নরসুন্দরকে নারী চিকিৎসকের বিয়ে, রুষ্ট পুলিশ
বার্তা ডেক্সঃঃএক প্রাপ্তবয়স্ক নারী চিকিৎসক ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তদন্তে নেমে সেটি জানতেও পেরেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। তবুও ওই চিকিৎসক ও তার স্বামীকে ধরে এনে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য দিয়েছে তারা। সাংবাদিক ডেকে ছবিও তোলা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে রংপুরে। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম রগরগে শিরোনাম দিয়ে এই সংবাদ প্রকাশ করেছে, সমালোচনা হচ্ছে এটারও। ওই নারী যাকে বিয়ে করেছেন, তিনি পেশায় নরসুন্দর (নাপিত)। তার পেশার পরিচয় সামনে এনে বক্তব্য দিয়েছে সিআইডি। বলা হয়েছে, এই দম্পতি ব্যভিচার করেছেন। তাদের দাবি, এই দুই পেশার মানুষের মধ্যে বিয়ে হতে পারে না। আর এই বার্তাই দিতে চাওয়ার কথা জানিয়েছেন রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার (এসপি)।
ওই চিকিৎসকের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আগের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সম্পর্ক তৈরি হয় আরেক জনের সঙ্গে। পরিবারের অমতে বিয়ে করে চলে আসেন ঢাকায়। রোগী দেখে চালান সংসার। একটি সন্তানও হয়েছে। আগের সংসারের সন্তানকেও দেখাশোনা করেন তিনি। এই নারী চিকিৎসকের বাবা মামলা করেছিলেন ‘মেয়েকে অপহরণের’ অভিযোগ এনে। দুই বছর পর তাদের সন্ধান পায় সিআইডি। ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে আটক করে রংপুর নিয়ে গিয়ে ২৩ ডিসেম্বর সংবাদ সম্মেলনে আনা হয় এই দম্পতিকে। সেখানে বড় করে বলা হয় পুরুষটির পেশাগত পরিচয়, যা আপাতদৃষ্টিতে একজন নারী চিকিৎসকের সঙ্গে ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়’। দুই জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়ে করেছেন। এখানে আইনি কোনো ব্যত্যয় হয়নি। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী কেউ যদি আপাতদৃষ্টিতে অপরাধ করেও থাকে, তার পরেও আসামিকে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ছবি তোলার সুযোগ নেই।
২০১২ সালে একজন বিচারককে আটক করে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করার পর হাইকোর্ট এক আদেশে পুলিশকে ভর্ৎসনা করে। এরপর কিছুদিন আসামিদের গণমাধ্যমের সামনে এনে ছবি তোলার প্রবণতা বন্ধ হয়, গত ২৩ ডিসেম্বর রংপুর সিআইডি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের ডেকে এনে পুলিশ ওই দম্পতি ও তাদের সন্তানকে সামনে নিয়ে আসে। বক্তব্য ছিল, নরসুন্দর প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার ২১ মাস পর সন্তানসহ ওই গাইনি চিকিৎসককে উদ্ধার করেছেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে নারী চিকিৎসক স্পষ্টতই বলেন, তিনি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করে সুখী আছেন। তাকে কেউ অপহরণ করেনি।
রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস বলেছেন, ‘পুলিশ চেষ্টা করেও তার (বাদী) মেয়েকে উদ্ধার করতে পারেনি। পরে মামলাটি তদন্তের জন্য সিআইডির কাছে দেয়া হয়।… সিআইডি অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে যে, বাদীর মেয়ে অপহৃত হয়নি বরং তিনি নিজের ইচ্ছায় ঢাকায় এসে বিয়ে করেছেন। তাদের একটি সন্তান রয়েছে। তবে মেয়েটির আগে এক বার বিয়ে হয় সেখানেও আট বছরের একটি সন্তান আছে।’
তাহলে এখানে অপরাধটা কী হলো, আর এই দম্পতিকে গণমাধ্যমের সামনে এনে হেনস্থা কেন করলেন?- এমন প্রশ্ন ছিল সিআইডির রংপুরের এসপির কাছে। জবাবে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, আইনের লঙ্ঘন না হলেও এতে নীতির লঙ্ঘন হয়েছে বলে তার বিশ্বাস।
-কোন নীতির লঙ্ঘন হয়েছে?
জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘তারা অপরাধ করেছে, ব্যভিচার করেছে।’
-কীভাবে ব্যভিচার হলো?
সিআইডির পুলিশ সুপার বলেন, ‘আপনি আগে আইন বোঝেন। মনে করেন, আমার ওয়াইফ বাচ্চাসহ আপনার কাছে চলে গেল। এটা সে করতে পারে না। আইনে এটা নিষেধ আছে। ব্যভিচার করেছে সে। যদি সে মেয়ে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যায় তাইলে এটা ঠিক আছে।’ কিন্তু ওই নারী তো তার স্বামীকে আগেই তালাক দিয়েছিলেন, তাহলে এমন কথা কেন- এই প্রশ্ন অবশ্য সিআইডি কর্মকর্তার কাছে আগেই রাখা ছিল, যেটার কোনো জবাব তিনি দেননিদণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় ব্যাভিচারের সংজ্ঞা ও শাস্তির উল্লেখ আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘কোনো পুরুষ যদি জেনেশুনে কোনো বিবাহিত নারীর সঙ্গে তার স্বামীর সম্মতি না নিয়ে বা তার অজান্তে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হন, এবং অনুরূপ যৌন সঙ্গম যদি ধর্ষণ না হয় তাহলে তা ব্যভিচারের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং শাস্তিস্বরূপ সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা কিংবা উভয়ই প্রযোজ্য হতে পারে। এক্ষেত্রে ওই বিবাহিত স্ত্রী অপরাধের সহযোগী রূপে কোনো শাস্তি পাবে না।
সিআইডি সংবাদ সম্মেলন করার পর পুলিশ এই দম্পতিকে আদালতে তুলে। বিচারক তাদেরকে ছেড়ে দেন।
‘নাপিতের সঙ্গে ডাক্তারের বিয়ে নৈতিক অপরাধ’
কোন বিবেচনায় এই দম্পতিকে গণমাধ্যমের সামনে এনে ছবি তোলানো হলো?- এমন প্রশ্নে সিআইডির সুপার বলেন, ‘তার আগে একটা বাচ্চা ছিল; সাত-আট বছর বয়স। সেই বাচ্চাসহ তিনি চলে গেছেন। আর এক জন লোকের বাচ্চা নিয়ে গেছেন। যদি আপনার বাচ্চা নিয়ে যেতেন তবে আপনি কি অপহরণ মামলা দিতেন না? আপনি যখন মামলা দেবেন তখন আমার দায়িত্ব বাচ্চা খুঁজে বের করার। সেই বাচ্চার বৈধ মালিক তো মা না, আগের ওই স্বামী।’ সিআইডি কর্মকর্তা এই দাবি করলেও ওই নারী চিকিৎসকের আগের স্বামী মামলা করেননি, তার সন্তানকে কাছে রাখার দাবি করে আদালতেও যাননি। এরপর সিআইডি কর্মকর্তা টানেন নারী চিকিৎসকের স্বামীর পেশাগত পরিচয়। তার দাবি, এক জন নাপিতের সঙ্গে এক জন চিকিৎসকের বিয়ে হওয়া উচিত না।
তিনি বলেন, ‘তিনি (নারী চিকিৎসক) একে তো আইনগত অপরাধ করেছেন (যদিও কোন আইনে অপরাধ তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি)। তারপর নৈতিক অপরাধ করেছেন। তিনি এক জন ডাক্তার। তিনি যার সঙ্গে চলে গিয়েছেন, তার সঙ্গে তার যাওয়া মানায় না। ‘তিনি ডাক্তার সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। এক জনের আট বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ভেগে গেছেন। সেই বাচ্চার সঙ্গে বাবার কোনো যোগাযোগ করতে দেননি। একদম গায়েব হয়ে গেছেন। এইগুলো তো অপরাধ। ‘এইগুলা নৈতিক অপরাধ। এটা বিচারাধীন বিষয়, তবে তাতে সমস্যা নেই। আমরা মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করি। আর আমরা যদি এই তথ্য প্রকাশ না করি তবে সমস্যা হবে। সমাজের তো বোধোদয় হতে হবে। এমন বোধোদয় আমাদের হওয়া উচিত।’
সেই সংবাদ সম্মেলনে সচেতনতা তৈরি হবে দাবি করে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এই উদাহরণগুলো কেন দেই? যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। তিনি এক জন ডাক্তার। তাকে কি এমন কারও সঙ্গে চলে যেতে হবে? তার কাছে কি আর কোনো রাস্তা ছিল না? আমরা এটা জানান দিতে চেয়েছি।’
আদালতের আদেশের লঙ্ঘন