পড়ছি, জেনারেলের কালো সুন্দরী
সেজুল হোসেন- প্রতি বছর বইমেলা আসে।বই কিনি।কখনো পাঠ তৃষ্ণা থেকে, কখনো লেখককে খুশি করার একটা বিব্রতকর দায় থেকে। ২০১৭ বই মেলা থেকে কেনা অনেক বই এখনো পৃষ্ঠা উল্টে দেখার তাগিদ বোধ করিনি কিন্তু কিনতে হয়েছিল। এবছরও লুকিয়ে লুকিয়ে বইমেলায় গিয়েছি হাতে গোনা দু’তিন দিন।কিছু বই কিনতে হবে এমন গোপন ইচ্ছেতো ছিলোই, ছিলো বইমেলায় ভীড়ের আনন্দ উদযাপনের তৃষ্ণাও।এবার বইমেলায় মন থেকে কেনার সিগনাল পাইনি অথচ কিনতে হয়েছে এরকম হয়নি।হাতে গোনা কিছু বই কিনেছি।পড়তেও শুরু করেছি।একেকজন পাঠকের পাঠরূচি একেকরকম। কোনও বই সেটা যতো বিখ্যাত কারো হোক না কেন, শব্দবাক্য যদি আমাকে তার দিকে না টানে আমি পড়তে পারি না।এমন অনেক বই কিনেছি অতীতে, অনেকের কাছে খুব ভালো লাগার হলেও, লেখার তাৎপর্য বা লেয়ার অনেক বেশি হলেও আমি পারিনি শুধুমাত্র বাক্য গঠনের ক্লিষ্টতা, পরিবেশন ভঙ্গিমা পছন্দ হয়নি বলে।এবারের মেলা থেকে যে কটি বই কিনেছি তার মধ্যে অন্তত তিনটি বই পড়তে পেরেছি।এখন পড়ছি ‘জেনারেলের কালো সুন্দরী’ । লেখক, ক্ষুরধার সাংবাদিক ও কলামিস্ট পীর হাবিবুর রহমান।বইমেলার শেষ দিকে অন্যপ্রকাশের স্টলে বইটি আসে।আর অল্প কদিন স্টলে থাকার সুযোগ পেয়েও পাঠকের কাছে বেশ আগ্রহ তৈরি করেছিল এই বই, সেটা শুনতে পেয়েছি। নানা কারণে বইটি সংগ্রহের একটা ইচ্ছে আমার ছিল। মেলার ২৭তম দিনে সেটি সংগ্রহে আসে এবং সময় সুযোগ খুঁজছিলাম বইটি পড়ে দেখার বা চেখে দেখার।চেখে দেখার কথা এজন্য বললাম কারণ পীর হাবিবের লেখার বিষয় বস্তু সেটা যদি পত্রিকা রিপোর্ট না হয়ে অন্য কিছু হয় তাহলে কেমন হতে পারে, কি থাকতে পারে, সে সম্পর্কে একটা আইডিয়া আমার ছিলো।বলা হয়ে থাকে ‘পীর হাবিবের হাতে শব্দ বাজে ঘুঙুরের মতো।ভাষা, আবেগ, যুক্তি আর গতি তার লেখার শক্তি।’কেবল শক্তি নয়, লেখার সময় সাহসও একটা বড় বিষয়।কথা বলতে গিয়েও যেমন বাক্য উচ্চারণের সাহস দরকার, লেখার সময় শব্দ প্রয়োগেও সেটা জরুরী বিষয়।যদিও বেশির ভাগ লেখক বিশেষ করে বাংলাদেশি লেখক যথেষ্ট অবিচার করেন নিজেদের ভিতরকে শব্দে শব্দে বের করে আনতে।নিজস্ব সেন্সরবোর্ডে আটকা পড়ে তাদের ভিতর।ফলে লেখাটা অন্ত:সার শূণ্য থেকে যায়।পীর হাবিব এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম এই তথ্য জানা ছিল আগেই।কৌতুহলটাও সেখানেই।বইয়ের নাম দেখেই বুঝেছিলাম- ‘আছে, ভিতরের খবর আছে’।
পড়াশুরু করে অনেকটা অবাক হয়েছি।উপন্যাসের প্রধান দুটি চরিত্রর মুখ দিয়ে চেনা অথচ কত অচেনা এক ইতিহাস গড় গড় করে বেরুতে শুরু করলো।মাঝে মাঝে ভুলে যাচ্ছিলাম এটা উপন্যাস নাকি ৭১ এর সেইসব রক্তাক্ত দিনলিপি পড়ছি।পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ইতিহাসেই এই ধিকৃত চরিত্রকে যেভাবে জানি এই উপন্যাসে সেই জানাটা আরও বিস্তৃত হতে লাগলো।বইটি পড়ছি আর মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি লেখকের ফেইসবুক স্ট্যাটাস।যেখানে তিনি কিছু চরিত্র’র গতি প্রকৃতি আগেই ইশারা করেছিলেন।এর মধ্যে আকলিমা মানে জেনারেল রানী, কওমি তারানা তরন্নুম, গায়িকা নূরজাহান, শরীফাসহ আরও অনেকে।যারা জেনারেল ইয়াহিয়ার হেরেমে তার শয্যাসঙ্গীনি হয়েছিলেন।লেখকের পূর্বঘোষণা অনুযায়ী সত্যিকার অর্থেই জেনারেলের কালো সুন্দরী উপন্যাসে ক্ষমতাবানদের বেপরোয়া যৌনজীবন সমাজের উঁচুদরের রমনীদের ছিনালিপনা উঠে এসেছে। উপন্যাসের পরতে পরতে আছে একটি জাতির সংগ্রাম, বিজয়ও পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী থেকে পূর্ববাংলার কসাই টিক্কা খানের নৃশংসতা, নিয়াজির আত্নসমর্পণ, পরাজিত দানবের কান্নার করুণ চিত্র, বাংলাদেশের জন্ম, অজানা সব নির্মমতার গল্প, গোপন হেরেমে নারী চিৎকার ও শিৎকারের রাজনীতি।কলকাতার হোটেলে বসে অনিরুদ্ধও মাধবীর ইতিহাস মন্থনের মধ্য দিয়ে তাদের প্রেমও পরিনয়ের সূত্র ধরে কত কত গল্প যে তল থেকে উঠে আসে কুন্ডলী পাকিয়ে তা জানতে হলে আপনাকে ইতিহাস চেতাম গজও প্রাপ্ত বয়স্ক মন নিয়ে আগাগোড়া পড়তে হবে জেনারেলের কালো সুন্দরী। এই উপন্যাস, উপন্যাস হয়েও ঐতিহাসিক ঘটনার গোপন দলিল যা আপনাকে৭১ এর সেই রক্তমাখা দিন গুলোকে-রাত গুলোকে নতুন করে নতুন ভাবে ভিন্ন একদৃষ্টি ভঙ্গিতে ভাবতে শক্তি যোগাবে।