পীর হাবিবের কলামঃ জাফর ইকবাল শঙ্কামুক্ত, রাষ্ট্র শঙ্কামুক্ত নয়
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হামলার নেপথ্যে আর কারা জড়িত তা তন্নতন্ন করে খতিয়ে দেখছে। জাফর ইকবাল শিগগির হাসপাতাল থেকে মুক্ত হয়ে তার প্রিয় ক্যাম্পাসে প্রিয় সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ফিরে যাবেন। তার ওপর হামলার ঘটনায় গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন। জাফর ইকবাল এমন হামলার প্রথম শিকার হননি। এর আগে প্রথাবিরোধী লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তচিন্তার শিক্ষক ড. হুমায়ুন আজাদ একুশে বইমেলা থেকে ঘরে ফেরার পথে গুপ্ত ঘাতকের চাপাতির কোপে রক্তাক্ত হয়ে সাময়িক সুস্থ হলেও শেষ রক্ষা পাননি। ঘাতকদের ইচ্ছাই পূর্ণ হয়েছে। অকালে তিনি চলে গেছেন। গুপ্ত ঘাতকদের হাতে একে একে অনেক তরুণ ব্লগার অভিজিৎ থেকে দীপন অনেকেই চাপাতির কোপে নিহত হয়েছেন। গুপ্ত ঘাতকরা ধরা পড়েনি। জাফর ইকবালের হামলাকারী অন্ধকারে ওত পেতে থাকা গুপ্ত ঘাতক ছিল এমনটি বলা যায় না। যেভাবে সে একা ছুরি নিয়ে জনারণ্যে জাফর ইকবালের পেছনে অনেকের মাঝে দাঁড়িয়ে কাঁধে গরম নিঃশ্বাস ফেলেছে, হিংস্র আক্রোশে ফুঁসেছে তাতে তাকে আত্মঘাতী বলা যায়। গ্রামের মাদ্রাসা পড়া ফয়জুর কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিল এমন তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। তবে জঙ্গিবাদে দীক্ষিত হয়ে সে যে বিজ্ঞানমনস্ক মুক্তচিন্তার আলোকিত মানুষ ও লেখক জাফর ইকবালকে মনেপ্রাণে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ফয়জুর র্যাবকে বলেছে, ‘ভূতের বাচ্চা সুলায়মান’ নামে একটা বই লেখার জন্য সে জাফর ইকবালের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। সে শুনেছে বইয়ে ধর্ম অবমাননা করে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। তবে বইটি সে পড়েনি। ফয়জুর আরও বলেছে, জাফর ইকবাল নিজে নাস্তিক্যবাদের চর্চাই শুধু করছেন না, তিনি নাস্তিক্যবাদ ছড়াচ্ছেন। তাই তাকে খুন করা জায়েজ। ফয়জুর মাদ্রাসা থেকে এসএসসি সমমানের লেখাপড়া করলেও নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারেনি। জাফর ইকবাল বা তার বই সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েও মাথার ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া ধর্মান্ধতা আলোকিত একজন মানুষের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী হামলা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফয়জুর ছিল একমাত্র বহিরাগত ঘাতক। জাফর ইকবাল ছিলেন মুক্ত আলোয় মুক্ত মঞ্চের অনুষ্ঠানে দর্শকসারিতে বসা। তার আশপাশে শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী, পুলিশ সবই ছিল। এর মধ্যেই ফয়জুর রক্ত ঝরিয়েছে। জীবনপ্রদীপটি কেড়ে নিতে পারেনি। আজ সারা দুনিয়ায় অশুভ সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শুভশক্তির লড়াই চলছে। শিক্ষা, সভ্যতা, প্রযুক্তিতে অগ্রসর উন্নত দেশগুলোয়ও সন্ত্রাসবাদ রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নত দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসবাদী ঘাতকরা। তাদের বোমা হামলায় রক্তাক্ত হচ্ছে মানবসভ্যতা। বাংলাদেশে আজকের বাস্তবতায় সরকার বা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ বা অশান্ত করার চেয়েও শুভশক্তির বিরুদ্ধে অশুভ শক্তির হিংস্র প্রতিহিংসার পাশবিক আক্রোশে হত্যার নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠছে ঘাতকরা। গুলশান ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপট একরকম, জাফর ইকবালদের ওপর আক্রমণের প্রেক্ষাপট আরেক রকম। গোটা সমাজে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ ঘিরে আবর্তিত রাজনীতির বিষাক্ত বাতাস যেমন স্পর্শ করেছে, তেমনি আদর্শহীন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধহীন ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের সামনে তারুণ্যের চোখেমুখে যেন কোনো স্বপ্ন নেই। গোটা সমাজের সুবিধাভোগী অংশ রাতারাতি অগাধ বিত্তবৈভব গড়ে ভোগবিলাসের পথে হাঁটছে। ক্ষমতানির্ভর এই অংশটি যেনতেন উপায়ে সম্পদ চায়, বিলাসী জীবন চায়। সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠী আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও সচ্ছল জীবনের আনন্দ ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক শক্তি আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে যখন যারা ক্ষমতায় আসছে আদর্শহীন পথে হাঁটছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আবেগ-অনুভূতি লালনে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সমাজের বাহির ও ভিতর দুই নয়নে দেখার জায়গা থেকে সব মহলই কমবেশি ব্যর্থ হচ্ছে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সব মত-পথের মানুষ থাকবে। একটি আদর্শিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা থেকে বাহাস হবে, যুক্তির লড়াই হবে। চাপাতির আঘাত, বোমাসন্ত্রাস, হত্যার অশুভ, অমানবিক, অসাংবিধানিক, বেআইনি পথ হতে পারে না। আজকের অসহিষ্ণু অস্থির অশান্ত সমাজে সাংবিধানিকভাবে জনগণ ক্ষমতার মালিক সেটি যেমন উপেক্ষিত হচ্ছে, তেমনি সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশে ধর্মবর্ণনির্বিশেষে নারী-পুরুষ সব নাগরিক যেমন সমঅধিকার ভোগ করবে, সেটিও দেখা যাচ্ছে না। এতে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ, অসন্তোষ যেমন বাড়ছে, তেমনি একটি ধর্মান্ধ, অশুভ শক্তি তাদের জান্নাতের লোভনীয় পথ দেখিয়ে ধর্মান্ধই করছে না, জঙ্গিবাদের পথে টানছে। দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষের বিরুদ্ধে। ধর্মীয় উন্মাদনা ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিকে ব্ল্যাকমেইল করে তাদের হাতে সহজে তুলে দিচ্ছে বোমা, চাপাতি। সমাজে এই ধর্মান্ধ অশুভ শক্তি যে অস্থিরতা তৈরি করছে তা নয়। মতলববাজ, ফ্যাশনেবল একদল তথাকথিত অর্ধশিক্ষিত মানুষের ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে। জাফর ইকবাল কারও ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করেননি। একজন বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষক হিসেবে প্রজন্মকে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আদর্শিক মূল্যবোধের আলোর পথে নৈতিক চরিত্র নিয়ে সুশিক্ষায় মানুষ হওয়ার পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে পাঠ করতে না পারা, তার বই না পড়া, একজন ফয়জুরের মাথায় অশুভ শক্তি ধর্মীয় অনুভূতি থেকে যে বিষক্রিয়া ঢুকিয়েছিল, সেখান থেকে সে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বোকার মতো হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করেছে। তাকে শেখানো হয়েছে, এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে ফয়জুর ফাঁসিতে ঝুললেও জান্নাতের দরজা তার জন্য শহীদি মর্যাদায় খোলা রাখা হয়েছে। সমাজের অগ্রসর নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক শক্তি অনগ্রসর অর্থনৈতিক সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ধর্মান্ধ শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষায় কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়ে যখন কওমি মাদ্রাসার আলেম বা হেফাজত নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখন আমরাই সমালোচনার তীর ছুড়ি। বলা হয়, হেফাজতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সরকার ধর্মান্ধ শক্তিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। কিন্তু নাক ছিটকিয়ে পথ হাঁটা প্রগতিশীলরা কখনই চিন্তা করে না সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে আলোর পথে টেনে না আনলে তারা অন্ধকারে পড়ে থাকবে। কারণ এরা দেশের জনগোষ্ঠী। তাদের মূলধারায়, আদর্শিক ধারায় সংযুক্ত রাখতেই হবে। ধর্মান্ধ শক্তি তাদের জঙ্গিবাদের পথে ধর্মীয় আবেগের স্রোতে যা খুশি তা বুঝিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসন, সব আমলেই গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে, রাস্তার আশপাশে, যেখানে-সেখানে, অপরিকল্পিতভাবে মাদ্রাসা গজিয়েছে ইচ্ছামতো। মাদ্রাসা শিক্ষা কী ধরনের, মাদ্রাসার অভ্যন্তরে কী চলছে সেই খবর আমাদের রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিরা কখনো না রাখলেও উন্নয়ন বরাদ্দে কখনো কার্পণ্য করেননি। রাজনৈতিক শক্তি থেকে সিভিল সোসাইটি সবখানেই শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করছে সবাই। ভুল বিবেচনাবোধ সবার মধ্যেই কমবেশি কাজ করে। পাঞ্জাবি-পায়জামা মাথায় টুপি থাকলেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বা প্রতিক্রিয়াশীল যারা মনে করেন তারা নিজেদের স্বউদ্যোগে আমজনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখেন।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ও ভবনের নামকরণ ইস্যু থেকে সর্বশেষ সাবেক ভিসিবিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত জাফর ইকবাল ছাত্রলীগকেই প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। সেই নামকরণ ইস্যুতে সিলেট যখন অগ্নিগর্ভ, তখন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে জাফর ইকবাল ছাত্রলীগকে নিয়ে হামলার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু এবার তার ওপর সংঘটিত ঘাতকের আক্রমণ থেকে জীবন ফিরে পেয়ে জেনেছেন, তিনি শত্রু চিনতে ভুল করলেও অশুভ অন্ধকার শক্তি তাকে চিনতে ভুল করেনি। ছাত্রলীগ নয়, অজপাড়াগাঁয়ে একটি মাদ্রাসায় কিছু দূর পড়ালেখা করা এক ধর্মান্ধ যুবক তাকে খুন করতে এসেছিল। আর জাফর ইকবালের পাশে ছাত্রলীগসহ সব প্রগতিশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মুক্তচিন্তার পক্ষের শক্তি দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদমুখর হয়েছে। কিছু দিন আগে বিএনপির রাজনীতি ও তারেক রহমানের ভুলভ্রান্তি নিয়ে কলাম লেখায় বিএনপির একটি অন্ধ শক্তির আক্রোশের মুখে পড়েছিলাম। এবার হাসপাতালে থাকা অবস্থায় যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভক্ত-স্বজনরা আরোগ্য কামনা করে মন্তব্য করছিলেন, তখন তাদের ভালোবাসার পাশে কেউ কেউ মৃত্যুও কামনা করেছেন। মৃত্যু হলে মেজবান দেবেন এমন প্রত্যাশাও জানিয়েছেন। যারা এভাবে মৃত্যু চাইতে পারে তারা গণতান্ত্রিক শক্তির অংশ হতে পারে না। এরা হিংস্র অশুভ শক্তি। আজকে জাফর ইকবালকে নিয়ে যখন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতান্ত্রিক শক্তি, মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষেরা সহানুভূতিশীল, ব্যথিত ও প্রতিবাদমুখর তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই দেখা যাচ্ছে কারও কারও তৃপ্তির ঢেঁকুর, কেউ কেউ ফয়জুরের মতো জঙ্গি তৈরির জন্য জাফর ইকবালদেরই দায়ী করছেন।
এতটাই নির্দয়, নিষ্ঠুর এ ধরনের বর্বরোচিত হামলার বিচার চাইবে কি, প্রতিবাদ, নিন্দা ও ঘৃণা জানাবে কি, যেন উল্লাস করছে। আমরা যেন দিন দিন আবেগ-অনুভূতিহীন, এক কথায় বোধহীন সমাজের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি। আমাদের বিবেক যেন রুদ্ধ। আমাদের এক চোখ যেন বন্ধ। আমাদের চিন্তার জায়গা যেন সংকুচিত। দিন দিন আমরা যেন প্রতিবন্ধী হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কেন? সেদিন আমাদের যোগাযোগ বিপ্লব ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেনি। গণমাধ্যমের দশ দিগন্ত উন্মোচিত হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটেনি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, আধুনিকতা, শিক্ষায়, অর্থনীতিতে সমাজ এতটা অগ্রসর হয়নি। পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক শাসন ও সমাজব্যবস্থার মধ্য থেকে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গোটা জাতি দীর্ঘ সংগ্রামের পথ হেঁটে এক মোহনায় মিলিত হয়েছে। সেদিনের ধনিক সামন্ত গোষ্ঠী পাকিস্তানের পক্ষে ধর্মের দোহাই দিয়েছে। কিন্তু জনগণ পশ্চাৎপদ সমাজব্যবস্থায় বাস করেও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর মানবতার লড়াইয়ে ঝাঁপ দিয়েছে।
সেদিনের রাজনীতিবিদ রাজনীতি, সমাজ ও মানুষ, আদর্শ ও মূল্যবোধের পথে ছিল অবিচল। বিশ্বরাজনীতিতে অনেক ভাঙাগড়া পরিবর্তন যেমন ঘটেছে, তেমনি এ উপমহাদেশেই নয়, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেও অনেক উলট-পালট ঘটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাঙ্গন ঘিরে আদর্শিক ছাত্র রাজনীতির গৌরবের উত্তরাধিকারিত্ব হোঁচট খাওয়ায় তারুণ্যের শক্তি আদর্শিক জায়গায় সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ নয়। গণরাজনীতিতেও আদর্শিক নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের নির্লোভ গণমুখী রাজনীতি নির্বাসিত। রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও জনগণের মধ্যে আস্থা-বিশ্বাসের সম্পর্ক শিথিল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর দুয়ারে পৌঁছতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ আমরা যেমন ইতিহাসে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে হারিয়েছি, তেমনি আমাদের মুুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন হাতছাড়া হয়েছে। সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশে লড়াই-সংগ্রাম ও মানুষের আত্মদানের বিনিময়ে গণতন্ত্রমুক্ত হলেও আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিকশিত সমাজ ও শাসনব্যবস্থা পাইনি। সৌহার্দ্যপূর্ণ, পরমতসহিষ্ণু, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মৃত্যু ঘটেছে। এক দল আরেক দলকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিযোগিতা সমাজে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে হতাশা ও ক্ষোভই তৈরি করেনি, বিভক্তি, আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট গভীর করেছে।
ধর্মান্ধ শক্তি যেমন মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষাব্যবস্থাকে ধর্মের শত্রু হিসেবে দাঁড় করাতে চাইছে, সেখানে রাজনৈতিক শক্তি ও মুক্তচিন্তার নাগরিক সমাজেও ধর্মান্ধ শক্তির অপপ্রচার থেকে নিরীহ সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আস্থায় এনে জনমত শক্তিশালী করতে পারছে না। জাতীয় রাজনীতি থেকে শিক্ষাঙ্গনকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতিই নয়, তৃণমূলের গণরাজনীতিকেও সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের আদর্শিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। না হয় অগ্রসর সমাজ থেকে সুবিধাবঞ্চিত, পশ্চাৎপদ অনগ্রসর সমাজের সঙ্গে বিভক্তির ক্ষত যন্ত্রণাময় হবে। এ ক্ষত কাজে লাগিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষায় পাঠ নেওয়া তরুণদের জান্নাতের লোভ দেখিয়ে জঙ্গিবাদের পথে টানবে ধর্মান্ধ শক্তি। যেটি আমাদের জন্য শুভকর হবে না। বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে উত্থান ঘটেছে, তা ধর্মীয় উসকানিতে গরুর চেয়ে মানুষের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বাম ফ্রন্টের পতন হলেও ধর্মনিরপেক্ষ তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ত্রিপুরায় মানিক সরকারের বামপন্থিরা পরাজিতই হননি, মঞ্চে বিজেপির আরোহণ ঘটেছে। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের চেতনার উত্তরাধিকারী রাজনৈতিক শক্তি এখনো ক্ষমতার অনেক দূরে। আমরা সৌভাগ্যবান এখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ব্যালট বিপ্লবে ধর্মান্ধ উগ্রপন্থি ইসলামী শক্তি ক্ষমতায় আসতে পারেনি। কিন্তু সুমহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে মানুষের অধিকার খর্ব করে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনব্যবস্থা নির্বাসনে রেখে, ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর মতবাদকে প্রশাসনিক শক্তির জোরে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে না। গণতন্ত্রে সব মত-পথের শত ফুল ফুটতে দিতে হবে। তেমনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক জায়গার বাইরে রাজনীতি করার পরিণতি যেমন হবে আত্মঘাতী তেমনি জনগণের আস্থা অর্জনের পথ পরিহার করা, একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া রাষ্ট্রের জন্য শুভ নয়। একজন জাফর ইকবাল শঙ্কামুক্ত হলেও রাষ্ট্র এখনো শঙ্কামুক্ত নয়।
আজ একজন জাফর ইকবালের ওপর আক্রমণ এসেছে, কাল ১০ জনের ওপর আসবে। শুভশক্তি হত্যায় বিশ্বাসী নয়, অশুভ শক্তি চাপাতি বোমার হিংস্রতায় ফোঁসে। এই শক্তির বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের সুবিধাবঞ্চিত জনগণকে সঙ্গে নেওয়ার কাজ রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই করতে হবে। দমন-পীড়ন দিয়ে সাময়িকভাবে প্রশমিত করা যায়, আদর্শিক রাজনীতি দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করলে দীর্ঘমেয়াদি ফল পাওয়া যায়। জনগণের শক্তির চেয়ে বড় কোনো শক্তি নেই। রাজনৈতিক শক্তি জনগণের শক্তিকে সংগঠিত করার চ্যালেঞ্জ নিতে পারে।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডট নিউজ।. সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন