প্রধান বিচারপতি সিনহার দেশে ফেরা নিয়ে ধূম্রজাল
কবির হোসেন-
প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে দফায়-দফায় বৈঠক করেও উদ্ভূত পরিস্থিতির কোনো সমঝোতা হয়নি। তবে এখনো বৈঠক চলছে বলে জানা গেছে। এ অবস্থায় তার দেশে ফেরা না-ফেরা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে আজ ১০ নভেম্বর তার ছুটি শেষ হচ্ছে। কিন্তু ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য গতকাল পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে তিনি কোনো দরখাস্ত দেননি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা (অ্যাটর্নি জেনারেল) মাহবুবে আলম বলেন, ‘আমার কথা হচ্ছে ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন তিনি দেন আর না দেন, তাতে কিছুই যায় আসে না। প্রধান বিচারপতি এখন বিচার বিভাগের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এখন আর এগুলোর (ছুটি বৃদ্ধির আবেদনের) কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি আরও বলেন, প্রধান বিচারপতির প্রধান কাজ হচ্ছে বিচারকার্য পরিচালনা করা। কিন্তু আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা তার সঙ্গে বসে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন না বলে জানিয়েছেন। এ অবস্থায় তিনি দেশে ফিরলেও কী করবেন?’
এদিকে ছুটির মেয়াদ আজ শেষ হলেও তা বৃদ্ধিতে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন কোনো আবেদন গতকাল পর্যন্ত আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়নি। এ ব্যাপারে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের স্পেশাল অফিসার ব্যারিস্টার মো. সাইফুর রহমান বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো আবেদন এখনো পর্যন্ত আমরা হাতে পায়নি।’ প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে ফেরারও কোনো প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে না। সুপ্রিমকোর্টের একটি সূত্র জানায়, অন্য সময় প্রধান বিচারপতির ছুটি শেষ হওয়ার এক থেকে দুদিন আগে আপিল বিভাগের কোর্ট অফিসার প্রটোকলের জন্য এয়ারপোর্টে চিঠি পাঠিয়ে থাকেন। কিন্তু এবার এখনো পর্যন্ত প্রটোকলের ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বা প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকেও প্রটোকলের ব্যবস্থা করার জন্য বলা হয়নি বলে সূত্র জানিয়েছে। সিঙ্গাপুরের একটি সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতি দেশে ফিরতে চান। তিনি একটি ফ্লাইটে টিকিটও কেটে রেখেছেন। তবে কবে ফিরবেন তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
গত ১ আগস্ট উচ্চ আদালতের বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে করা ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রকাশ হয়। রায়ে প্রধান বিচারপতির বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছিলেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা। তারা প্রধান বিচারপতির পদত্যাগের দাবিও তোলেন। এরই মধ্যে ২ অক্টোবর হঠাৎ করেই এক মাসের ছুটিতে যান প্রধান বিচারপতি। তিনি আবেদনে ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ছুটিতে যাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রপতিকে। পরে ৪ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি অসুস্থ, এটা নিয়ে রাজনীতির কিছু নেই। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রধান বিচারপতির সুস্থতার জন্য দোয়া করি।’
এর পর ১০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির ছুটির মেয়াদ বৃদ্ধি করতে একটি চিঠি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। চিঠিতে বলা হয়, আগামী ১৩ অক্টোবর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে ঢাকা ত্যাগ করবেন প্রধান বিচারপতি। ১০ নভেম্বর অথবা এর নিকটবর্তী তারিখে বিদেশ থেকে দেশে ফিরবেন। পরে এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে ১১ অক্টোবর প্রধান বিচারপতি ছুটির মেয়াদ ১০ নভেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে জিও (সরকারি আদেশ) জারি করা হয়। পরে গত ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন প্রধান বিচারপতি। দেশ ছাড়ার আগে প্রধান বিচারপতি রাজধানীর হেয়ার রোডে তার বাসভবনের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি অসুস্থ নই। বিচার বিভাগের স্বার্থে আবার ফিরে আসব। ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে একটি মহল প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়েছেন।’ তিনি একটি লিখিত বিবৃতিও সাংবাদিকদের দিয়ে যান। পরের দিন ১৪ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ১১টি দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর তার কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসতে চাননি আপিল বিভাগের বিচারপতিরা।
প্রধান বিচারপতির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে বিচারপতি এসকে সিনহার দেশে ফেরা অনেকটাই দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারণ দেশে ফিরলেও আপিল বিভাগের বিচারপতিরা যদি তার সঙ্গে বিচারকাজে বসতে না চান, সেটি হবে প্রধান বিচারপতির জন্য অবমাননা ও বিব্রতকর। এ অবস্থায় সম্মানজনক সমাধান ছাড়া তিনি দেশে নাও ফিরতে পারেন। এ লক্ষ্যেই সিঙ্গাপুরে একটি সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা চলছে। বৈঠকে সম্মানজনক সমাধানের পথ বের না হলে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন।