বাঁধ নির্মাণে পিআইসি প্রথা বদলের ষড়যন্ত্র
বিশ্বজিত রায়- জামালগঞ্জে হাওর রক্ষা বাঁধ কাজ শেষ হওয়ার ৭ মাস গত হতে চলেছে। আর মাসখানেক পরেই শুরু হবে পরবর্তী বছরের বাঁধ নির্মাণ কাজের তোড়জোড়। কিন্তু অধ্যাবদি চলতি বছরের হাওর রক্ষা বাঁধ কাজের অবশিষ্ট পাওনা বুঝে পাননি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) লোকজন। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে বাদবাকী টাকা তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ। বিলম্ব বিলের কারণে ধারদেনা করে প্রকল্প কাজে হাত দেওয়া অধিকাংশ পিআইসি এখন দিশেহারা। হাওরের বাঁধ নির্মাণে হাতের টাকা খরচ করে তিন মাস হাড়খাটুনি পরিশ্রমের পর সময় মতো বিল না পাওয়ায় অনেক পিআইসিই ক্ষোভ ঝারছেন। স্থানীয় কৃষক নেতারা বলেছেন, হাওরের বাঁধ নির্মাণে পিআইসি প্রথা বদলে ঠিকাদারী প্রথায় নেবার অপচেষ্টার কথা রয়েছে সর্বত্র। ২০১৭ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের প্রলঙ্করী হাওর দুর্নীতির পর কৃষকের
স্বার্থে ঠিকাধারী প্রথা বাতিল করে পিআইসি প্রথা চালু করে সরকার। কৃষকেরা নিজেদের হাওর নিজেরাই রক্ষা করবে এমন চিন্তা থেকে হাওর পারের কৃষক দ্বারা প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের মাধ্যমে সরকার হাওরকে দুর্নীতিমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই নীতিমালায় ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শুরু এবং ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা আছে। সে মোতাবেক হাওর রক্ষা বাঁধ কাজের শেষ সময়সীমা থেকে বর্তমান পর্যন্ত বাঁধের কাজ সমাপ্তির ৭ মাস গত হতে চললেও এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বিল পাননি পিআইসিরা। এতে করে সরকারের কৃষকবান্ধব এই নীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পাঁয়তারা চলছে বলে মনে করছেন অনেকে।
হাওরপারের মানুষসহ কৃষক নেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের এমন খেয়ালিপনায় হাওর রক্ষা বাঁধ কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে স্থানীয় কৃষক। এই সুযোগে বাঁধ রক্ষা কাজের দায়িত্ব যাতে আবার ঠিকাদারী প্রথায় নেওয়া যায় সেই চেষ্টা করবে সুযোগসন্ধানী দুর্নীতিবাজ চক্র। পিআইসির পাওনা নিয়ে পাউবোর দীর্ঘসূত্রীতা দেখে এর মাঝে দুরভিসন্ধিমূলক অপতৎপরতা দেখছেন তারা। হাওর পারের কৃষকরা নিজেদের বাঁধ নিজেরাই তৈরি করুক সেটা হয়তো চায় না পানি উন্নয়ন বোর্ড। যাদের বাঁধ রক্ষা কাজে ত্রুটি আছে তাদেও সঙ্গে হয়রানিতে পড়েছে, যারা ঠিকঠাক মতো বাঁধ নির্মাণ করেছে তারাও। তাদেরকেও কেন বিলম্ব বিলে মাশুল দিতে হচ্ছে, সেই প্রশ্ন রাখেন কৃষক ও কৃষক নেতারা।
উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, ৬৯টি পিআইসির অনুকূলে বরাদ্দকৃত ৮ কোটি ৫১ লাখ টাকার মাঝে তিন কিস্তিতে ৫ কোটি ৪৯ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি পিআইসি আছে যেগুলো নিয়ম অনুযায়ী কাজ না করায় তাদেরকে ২টি বিল দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলে অর্ধেকেরও বেশি বিল প্রাপ্ত হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির লোকজন। বাকি আছে আর মাত্র ১টি বিল। যেখান থেকে সরকারি ভ্যাট কর্তনের পাশাপাশি ঘাস লাগানো, দুরমুশ, জিও টেক্স, মাটি ফেলাসহ আনুষাঙ্গিক কাজে ত্রুটি আছে এমন পিআইসির পাওনা বিল থেকে ত্রুটিপূর্ণ কাজের হিসাব কষে সমপরিমাণ অর্থ বাদ দিলে বেশি পাওনা বাকি নেই বলে জানিয়েছে উপজেলা পাউবো অফিস। এ ব্যাপারে হালি হাওরের ৫০ নম্বর পিআইসি সভাপতি জানকীনাথ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদেরকে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁধে কাজ করতে হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন ইনকুয়ারি টিমের তদারকি থাকায় আমরা ভয়ে ঋণ করে কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। এখন বিল না পাওয়াতে কি যে কষ্টে আছি সেটা বুঝিয়ে বলতে পারব না। সরকার কৃষকদের কাজ দিছেন, কৃষকের কাজ কৃষক করবে, এতে কৃষকদের মাঝে একটা স্বতঃস্ফূর্ত ভাব ছিল। এখন সর্বশেষ বিল না পাওয়ায় ঋণের যন্ত্রণায় অনেক কৃষকই গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হবে।’ পাগনা হাওরের ২৪ নম্বর পিআইসি সভাপতি আলী আহমদ বলেন, ‘আমি যে বাঁধে কাজ করছি সে বাঁধে মন্ত্রী মহোদয় আইছেন। কতটা ভালো কাজ করছি তিনি দেইখ্যা গেছেন। কিন্তু ১৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা বিলের মধ্যে পাইছি ৯ লাখ টাকা। এখনও বাকি আছে ৬ লাখ টাকা। বাকি বিল না পাওয়ায় ঋণ পরিশোধ করতে পারতাছি না। পাওনাদাররা বাড়িঘর ভাঙতাছে। এখন আমরা কি করমু?’
জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও কৃষকনেতা চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘হাওরে বাঁধের কাজও সম্পন্ন হয়েছে এবং হাওরের ধানও কৃষক সুন্দরমতো ঘরে তুলেছে। তারপরও কেন পিআইসিদের বিল দেওয়া হচ্ছে না। এর কারণ হতে পারে সংশ্লিষ্টদের মাঝে একটা মধ্যস্বত্বভোগী আছে যারা কাক্সিক্ষত পাওনা বুঝে পাচ্ছে না বিধায় বিল দিতে গড়িমসি করছে।’ বাঁধের কাজে যদি কারও কোনো ত্রুটি থেকে থাকে তাহলে তা কাটসাট করে বাকি পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হোক সেই দাবি জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘পিআইসি সিস্টেমটাকে নষ্ট করে পুরোনো পন্থায় ফিরে যাওয়ার কারসাজি আছে, এমন কথা নানা মহল থেকে বলা হচ্ছে। এসব কর্মকা-ে প্রতীয়মান হয়, বর্তমান পিআইসি প্রথাকে বানচাল করে আবার পুরোনো পন্থায় নিয়ে যাওয়ার একটা প্রক্রিয়া চলছে।’ উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ সহকারী প্রকৌশলী ও শাখা কর্মকর্তা মো. রেজাউল কবির বলেন, ‘আমরা বাঁধ রক্ষা কাজ যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত ফলাফল উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবরে প্রেরণ করে বাকি বিল পরিশোধের অনুরোধ জানিয়েছি। এখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবেন কবে নাগাদ অবশিষ্ট বিল পরিশোধ করা হবে।’ এ ব্যাপারে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান বলেন, ‘সর্বশেষ কিস্তির টাকাটা ছাড়ের জন্য গত তিন-চারদিন আগেও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। প্রথমদিকে তারা একটা রিপোর্ট চেয়েছিল আমাদের কাছে, আমি এবং জেলা প্রশাসক মহোদয় দু’জনে রিপোর্ট পাঠিয়েছি। আশা করছি টাকাটা দ্রুত ছাড় হবে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখানে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্থ ছাড় করার কোনো এখতিয়ার নেই। অর্থ ছাড় হয় অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে এবং সেখান থেকে টাকাটা আসে পাউবোতে। কাজেই এই টাকা যদি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে না আসে, এক্ষেত্রে কিছু করার নাই। এর জন্য আমাদের জেলা প্রশাসক মহোদয়সহ আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’