নারায়ণগঞ্জে গণধর্ষণ শেষে খুনের ৫০ দিন পর স্কুলছাত্রী জীবিত
জিসা মনি (১৪)। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রেমিক সহ তিনজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে- তারা জিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দিয়েছে। জবানবন্দি রেকর্ডের পর আদালত তিনজনকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বর্তমানে তারা কারান্তরীণ। কিন্তু ৫০ দিন পর জিসা মনি নিজেই নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় হাজির হয়। তোলপাড় শুরু হয় প্রশাসনে। মুহূর্তে তদন্তকারী কর্মকর্তা সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উপর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের মামলা তদন্ত আদালতে দেয়া জবানবন্দি নিয়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সদর মডেল থানায় ছুটে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান। সোমবার দুপুরে তিনি গণমাধ্যমকে ব্রিফিং করেন। পরে ঘটনা তদন্তে জেলা পুলিশ সুপার জাহেদুল আলম তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এদিকে ৫০ দিন পর মেয়েকে জীবিত পেয়ে খুশিতে আত্মহারা জিসার মা-বাবা। অন্যদিকে কারাবন্দি নিরপরাধ তিন ব্যক্তির স্বজনরা অভিযোগ করেছেন পুলিশ টাকা নেয়ার পর অমানুষিক নির্যাতন করে তাদের হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছে। তারা এর জন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে জিসা মনি। সে স্থানীয় সরকারি প্রাইমারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। গত ৪ঠা জুলাই থেকে সে নিখোঁজ হয়। মেয়েকে খোঁজাখুঁজি করে কোথাও না পেয়ে এক মাস পর ৬ই আগস্ট বাবা জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন। মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, এলাকার যুবক আব্দুল্লাহ তার মেয়েকে স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বিভিন্ন সময় প্রেমের প্রস্তাব দিতো। এতে বাধা দিলে মেয়েকে অপহরণের হুমকি দেয়। গত ৪ঠা জুলাই সন্ধ্যায় আব্দুল্লাহ ফোনে ঠিকানা দিলে তার মেয়ে সেই ঠিকানায় যায়। পরে তাকে গাড়িতে করে অপহরণ করে আব্দুল্লাহ ও তার সহযোগীরা। এমন সন্দিহানের পর থেকেই তার মেয়ের কোনো সন্ধান পাননি তার পরিবার। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই শামীম জানিয়েছেন, মেয়েটির মায়ের মোবাইলের কললিস্ট চেক করে রকিবের সন্ধান পায় পুলিশ। রকিবের মোবাইল নম্বর দিয়ে আব্দুল্লাহ কিশোরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতো। ঘটনার দিনও ওই নম্বর দিয়ে কল করে আব্দুল্লাহ। এ ঘটনায় ৭ই আগস্ট আব্দুল্লাহ (২২), রকিব (১৯) ও নৌকার মাঝি খলিল (৩৬)কে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
৯ই আগস্ট দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন হোসেন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহমেদ হুমায়ুন কবিরের পৃথক আদালতে গ্রেপ্তারকৃত তিনজনকে জবানবন্দি দেয়ার জন্য হাজির করে পুলিশ। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনজন বলে জিসাকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এদিকে ২৩শে আগস্ট রোববার দুপুর আড়াইটার সময় বন্দরের নবীগঞ্জ রেললাইন এলাকার একটি মোবাইল ফোনের দোকান থেকে জিসা মনি তার মা রেখা আক্তারকে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে, ভালো আছে। তবে কিছু টাকার প্রয়োজন। এমন কথায় টাকা পাঠিয়ে উল্লিখিত এলাকায় দোকানটিতে ছুটে যান জিসার মা-বাবা। এ ছাড়াও এ অবিশ্বাস্য ঘটনায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এসআই শামীম আল মামুনকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর তার বাবা-মা ছুটে যান বন্দর থানাধীন নবীগঞ্জ এলাকার সেই মোবাইল ফোনের দোকানটিতে। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মেয়েকে চোখের সামনে দেখে বুকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। জিসার বাবা জাহাঙ্গীর আলম জানান, পুলিশ বলেছিল আমার মেয়েকে ধর্ষণের পর নদীতে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নির্দোষ ৩ জনকে আটক করেছে তারা। এদিকে একটি সূত্র জানায়, বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় ইকবাল ওরফে ইব্রাহিম নামে এক ছেলের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গত দেড় মাস ধরে এক সঙ্গে বসবাস করেছে জিসা। পুলিশ ইকবালকে আটক করেছে। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শামীম আল মামুন বলেন, ইকবাল ও জিসা একে অপরের পরিচিত ছিল। গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছিল। রোববার জিসা মনির সন্ধান পাওয়া যায় সে ইকবাল নামে এক যুবকের সঙ্গে ছিল। পুলিশ ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।
যদিও এর আগে মামলার তদন্তকারী অফিসার শামীম আল মামুন অভিযুক্তদের জবানবন্দি প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, নারায়ণগঞ্জ শহরের দেওভোগ পাক্কা রোড এলাকার গার্মেন্ট শ্রমিক জাহাঙ্গীরের ছোট মেয়ে জিসার সঙ্গে বখাটে আবদুল্লাহ তার বন্ধু ইজিবাইকচালক রকিবের মোবাইল দিয়ে ৩ মাস প্রেম করেছে। ঘটনার দিন ৪ঠা জুলাই ঘোরাফেরার কথা বলে তাকে ইস্পাহানি ঘাটে ডেকে নেয় আবদুল্লাহ। এরপর বন্দরের বিভিন্ন স্থানে রকিবের ইজিবাইক দিয়ে ঘোরাফেরা করে। পরে রাত ৮টায় ইস্পাহানি ঘাটে এসে খলিলুর রহমানের নৌকায় উঠে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঘুরতে থাকে। এক পর্যায়ে নৌকার মধ্যেই আবদুল্লাহ প্রথমে জিসাকে ধর্ষণ করে। এরপর মাঝি খলিলুর রহমানও জোর করে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। এতে কিশোরী বাকবিতণ্ডা করলে ক্ষিপ্ত হয়ে খলিলুর রহমান সেই কিশোরীর দুই পা চেপে ধরে আর আবদুল্লাহ গলাটিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তারপর দুইজনে মিলে সেই ৫ম শ্রেণির স্কুলছাত্রী কিশোরীকে শীতলক্ষ্যা নদীর মাঝখানে ফেলে দেয়।
পুলিশের বক্তব্য
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, নিখোঁজ অভিযোগ পাবার পর আমরা জিসা মনির সঙ্গে যার কথা হয়েছে সেই কললিস্ট চেক করি। সেখানে আব্দুল্লাহ নামের একজনের নাম আসে। পরবর্তীতে জিসা মনির বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করে আব্দুল্লাহকে এবং দ্বিতীয় আসামি করে রকিবকে। সে অনুযায়ী আমরা তাদের গ্রেপ্তার করি। পরে তারা বিজ্ঞ আদালতে জবানবন্দি দেয়, তারা একটি মেয়েকে নৌকাতে ঘুরিয়ে ধর্ষণ করে নদীতে ফেলে দেয়। তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে জিসা মনি উদ্ধারের পর আমরা জানতে পারি, আসলে তাকে ধর্ষণ করা হয়নি। ৪ঠা জুলাই সে আব্দুল্লাহকে ফোন করে এবং আব্দুল্লাহ তাকে শহরের একটি বাজারে আসতে বলে। কথা অনুযায়ী জিসা মনি বাজারে যায় এবং একটি চিপস খেতে চায়। আব্দুল্লাহ চিপস আনতে গিয়ে আর ফিরে আসে না। ফলে জিসা মনি তার সাবেক প্রেমিক ইজিবাইক চালক ইকবালকে ফোনে তাকে নিয়ে যেতে বলে। ইকবাল এসে জিসা মনিকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী তার ভাইয়ের বাসায় যায়। জিসা মনি সেখানে থাকতে না চাওয়ায় তারা নারায়ণগঞ্জ গোগনগর এলাকায় ইকবালের খালাতো ভাই সুজনের বাসায় যায় এবং রাতযাপন করে। পরবর্তীতে সেখান থেকে বন্দরের কুশিয়ারা এলাকায় বাসা ভাড়া নেয় এবং জিসা মনিকে বিয়ে করে সেখানে ১ মাস ২০ দিন অবস্থান করে। রোববার দুপুরে ইকবাল বাড়ি ফিরে দেখে তার স্ত্রীর মন খারাপ। জিসা মনি জানায়, তার বাবা-মা’র জন্য তার মন খারাপ। পরে ইকবাল জিসা মনির পরিবারের কাছে ফোন দেয় আর বলে, জিসা মনির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে এবং তারা ভালো আছে। এ সময় জিসা মনি তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে এবং বিকালে ৪ হাজার টাকা পাঠাতে বলে। পরে জিসা মনির মা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তদন্তকারী কর্মকর্তা শামীম তাকে নিয়ে জিসা মনিকে উদ্ধার করে। পুলিশি নির্যাতনের মুখে আসামিরা ধর্ষণ ও হত্যার স্বীকারোক্তি দিয়েছে আসামির স্বজনদের এমন অভিযোগের জবাবে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এখন ওই মেয়ে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে ফিরে এসেছে। বলছে, এক ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনায় তদন্ত চলছে। যদি পুলিশের দায়িত্ব অবহেলা পাওয়া যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসামির স্বজনদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
কারাবন্দি তিন আসামির স্বজনদের অভিযোগ
এদিকে মিথ্যা ঘটনায় কারাবন্দি তিন আসামির স্বজনরা বলছেন, পুলিশি হেফাজতে অমানুষিক নির্যাতনের মুখে তারা ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। পুলিশ এই ঘটনা সাজিয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শামীম আল মামুন আসামির স্বজনদের কাছ থেকে অবৈধ উপায়ে কয়েক হাজার টাকা নিয়েছেন বলেও রয়েছে অভিযোগ।