বিশেষ কলাম:কী আনন্দ মানুষ হত্যায়!
হায় হায়, মেরে ফেলার পর দেখা গেল চোরও মানুষ! তার দেহটা প্লাস্টিকের না মাটিরও না, সম্পূর্ণ রক্ত-মাংসের। মারলে রক্ত ঝরে, মাংস থেঁতলায়। আরও আশ্চর্য, এমনকি ব্যথাও পায়, গুমরে গুমরে কাঁদে কিংবা মা-বাবা বলে চিৎকার করে। জানতে জানতে আরও জানা গেল, তারও বাবা-মা, ভাইবোন আছে। আছে খাওয়া-পরার জন্য অস্থির এক জীবনসংগ্রাম। নিহত ওই কিশোরের নাম মো. সাগর (১৬)। থাকত ময়মনসিংহ শহরের রেললাইনের বস্তিতে। তার পরিচয়, সে টোকাই, ফেলে দেওয়া ভাঙরি জিনিস টুকিয়ে জীবন চলত তার। সেই কষ্টের জীবন তার আর চালাতে হবে না। তার এক জীবনের যত কষ্ট এবং ভবিষ্যতে আরও যত কষ্ট বরাদ্দ ছিল, সব থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছে হ্যাচারি মালিক আক্কাস আলী। চোর ও মালিকের গল্প একপাক্ষিক। এই গল্পে মানুষ কোথায়?
টোকাই বা ‘চোর’ কি কারও পরিচয় হতে পারে? মানুষের ঘরে মায়ের পেটে জন্মায়নি কি সে? পরিবারের একজন নয় সে? রেললাইনের বস্তিতে যে প্রাণবিক দশায় পাতা হয়েছিল তাদের সংসার, সেখানে কোনো কিছুই সুন্দর নয়। তারপরও মা-বাবা, ভাইবোনের অদৃশ্য মায়ার সুতায় বাঁধা ছিল না কি সেই পরিবারটি? মানুষ মরণশীল, তাই বলে পিটিয়ে পাথর ভাঙার মতো ভাঙা হবে মানুষে শরীরের হাড়গোড়?
‘বহুরূপী’ নামে একটা গল্প পড়েছিলাম ছোট বেলায়। গ্রামে নিয়মিত বাঘ আসে, ছাগল ধরে নিয়ে যায়। যত বড় বাঘই হোক, গৃহস্থ তো ছেড়ে কথা কইবে না। ফাঁদ পেতে সেই গ্রাম্য বাঘটাকে তারা আটকায়। বাঙালি বীরের জাত। বাঘ পিটিয়ে মারার ঐতিহ্য ছিল আমাদের। তো সেই বাঘ এমনই বাঘ, লাঠির ঘায়ে হালুম না করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। লোকজনের বিস্ফারিত চোখের সামনে আহত ও বন্দী বাঘটি মুখোশ খুলে মানুষ হয়ে উঠল। বেরিয়ে এল সাতিশয় নিরীহ চেহারার এক গরিব মানুষ। ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করতে নেমেছিল। বহুরূপীর বাঘের পোশাক ছিল তার কৌশল। গ্রামবাসী তাকে করুণা করে চুরির না করার শপথ করিয়ে ছেড়ে দেয়। গ্রামবাসী যা করেছিল তা হলো, ‘দয়া’ বা ‘রহম’। শত্রুর কাছেও মানুষ দয়া চাইতে পারে, রহম আশা করতে পারে। যখন মানবতা ধ্বংসের মুখে, তখন দয়া-মায়া-করুণা হলো সেই নিম্নতম গুণ, যা ছাড়া মানুষ বাঁচে না, যা ছাড়া মানুষকে মানুষ বলা যায় না, যা ছাড়া সভ্য হয় না কেউ।
মাছের খামারের মালিক আক্কাস আলীর মনে দয়ামায় ছিল না। মারিব মৎস্য বেচিব সুখে; এই মন্ত্র ছিল তার। সেই সুখের ঘরে হানা দিয়েছে কিনা এক বাচ্চা চোর? লম্বা সময় ধরে মনের সুখে তাকে পিটিয়েছেন তিনি। খুঁটিতে বাঁধা থাকায় দৌড়ে পালাবে, সেই ভয় ছিল না মালিকটির। শেষ মুহূর্তে পানি চেয়েছিল ছেলেটি। দেওয়া হয়নি। ১৬ বছরের নাবালক পেটাতে কী আনন্দ পেয়েছিলেন তিনি? সেই আনন্দের রং কী? মাথার মধ্যে তখন কোন ডোপামিন নিঃসরণ হয়, যা নাকি আমাদের আনন্দের রাসায়নিক উৎস? সম্পদের মালিকানা ভোগের সুখের সঙ্গে কি চোর পেটানোর সুখের কোনো গলাগলি সম্পর্ক আছে?
সাগর চুরি করেছিল কি না, তা এখনো প্রমাণিত নয়। চুরির জিনিস ফেরত আনা যায়, যে জীবন চলে যায় তা আর ফেরে না। যে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট হয়, সংকটের সুযোগে চালের মজুতদারি করে রাতারাতি মুনাফার পাহাড় গড়া যায়, যে দেশের ক্ষমতাবানেরা রাজপথে উল্টো দিকে গাড়ি ছোটায়, দেশটাকে টানে উল্টো পথে, সে দেশে সামান্য জিনিস চুরি নিশ্চয়ই মস্ত বড় অপরাধ! চালের দাম ৬৫-৭০ টাকা ওঠানো কোনো অপরাধই না।মালিকানাবোধ এতই মারাত্মক? জিনিস ও সম্পদের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য তার কাছে এত কম?
প্রশ্নটা আসলে চুরির বিষয়ে নয়। শাস্তির বিষয়ে। শারীরিক শাস্তির প্রতি আমাদের আকর্ষণের কথা সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে। কথায় কথায় আমরা ‘থাবড়া’ দেওয়ার কথা বলি। ‘পিটিয়ে সোজা করা’ আমাদের মুখস্থ বুলি। বলপ্রয়োগ ছাড়া বিবাদ-বিসংবাদের সমাধানে শান্তিপূর্ণ কোনো তরিকার কথা আমাদের মনে আসে কম। এটা সামন্তীয় সমাজের লক্ষণ। আমাদের সামষ্টিক আচরণের মধ্যে সামন্তীয় সহিংসতা লুকিয়ে আছে। গণপিটুনি, বিনা বিচারে ক্রসফায়ার, বউ পেটানো, অ্যাসিড ছোড়া, দলবদ্ধ ধর্ষণের বিস্তর উদাহরণ সামনে হাজির আছে। সাধারণত দু্র্বল এবং শিশু ও নারীরা এর প্রধান শিকার।
খুব ছোটবেলায় গ্রামে ডাকাত ধরার দৃশ্য দেখেছিলাম। চৌকিদার গ্রামবাসীকে নিয়ে ডাকাত পেটানোর পর তাকে নিয়ে বের হলো লুকানো অস্ত্র খুঁজতে। কিছু দূর নেয় আর পেটায়। প্রতিবার পিটুনি খেয়ে লোকটা একবার এখানে একবার সেখানে অস্ত্র আছে বলে জানায়। তারপর সেখানে সেখানে গিয়ে মাটি খুঁড়ে কিছু না পেয়ে আবার পেটানো হয়। গ্রামবাসী হইহই করে সমর্থন করে। অল্প যে কজন না মেরে থানায় দেওয়ার কথা বলেছিল, তাদের ধমকে থামানো হয়। অনেকে বলবেন, যেমন কুকুর, তেমন মুগুর। দুঃখিত! মানুষ কুকুর নয়, আর কুকুরকেও এভাবে পেটানো যায় না। যেসব দেশে অপরাধ একেবারে কম, সেখানে কিন্তু কঠিন শাস্তির বিধান নেই। শাস্তি কঠিন হলেই যে অপরাধ কমবে, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নাই। কঠিন ক্রসফায়ার-বন্দুকযুদ্ধের আইনবহির্ভূত শাস্তি কি বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অপরাধ কমাতে পেরেছে? অপরাধ কমে বিচার, সংশোধন এবং সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে। যাবতীয় অপরাধের শিকড়-বাকড় হলো বঞ্চনা, দারিদ্র্য, বিচারহীনতা। সবচেয়ে বড় চোরেরা কিন্তু গরিব নয়। তাদের পেটাতে পারবেন?আমাদের ভেতরের গভীর হিংসাই যাবতীয় অপরাধের প্রধান উৎস। মানুষ হিংসাশী প্রাণী, এই সত্য মানলে পরে আপন আপন হিংসার চিকিৎসা করা সম্ভব।
সাগরের পরিবারের জন্য শোক, তার হত্যাকারীর জন্য রইল বিচারের দাবি। কিন্তু তাঁকেও ঘৃণা করতে পারছি না। তাঁর জন্যও রইল করুণা। হত্যার যে অপরাধ তিনি করেছেন, তার শাস্তিভোগ করে অনুশোচনার পথে তিনি মানুষ হয়ে ফিরে আসুন, এটাই কামনা করি। তাঁরও তো পরিবার আছে, সন্তান আছে। এ জন্যই বলা হয়, রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন। খুনিরা কেবল মানুষকেই হত্যা করে না, হত্যা করে নিজের ভেতরের মানবতাকে, দয়ার ধর্মকে। সাগরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আক্কাসের ভেতরকার মানবতারও মৃত্যু ঘটল। হত্যা এমন জিনিস, তার দ্বারা আক্রান্ত ও আক্রমণকারী উভয়েরই সর্বনাশ হয়। এই সত্যটা যেন আমরা মনে রাখি।প্রতিটি হত্যার পর পড়ে থাকে একটি লাশ ও একটি ঘাতক দানব। সাগরকে হত্যার দৃশ্যে শুধু খুনী আক্কাস আলীই ছিলেন না, দর্শক হিসেবে আরো অনেকেই ছিলেন। তাঁরা অপরাধ করেননি, কিন্তু নীরবতা দিয়ে হত্যাদৃশ্যের অংশ হয়েছেন। মানব ও দানবের মাঝের এই মানুষদের আমরা কী বলব?
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।