চার্চ কমিউনিটির সাথে যুক্ত ছিল। তো আমরা এর ব্যতিক্রম হতেই পারি না। অন্য শিশুদের চেয়ে আমাকে আরো বেশি ধার্মিক হতে হবে- ছোটবেলা থেকে এমনটাই আমাকে বোঝানো হয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় অনেক যাজকরাও আসতেন। ঠিক মনে নেই, আমার কোনো এক জন্মদিনে এক আত্মীয় আমাকে একটি বাইবেল উপহার দিলেন আর আমার বোনকে একটি পুতুল দিলেন। আমি প্রায় প্রতিদিনই এটি পড়তাম। তখন আমি জুনিয়র হাইস্কুলে পড়ি। দুই বছরের জন্য আমি একটি বাইবেল স্টাডি প্রোগ্রামে অংশ নিলাম। এই সময় বাইবেলের কয়েকটি অংশ পড়লাম। কিন্তু ভালোভাবে বুঝতে পারলাম না। উদাহারণ হিসেবে একটু বলি, বাইবেলে অরিজিনাল সিন নাম একটি আইডিয়া আছে, যার অর্থ সব মানুষই পাপীষ্ঠ হয়ে জন্ম গ্রহণ করে। তখন মনে হলো, আমার ছোট একটা ভাই আছে। আমি জানি শিশুরা পাপী নয়। এছাড়া বাইবেলের আরো কিছু বিষয় নিয়ে ধন্দে পড়ে গেলা। আমার ভেতর অনেক প্রশ্ন জাগলো। কিন্তু আমি কাউকে ভয়ে প্রশ্ন করতে পারছিলাম না। কারণ সবার কাছে আমি যে, ‘লক্ষ্মী মেয়ে’। আমি কী করে এসব প্রশ্ন তুলি? আলহামদুলিল্লাহ, আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো অন্য একজনের মাধ্যমে পেয়ে যেতাম। মানে ওই প্রোগ্রামে এক ছেলে ছিল সে অনেক প্রশ্ন করত। তার প্রশ্নের কোনো শেষ ছিল না। সে প্রশ্ন করতেই থাকত। কিন্তু সন্তুষ্ট হতো না। আমার অবস্থাও তার মতো ছিল। কোনো উত্তরই পরিস্কার ছিল না।
অবশেষে মিশিগান ইউনিভার্সিটির ধর্মবিষয়ক এক অধ্যাপক ছেলেটিকে পরামর্শ দিলেন, প্রার্থনা করতে। প্রার্থনার মাধ্যমেই বিশ্বাস জন্মাবে। তার কথা আমিও প্রার্থনা করলাম। এভাবে হাইস্কুল পার করলাম। এরপর কলেজে। সেখানে আমি ধর্ম সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মতামত জানলাম। কিন্তু এসবে আমার কোনো উপকার হলো না। ঠিক ওই সময়টায় আমার সাথে লিবিয়ার এক মুসলমান ভাইয়ের সাথে পরিচয় হলো। তিনি আমাকে ইসলাম ধর্ম ও কোরআন শরীফ সম্পর্কে কিছু ধারণা দিলো। তিনি আমাকে বললেন, ইসলাম হলো সবচেয়ে আধুনিক ধর্ম। কিন্তু আমি জানতাম, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য পিছিয়ে পড়া জায়গা। তাছাড়া তিনি যতটা বলছেন, আমার চোখে ইসলাম অতটা আধুনিক ধর্ম নয়। একদিন আমার পরিবার ওই মুসলমান ভাইটিকে ক্রিসমাস চার্চের সার্ভিসে নিয়ে গেলেন। দিনটি চমৎকার ছিল। সার্ভিস শেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের প্রার্থনার এ রীতি কে বানিয়েছে? কে শিখিয়েছে কখন দাঁড়াতে হবে এবং কখন হাঁটু গেরে বসতে হবে? কে-ই বা তোমাদের শিখিয়েছে, কিভাবে প্রার্থনা করতে হবে? তার এতো সব প্রশ্নে আমি যার-পর নাই বিরক্ত হলাম। তারপরও চার্চের ইতিহাস তাকে জানালাম। তাকে তো ইতিহাস জানালাম কিন্তু তার প্রশ্নগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুললো। আসলেই কি এইভাবে প্রার্থনা করতে হয়? তারা কিভাবে জানলেন প্রার্থনার ওই পদ্ধতি? আসলেই কি প্রার্থনার এই রীতি ঐশ্বরিক? আমি খ্রিষ্টান ধর্মের অনেক কিছুই বিশ্বাস করি না। কিন্তু চার্চে সব সময় যেতাম। বেশিরভাগ সময় সেখানে নিজেকে অপরিচিত মনে হতো, মনে হতো ভিনগ্রহের কোনো বাসিন্দা। এরই মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটল। আমার খুব কাছের একজন মানুষ বৈবাহিক সমস্যায় সমস্যায় ভুগছিলেন। সে সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের চার্চের এক সহকারি যাজকের কাছে গেলেন। কিন্তু ওই যাজক সমস্যার সমাধানের বদলে তাকে এক মোটেলে নিয়ে শারিরীক নির্যাতন করল।
এই ঘটনাটি খ্রিষ্টান ধর্মের যাজকদের সম্পর্কে আমার মনোভাব পাল্টে দিলো। যাজকদের ব্যাপারে আমি সচেতন হলাম। এরপরও আমি চার্চে যাওয়া বন্ধ করিনি। কিন্তু কিছু প্রশ্ন আমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিলো- কেন আমি সরাসরি ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে পারব না? কেন একজন মানুষের মাধ্যমেই আমাকে ঈশ্বরের সাথে যোগাযোগ করতে হবে? কেন আমি অন্যের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইব? এই সবের মাঝেই একটি বইয়ের দোকানে আমি কোরআন শরীফের অনুবাদ পেলাম। আমি সেটি কিনে পড়তে শুরু করলাম। ফুরসত পেলেই আমি কোরআন পড়তাম। এভাবে আট বছর আমি কোরআন শরীফের অনুবাদ পড়লাম। পাশাপাশি অন্য ধর্ম সম্পর্কেও পড়াশোনা করলাম। ধীরে ধীরে আমি সচেতন হতে থাকলাম এবং আমার পাপের কথা মনে করে ভয় করতে শুরু করল। কিভাবে আমি বুঝবো, ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করেছেন কিনা? আমি খ্রিষ্টান ধর্মের মতো ‘ক্ষমা করলে, ক্ষমা পাবো’ এই নীতিতে আমার বিশ্বাস ছিল না। আমার পাপের বোঝা আমার উপরই ভারী হচ্ছিল এবং আমি বুঝতে পারছিলাম না, কিভাবে এই বোঝা কমাবো? তবুও আমি ক্ষমা চেয়ে যাচ্ছিলাম।
আমি কোরআনে পড়েছিলাম- (সূরা : আল মায়েদাহ ৮২-৮৪ আয়াত)
৮২.) ঈমানদারদের সাথে শত্রুতার ক্ষেত্রে তুমি ইহুদী ও মুশরিকদের পাবে সবচেয়ে বেশী উগ্র। আর ঈমানদারদের সাথে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নিকটতম পাবে তাদেরকে যারা বলেছিল আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী (খ্রিষ্টান)। এর কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে ইবাদাতকারী আলেম, সংসার বিরাগী দরবেশ পাওয়া যায়, আর তাদের মধ্যে আত্মগরিমা নেই।
৮৩.) যখন তারা এ কালাম শোনে, যা রসূলের ওপর নাযিল হয়েছে, তোমরা দেখতে পাও, সত্যকে চিনতে পারার কারণে তাদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তারা বলে ওঠে, “হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, সাক্ষ্যদাতাদের মধ্যে আমাদের নাম লিখে নাও।”
৮৪.) আর তারা আরো বলে, “আমরা আল্লাহর ওপর ঈমান কেন আনবো না এবং যে সত্য আমাদের কাছে এসেছে তাকে কেন মেনে নেবো না-যখন আমরা এ ইচ্ছা পোষণ করে থাকি যে, আমাদের রব যেন আমাদের সৎ ও সত্যনিষ্ঠ লোকদের অন্তর্ভুক্ত করেন।” এই আয়াতগুলো তেলোয়াত করার পর আমি বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে, ইসলাম ধর্মেই আমি আমার প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবো। আমি টেলিভিশনের খবরে মুসলানদের নামাজ আদায় করতে দেখতাম। এবং জানতাম মুসলমানদের প্রার্থনা করার বিশেষ পদ্ধতি আছে। আমি এক অমুসলিমের লেখা একটি বই পেলাম, যেখানে নামাজ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। আমি সেই নিয়ম অনুযায়ী নামাজ আদায় করতে থাকলাম। জানতাম পুরোপুরি সঠিক হবে না, তবুও পড়তাম। বছরের পর বছর আমি লুকিয়ে নামাজ পড়েছি। অবশেষে আমি কোরআন শরীফ থেকে সূরা আল মায়েদাহের ৩নং আয়াতটি তেলোয়াত করলাম-
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি।” আনন্দে আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে লাগল। কারণ আমি জানতাম, যুগ যুগ আগে, পৃথিবী সৃষ্টিরও আগে পরম করুনাময় আল্লাহ এই কোরআন আমার জন্য লিখেছেন। কারণ আল্লাহ জানতেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের চেকতোয়াগার অ্যানা কলিন্স ১৯৮৬ সালের মে মাসে কোরআনের এই আয়াতটি পড়বে। এখন আমি জানি, আমার অনেক কিছু শেখার আছে। এই যেমন-কিভাবে সহী-শুদ্ধভাবে আমি নামাজ পড়া যায়? সমস্যা হলো আমার সাথে মুসলমান কারো পরিচয় নেই। এখনকার মতো আমেরিকায় আগে এতো মুসলমানের বসবাস ছিল না। তখন আমি জানতাম তা কোথায় তারা থাকেন? আমি ফোনবুকে ইসলামিক সোসাইটির ফোন নাম্বার পেলাম। আমি ফোন করার পর ওপাশ থেকে যখন কেউ কথা বলছে, আমি কোনো কথা বলতে পারতাম না। তারা কি ভাববে এই ভেবে ভয়ে রেখে দিতাম। এরপর কয়েক মাস আমি একটি মসজিদে কয়েকবার ফোন করলাম। একই অবস্থা, আমি ভয়ে কথা বলতে পারতাম না। নামাজের নিয়ম-কানুন জানতে একদিন সাহস করে ওই মসজিদের ঠিকানায় একটি চিঠি লিখলাম। আল্লাহ সহায় হলেন এবং ওই মসজিদ থেকে এক ভাই আমাকে ফোন দিলেন। তাকে বললাম, আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে চাই। তিনি এ কথা শুনে বললেন, ‘অপেক্ষা করুন। যখন পুরোপুরি নিশ্চিত হবেন, তখনই এ সিদ্ধান্ত নিন।’ তার কথা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি এটাও জানতাম, তিনি ভুল বলেননি। কারণ জানি, যদি একবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করি, আমার পুরো জীবন বদলে যাবে। ওদিকে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের প্রতি আমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। রাত-দির ২৪ ঘণ্টা আমি শুধু এই কথাই ভাবতাম। অনেক সময় উৎসবের দিনে আমি মসজিদের চারদিকে চক্কর দিতাম, যদি কোনো মুসলমানকে দেখতে পেতাম। মসজিদের ভেতরটা দেখার জন্য আমার মন ছুঁটে যেতো কিন্তু …।
অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এলো, ১৯৮৬ সালের নভেম্বর মাস। সকালের দিকে আমি রান্না ঘরে কাজ করছিলাম। হঠাৎ কি যেন হলো, আমি ছটফট করতে লাগলাম। সাথে সাথে মসজিদের ওই ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখলাম। কারণ কখনো পর্যন্ত মসজিদে যাওয়ার সাহস আমার ছিল না। পরদিন ওই ভাই আমাকে ফোন দিলেন। আমি কালিমায় শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, এই মুহূর্ত থেকে আপনি সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো পবিত্র। আল্লাহ আপনার সব গুনাহ মাফ করে দিয়েছেন। মনে হলো কাধ থেকে সব পাপের বোঝা পড়ে গেছে। আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। ওই দিন সারারাত আমি ঘুমাতে পারিনি। শুধু কেঁদেছি আর আল্লাহর নাম জপেছি। আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ। অনুবাদ-সাবরিনা সোবহান