ইউরোপের সবচেয়ে বড় বাংলা নাটকের উৎসব ‘সিজন অব বাংলা ড্রামা, লন্ডন গত ২৬ নভেম্বর ২০১৭ মঞ্চস্থ হলো নাট্যকার মোস্তাক আহমেদ রচিত নাটক ‘হাসন রাজা’। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত নির্দেশক ইশরাত নিশাত। লন্ডনের থিয়েটার বাংলা, ইউ, কে এর নাট্যকর্মীদের অনবদ্য অভিনয়ে উপস্থিত দর্শকদের হৃদয় জয় করে নেয় নাটকটি। ‘হাসন রাজা’ দ্বিতীয়বারের মত মঞ্চস্থ হলো লন্ডন। গত বছর ১লা নভেম্বর ম্যাক থিয়েটার হল, লন্ডনে প্রথমবার মঞ্চস্থ হয় ‘হাসন রাজা’। লন্ডনের পর মোস্তাক আহমেদ এর অনবদ্য এই নাটকটি আমেরিকার দর্শকদের মন জয় করে নেয় এ বছরের শুরুতে। নিউ ইয়র্ক এর কুইন্স থিয়েটারে প্রথম এবং ম্যারিল্যান্ডে দ্বিতীয় প্রদর্শনী ছিলো উল্লেখ করার মত। মোস্তাক আহমেদ এর ধ্রুপদী নাট্যভাবনা ‘হাসন রাজা’ সম্পর্কে লোকসংস্কৃতি গবেষক ও প্রাবন্ধিক সুমনকুমার দাশ তাঁর একটি লেখায় লিখেছিলেন-‘পুরো পান্ডুলিপিটি পাঠ শেষে একটি ঘোর তৈরী হয়। এ ঘোর জমিদার হাসন রাজার বর্ণিল জীবন যাপনের জন্য। এ ঘোর নাট্যকার মোস্তাক আহমেদের সুদক্ষ বুননশৈলীর জন্য।’ সত্যিই পুরো নাটক জুড়েই জমিদার দেওয়ান হাসন রাজা চৌধুরীর প্রেম, বিরহ, সংকট আর ভোগবাদ থেকে মরমিবাদে ঝুকে পড়ার নাটকীয় মুহূর্তগুলো এক ঘোরাচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরী করে। নাটকের শুরু বন্দনাগীতি দিয়ে। এ ক্ষেত্রে নাট্যকার বাংলার লোকনাট্যরীতি অনুসরণ করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। নাটকের প্রথমদিকে ‘ছাড়িলাম হাসনের নাও রে, বৈঠা ফালাইতে নাওয়ে শূন্যে করে উড়া রে’ গীতটি হাসনের বর্ণিল জীবন তরীর এক রূপ যেন। পর্যায়ক্রমে, ভরা পূর্ণিমার রাতে সুরমার জলে নৌবিহার আর পেয়ারীর সংগে কথোপকথনে প্রকৃতিপ্রেমী এক হাসনের সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে। তারপর রামপাশায় সৌখিন জমিদার হাসন রাজার কোড়াপাখি শিকার, অত:পর বিধবা চন্দ্রার সংগে সাক্ষাত পরবর্তী প্রেম-বিরহ নাট্যকার অদ্ভুত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। ‘হাসন রাজা’ নাটকে পেয়ারী বাঈ এবং চন্দ্রা এই দুটি চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে নাট্যকার বলেন-‘দুটিই প্রাসঙ্গিক কল্পনা আশ্রিত চরিত্র। পেয়ারী হচ্ছে হাসন রাজার গানের দলে তাঁর ছায়াসংগী হয়ে থাকা অসংখ্য রমনীর একটি রূপক চরিত্র। আর চন্দ্রা বহুল জনশ্রুতি থেকে বেরিয়ে আসা একটি কাল্পনিক চরিত্র।’
‘হাসন রাজা’ নাটকের ঘটনা প্রবাহ যেন এক বর্ণিল জমিদারের দিনপঞ্জি। প্রথম স্ত্রী আজিজা বানু’র সাথে মান-অভিমান, প্রেমালাপ, মল্লিকপুরের জমিদার গোবিন্দ বাবু’র সংগে শত্রুতা, একাধিক বিয়ে, প্রজা বিদ্রোহ, মায়ের সংগে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পরবর্তী অনুশোচনা, মুর্শিদের অনুসন্ধান, ভোগবাদ পরিত্যাগ, মায়ের মৃত্যুসহ প্রত্যেকটি ঘটনা নাট্যকার মোস্তাক আহমেদ অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে বিন্যাস ঘটিয়েছেন। পুরো নাটকের ক্যানভাস জুড়ে একটি ব্যাপার খুব স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। আর তা হলো, হাসন-জীবনে তাঁর মমতাময়ী মায়ের প্রভাব। হাসন রাজার গর্ভধারিণী মা হুরমত জাহান বেগমকে নাট্যকার অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্না এক দৃঢ়চেতা রমণী হিসেবেই অঙ্কন করেছেন।
নাটকে গানের প্রয়োগ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয়, সৌখিন বাহারের কবি হাসন রাজার পরিচয় গানেই। তাই নাট্যকার প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত অনেক গান ব্যবহার করে নাটকের সাবলীল গতিময়তা অক্ষুণ্ণ রেখেছেন ধারাবাহিকভাবে। এবং ‘হাসন রাজা’য় বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্তের দুটি গান নাট্যকার যুক্ত করেছেন খুবই প্রাসঙ্গিকতার আলোকে। মোস্তাক আহমেদ অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নাটকের গীতল রীতি, অভিনবত্ব ও উপস্থাপন ভঙ্গি ধরে রাখতে পেরেছেন। অন্যদিকে, এক দৃশ্যের সঙ্গে অপর দৃশ্যের যোগসূত্র চমৎকারভাবে তৈরী করতে পেরেছেন। নাটকের সংলাপ রচনার ক্ষেত্রেও তিনি বাহাদুরি দেখিয়েছেন নি:সন্দেহে। মোস্তাক আহমেদ একজন দক্ষ নাট্যকার হিসেবে ইতিমধ্যেই দেশে বিদেশে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে। দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ইংল্যান্ডের ম্যাক থিয়েটার হল, আমেরিকার কুইন্স থিয়েটার, রাশিয়ার মস্কো থিয়েটারের মত বিশ্বখ্যাত থিয়েটার মঞ্চের সাথে জড়িয়ে পড়েছে মোস্তাক আহমেদের নাম। সময়ের এই তরুন নাট্যকারের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বর্তমানে তিনি কিংবদন্তি সুফিসাধক দুর্ব্বিণ শাহ’র জীবনী নির্ভর গীতিনাট্য ‘দুর্ব্বিণনামা’র স্ক্রিপ্ট নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। পাশাপাশি, ঢাকার একটি নাচের দলের জন্য ‘হাসন রাজা’র নৃত্যনাট্য রূপ নিয়েও কাজ করছেন। নাট্যকার মোস্তাক আহমেদ ও ‘হাসন রাজা’র জয়রথ ছুটে চলুক নিরন্তর। বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক আমাদের লোকসংস্কৃতি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn