সুজাত মনসুর :: যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবুল হাশেম ভাইয়ের আত্মজীবনীটি আমি অনুলিখন করছি। অন্যরা এ আত্মজীবনীটি কিভাবে নেবেন জানিনা, তবে আমার নিকট বেশ ইন্টারেস্টিং ও তথ্য বহুল মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত যতটুকু জানতে পেরেছি তাতে করে চল্লিশের দশকের শেষভাগ থেকে ষাটের দশকের শেষভাগ পর্যন্ত তৎকালীন শিক্ষা, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার খুটিনাটি অনেক বিষয়ই উঠে এসেছে তাঁর বর্ণনায়। তবে প্রসঙ্গক্রমে স্বাধীনতা উত্তর কিছু কিছু ঘটনা ইতোমধ্যেই উদ্ধৃত হয়েছে।

তন্মধ্যে একটা ঘটনা হলো সম্ভবত ১৯৭৩ বঙ্গবন্ধু জ্যামাইকাতে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলন শেষে লন্ডন সফরে আসলে হাশেম ভাইও বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে হিথরো বিমানবন্দরে যান। বঙ্গবন্ধু বিমান থেকে নেমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো সবার সাথে যখন পরিচিত হচ্ছিলেন তখন হাশেম ভাই নিজেকে যুক্তরাজ্য ছাত্রলীগের সভাপতি বলে পরিচয় দেন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রলীগের সভাপতি শুনে তাঁর দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তার মানে হচ্ছে, ছাত্রলীগ শব্দটি শুনে বঙ্গবন্ধুর মনে এক বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিলো।

আর হবেই না কেন? বঙ্গবন্ধু নিজেই তো বলেছেন ‘ছাত্রলীগের ইতিহাস বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস”। এই সেই ছাত্রলীগ যার নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, ওবায়দুল কাদের, বাহলুল মজনুন চুন্নু, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, সুলতান মনসুর প্রমুখ। যে ছাত্রলীগের রয়েছে কয়েক শতকের সোনালী অতীত। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ গঠনের আগে ছাত্রলীগ গঠন করেছিলেন।

উদ্দেশ্য, ছাত্রলীগ থেকে আদর্শিক, নিষ্ঠাবান, সৎ, শিষ্ঠাচার সম্পন্ন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক কর্মী তৈরি করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসবেন। যারা পরবর্তীতে দেশ মাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। ছাত্রলীগ হলো মাতৃজঠর সমতুল্য। ইতোপূর্বে ছাত্রলীগের সোনালী পর্বের ছাত্রনেতাদের নিয়ে ছাত্রলীগ গর্বিত ইতিহাস গড়েছে। কিন্তু গত দেড় দশকে গড়ে ওঠা ছাত্রনেতাদের কয়জন আমাদের জন্য গর্বিত এমন কোনো ইতিহাস গড়তে পেরেছে কি? নির্মোহ চিত্তে উত্তর নিশ্চিতভাবেই হবে, না। কেনো হলো না? শুধুমাত্র সরকারি ছাত্র সংগঠন হবার কারনে? তা কেনো হবে?

ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রী জননেত্রী যেখানে শতভাগ সততার সাথে সরকার পরিচালনা করছেন সেখানে তো এমন হবার কথা নয়। তাহলে গলদটি কোথায়? গলদ বহুমাত্রিক। শেখ হাসিনা চাইলেই শোধরাতে পারছেন না। যেভাবে পারছেন না অন্যান্য সংগঠনেও। টপ টু বটম পর্যন্ত সর্বত্র শুধুই খাই খাই রব। ইদানীং বঙ্গবন্ধু কন্যাকে দেখলে মাঝে মাঝে বেশ ক্লান্ত মনে হয়। সেটা যে বয়সের কারনে তা কিন্তু নয়, আমাদের আচরণ আর বিশ্বাসহীতার কারনে।

দেড় দশকের ওপরে তো হবেই। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগকে অধিকতর গণতান্ত্রিক করার লক্ষ্যে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের বিধান চালু করেন। যাদেরকে ছাত্রলীগের এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নেবার জন্য দায়িত্ব দিলেন, তারাই হয়ে গেল বিশ্বাসহন্তা। গড়ে তুললো সিন্ডিকেট। নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত এমন একটা চেইন ও নেতৃত্ব গড়ে তুলতো যাতে করে পরবর্তী কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে নিজেদের লোকজন জিতে আসতে পারে সেই ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়ে গেলো। যাকে বলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। শেখ হাসিনা যখন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বৈরি রাজনীতি মোকাবেলায় ব্যস্ত তখন তারা সেই সুযোগটাই নিলো। তৈরি হলো সারাদেশে ফরমালিন যুক্ত ছাত্রলীগ ও নেতৃত্ব। যার চূড়ান্ত পরিনতি আমরা এখন দেখছি শোভন রাব্বানীর নেতৃত্ব ও তাদের অনুসারীদের মধ্যে।

তথাকথিত সিন্ডিকেটের কাজেকর্মে অতীষ্ঠ হয়ে নেত্রী পুরনো পদ্ধতিতে বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করেছিলেন। এর আগে তিনি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে জরিপ করিয়ে জেনে নিয়েছিলেন ওরা বংশ পরম্পরায় আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কিনা। কোনো ধরনের ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে কিনা। ফলাফল ইতিবাচক। সুতরাং ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বসালে সবার প্রত্যাশা পুরন হতে পারে। শুরুর কয়েকমাস তারা দেখালোও কিছু আশা জাগানিয়া কাজ। আমরা সবাই বললাম সাবাস সাবাস। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের স্বরূপ উন্মোচিত হতে লাগলো। বছর অতিবাহিত হয়ে যায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি আর হয় না। আসে বহুল প্রত্যাশিত ডাকসু নির্বাচন। সভাপতি সম্পাদকের অন্তর্দ্বদ্ধে ভিপি পদে শোভনের সুচনীয় পরাজয়। নববর্ষ উদযাপনের জন্য নির্মিত মঞ্চ ও প্যান্ডেল গুড়িয়ে ফেলা হয়। নববর্ষ উদযাপন আর হলো না।

এদিকে সাংগঠনিক নেত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের। বছর গড়িয়ে কমিটি হলো ঠিকই কিন্তু প্রত্যাশা পুরণ হলো কি? অভিযোগ ওঠেছে ক্লিন ইমেজের নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে বিতর্কিতদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে যোগ্য ও ত্যাগিদের কমিটিতে স্থান দেবার নির্দেশ দিয়েছেন। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও সাংবাদিক সম্মেলন করে স্বীকার করেছে প্রাথমিকভাবে ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ২৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২৪ ঘন্টা পার হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই কিন্তু কোনো ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলা জানা নেই। বরং প্রতিবাদী নেতাকর্মীদের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের ওপর অন্তত দুইবার হামলা করা হয়েছে। এমন কি এমন অভিযোগও আছে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের উপস্থিতিতেই নাকি হামলা করা হয়েছে। প্রতিবাদে তারা মধ্যরাতে অনশন করেছে।

শেখ হাসিনার সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়া। আজন্ম লালিত সুখি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে জীবন দিয়েছেন। সেই সোনার বাংলা গড়তে না পারলে পিতা মুজিবের আত্মা যেমন শান্তি পাবে না তেমনি তিনিও শান্তি পাবেন না। তাঁর এতো বছরের মৃত্যুঞ্জয়ী লড়াই বিফলে যাবে। আর মৃত্যুর পর কিইবা জবাব দেবেন পিতামাতাকে? কিন্তু এই ফরমালিন যুক্ত ছাত্রলীগ দিয়ে যে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়া সম্ভব নয় তা ইতোমধ্যেই প্রমানিত হয়েছে। সুতরাং একটাই বিকল্প ফরমালিন যুক্ত ছাত্রলীগের বদলে নতুন আদলে ছাত্রলীগ গড়া।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn