ভাঙনের গল্পগুলো কেন একই হয়!
লুতফুন নাহার লতা:-
মানুষ যখন তার নিষ্ঠুর আচরন দিয়ে, বিভৎস ভাষা দিয়ে, শারীরিক নির্যাতন দিয়ে পাশের মানুষটিকে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে থাকে, তখন সে কি আর মানুষ থাকে! থাকে না। বিশেষত পুরুষের এই নিষ্ঠুরতা, নারীর প্রতি বলপ্রয়োগ, এবং উদ্ধত অবস্থান, তা এসেছে মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকেই।
হুমায়ুন আজাদ তাঁর নারী গ্রন্থে বলেছেন, “পিতৃতন্ত্র তার বল প্রয়োগের অধিকার অর্পণ করেছে পুরুষের ওপরে। সমাজের নিম্ন শ্রেণীর পুরুষেরা তাদের এ-অধিকার নিয়মিত প্রয়োগ করে থাকে, আর উচ্চশ্রেণীর পুরুষেরা তা শারীরিকভাবে প্রয়োগ না করলেও মনস্তাত্বিকভাবে প্রয়োগ করে।” অতএব তারা আর মানুষ থাকে না।
পৃথিবীতে বহু মানুষকে দেখেছি বাইরে সবার সাথে অসাধারণ মিষ্টি আচরণ। সবার সাথে মধুর ব্যবহার, কেবল স্ত্রীর প্রতি অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষ। স্ত্রীকে সে মানুষ বলে গণ্য করে না। নানাবিধ কারণে একটি সম্পর্ক যখন আর মধুর মনে হয় না, যখন আর জোড়াতালি দিয়ে চালানো যায় না কিছুতেই, তখন কী করবে মানুষ! সরে যাবে একে অপরের জীবন থেকে! কে সরবে! নারীটি!
এমন উদাহরণ সম্ভবত খুবই কম যে সেপারেশান বা আলাদা হবার পদ্ধতিতে পুরুষটি নেমেছে পথে। সব দেশেই সব কালেই সকল সমাজেই কেন এই নিয়ম! কেন দুটি মানুষ দীর্ঘদিন ভালোবেসে একসাথে থেকে তারপর সামান্য স্বার্থে একদিন অস্বীকার করে সব! কিছুতেই কেন ভাবে না একদিন পাশের মানুষটিকে পাবার জন্যে আকাশ আর মাটি একাকার করে ফেলেছিল! কেন সামান্যতম সৌজন্যতাটুকু দেখায় না একে অপরের প্রতি!
মায়া মমতার কথা বাদই দিলাম, সভ্যতার খাতিরে অন্তত! যেকোনো সম্পর্কই ভেঙে ফেলাটা কষ্টের। বিশেষ করে বৈবাহিক সম্পর্ক। সন্তান সন্ততি থাকলে তো আরও বেশি কষ্টকর। আমি দেখেছি এরকম অবস্থায় একজন নারী কেমন করে ভেঙে ভেঙে টুকরো হয়ে যায়। পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় চোখে অন্ধকার দেখে। আমাদের সমাজে তো মেয়েদের অবস্থা আরও করুণ!
ফিরে যাবে সে কোথায়? বাবার বাড়ি? ভাইয়ের বাড়ি? নিজের অর্থনৈতিক অবস্থা আছে তো নিজের মতো করে থাকার? বাচ্চাদের জন্যে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে পারবে তো! ভাঙনের সাথে সাথে সামনে এসে দাঁড়ায় এমনি হাজারো প্রশ্ন। বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে একটি পুরুষের মুক্তি মানে তার সর্বাঙ্গীণ মুক্তি হয়ে ওঠে। সন্তানের দায়িত্ব থেকেও সে মুক্তি পেয়ে যায়, কিন্তু নারীর কাঁধে এসে পড়ে সন্তান পালনের একক দায়িত্ব।
সামাজিক, অর্থনৈতিক চাপ তো থাকেই সেই সাথে চলে ইমোশনাল টারময়েল। আমি অবাক হয়ে ভাবি এর পরেও মেয়েরা কেমন দূর্গার মতো দশ হাতে সব সামলায়। ছাইয়ের ভেতর থেকে স্ফুলিঙ্গের মত বেরিয়ে আসে। একজন বাবা একা তার সন্তানদের মানুষ করছেন এরকম দৃশ্য আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। একজন পুরুষের ক্ষেত্রে এমন অবস্থা হলে তার আত্মীয় স্বজনেরা মরিয়া হয়ে ওঠেন তাকে বিয়ে দিয়ে বাচ্চাদের জন্যে একজন কেয়ারটেকারের ব্যবস্থা করতে।
খুব কম নারীর ক্ষেত্রে এমনটা হয়। আমেরিকাতে, মেইন স্ট্রিম মেয়েরা বেশির ভাগই পুরুষের সাথে সমানে সমান শিক্ষিত। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানও সমান। কোন কোন ক্ষেত্রে বেশিও। তারপরেও পুরুষটি আইনের কাছে বাধ্য থাকে বাচ্চাদের দেখাশোনা ও আর্থিক দায় নিতে। ডিভোর্সের পরে বাচ্চারা বাবা ও মায়ের কাছে ভাগাভাগি করে সময় কাটায়। রেগুলার স্কুল, মার্শাল আর্ট, পিয়ানো লেসন, ডান্স স্কুল বাচ্চাদের সকল কিছুই ঠিকঠাক থাকে। সপ্তাহে কিছু কিছু দিন মা সব করেন, কিছু কিছু দিন বাবা।
মা সময় পান নিজের মত করে সপ্তাহে দিন কয়েক একা এবং একক জীবন কাটানোর, আবার বাবাও। দুজনেই তাদের গার্লফ্রেন্ড বা বয় ফ্রেন্ডের সাথে ছেলে মেয়েদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটান। বাচ্চারা বাবার কাছে বায়না, আদর, বন্ধুত্ব কিছু থেকেই বঞ্চিত হয় না। সম্পর্ক ভেঙে যাবার একটা কষ্টকর অধ্যায় পার হলেও কেউ কাউকে প্রতিনিয়িত আঘাত করে না। অতীতকে হাসিমুখে অতীত করে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া মেয়েরা আমাকে মুগ্ধ করে।
আমি নারীর এই ‘আমার দূর্গা’ রূপ দেখে আনন্দে আবেগে অশ্রুপাত করি। এদেশে ইমিগ্রান্ট পুরুষদের কাহিনী আলাদা। তারা আসে, সাথে নিয়ে আসে নিজেদের সংস্কৃতি। সাথে নিয়ে আসে বেধড়ক বউ পেটানোর নির্লজ্জ হাত। কুৎসিত হীনমন্যতা আর ক্লেদাক্ত স্বার্থপরতা। এদের অধিকাংশই প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে বউ পেটানোর দায়ে এদেশের পুলিশের হাতে এরেস্ট হয়। নারীরা আসে স্বামীর প্রতি বিশ্রি রকমের নির্ভরতা নিয়ে, নির্লজ্জ পরগাছা হয়ে, ক্ষীণ মনোবল আর লক্ষ্যবিহীন স্রোতের মত। পরাধীনতাই নিরাপত্তা মনে করে তারা। একসময় হাজারো চড়াই উতরাই পেরিয়ে এদেশের আইন কানুন ধীরে ধীরে বদলে দেয় তাদের।
কিছুটা বদলায় পুরোটা নয়। আমাদের দেশে এসবের বালাই নেই। সাপোর্ট টাপোর্ট কিচ্ছু নেই মেয়েদের জন্যে। বাবার বাড়ি থেকে বেরুবে কে? মেয়েটা। স্বামীর বাড়ি থেকে বেরুবে কে? মেয়েটা। ছেলের বাড়ি থেকে বেরুবে কে? সেই মেয়েটা। ডিভোর্সের পরে বাচ্চাদের স্কুল, কলেজ, পড়াশোনা, অসু্খ, বিসুখ সামলাবে কে? মেয়েটা। অথচ কী নির্লজ্জ সমাজ আমাদের!
একটি ছেলে আজীবন বাবা মায়ের বাড়ীতে অকুতোভয়ে জীবন কাটাবে, কিন্তু মেয়েটা নামবে পথে। আজ যার কথা শুনে মন তোলপাড় হয়েছে মূলত তার সমাজ আর আমার সমাজের পার্থক্য নেই কোনো! দুই দেশ, দুই ভাষা, দুই সমাজ তবু মানুষের নিপীড়নের একই রীতি। ভাঙনের গল্প একই। উন্নত দেশগুলোতে চাইল্ড সাপোর্ট, বা এলিমনির বন্দোবস্ত থাকলেও পৃথিবীর বহু দেশেই এক্ষেত্রে সন্তানের হাত ধরে একজন মায়ের পথে নামা ছাড়া আর উপায় থাকে না। সভ্যতার ইতিহাসে আজো নারীর প্রতি এই নির্মমতা একটি কালো দাগ। প্রতিটি মানুষের উচিৎ সমাজের এই সব অমানুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সমবেতভাবে এর প্রতিকার করা!