মধ্যপ্রাচ্য সংকটে ঢাকার দুশ্চিন্তা বাড়ছে
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তা বাড়ছে ঢাকার। যদিও কাতারের সঙ্গে সৌদি আরব ও তার মিত্র ৮ দেশের সম্পর্কচ্ছেদে বাংলাদেশ কোনো অবস্থান নেয়নি। বরং ঢাকা চাইছে যে কারও মধ্যস্থতায় ভ্রাতৃপ্রতিম সৌদি আরব ও তার মিত্রদের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক স্বাভাবিক হোক। সেখানে কুয়েতসহ মধ্যস্থতায় যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণে রয়েছে ঢাকার। মধ্যপ্রাচ্য সংকট প্রশ্নে সমপ্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, বাংলাদেশ পুরো বিষয়ে ওয়াকিবহাল রয়েছে। পরিস্থিতির ওপর ঢাকার তীক্ষ্ন নজর রয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও মানবজমিনের সঙ্গে আলাপে বলেন, ঢাকা মনে করে জিসিসি পরিবারের অভ্যন্তরীণ এ সংকট সাময়িক। এটি কেটে যাবে। কুয়েতের আমীরসহ অন্য হিতাকাঙক্ষীরা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। আলাপ-আলোচনায় চলমান সংকটের একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান আসবে বলে মনে করে বাংলাদেশ। তবে বিশ্লেষক ও পেশাদার কূটনীতিকদের মাঝে ভিন্নমতও রয়েছে। শুরুতে যেমনটি মনে হয়েছিল, দিন যত যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সংকট ততই ঘনীভূত হয়েছে বলে মনে করেন তারা। পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির বিষয়ে প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখেন সেগুনবাগিচার এমন এক কর্মকর্তা বলেন, সন্ত্রাসে মদত দেয়ার অভিযোগে শুরুতে ৩ দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন অনেকটা জোটবদ্ধভাবেই কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। ঘোষণাটি ‘আচমকা’ হলেও এর পেছনে যে দীর্ঘ সময় হোমওয়ার্ক হয়েছে সেটি স্পষ্ট হয় মিশর, ইয়েমেন, মরিশাস, মৌরিতানিয়া, মালদ্বীপ এবং লিবিয়ার পূবাঞ্চলীয় সরকারের দোহার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণায়। সিএনএনের রিপোর্ট মতে, ৩৬ বছরের পুরনো গালফ ইউনিয়নের জন্য এটি বড় ধরনের ধাক্কা। এটি কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতিতেই ধাক্কা দেয়নি বরং নাগরিক জীবনে এমনকি পরিবার- সংসার পর্যায়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের এ অস্থিরতার ঢেউ বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ওপরও আছড়ে পড়বে। সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যকার হাইটেনশন বা উচ্চমাত্রার উত্তেজনা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কায় জাপানের বিভিন্ন কোম্পানি যাদের সৌদি আরব ও কাতার উভয় দেশের সঙ্গে ব্যবসা রয়েছে তারা তাদের ব্যবসা পরিচালনায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের সংকট অবশ্য ভিন্ন। সৌদি আরব বাংলাদেশের জনশক্তির সবচেয়ে বড় বাজার। দেশটিতে প্রায় ১৮ লাখ কর্মী কর্মরত। উপসাগরীয় অন্য দেশেও বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক কর্মী আছেন। অপরদিকে, কাতারে বাংলাদেশের কর্মী আছেন তিন লাখ ৮০ হাজার। প্রতি মাসেই ১০ থেকে ১২ হাজার বাংলাদেশি কর্মী কাতারে যাচ্ছেন। ২০২২ সালে কাতারে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেও বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া, সমপ্রতি কাতারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি চুক্তি হয়েছে যার অধীনে এক দশমিক আট বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে গচ্ছিত রাখবে কাতার। ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যেকোনো উত্তেজনা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর। মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব ও ইরান পরস্পরের বৈরী অবস্থানে থাকলেও উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। উল্লেখ্য, সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে রয়েছে বাংলাদেশ। গত মাসে রিয়াদে অনুষ্ঠিত আরব-ইসলামিক-আমেরিকান সম্মেলনেও বাংলাদেশ অংশ নেয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এবং মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের ৫৫টি দেশের শীর্ষ নেতা ওই সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে হোস্ট কান্ট্রি সৌদি আরবের তরফে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয় শিয়া অধ্যুষিত ইরানের বিরুদ্ধে। সেই সম্মেলনে কাতারের আমীরও অংশ নিয়েছিলেন। অংশগ্রহণকারী শীর্ষ নেতাদের যৌথ বিবৃতিতে সৌদি আরবের ইরান বিরোধী অবস্থানের প্রতিফলন ছিল। এখন কাতারের সঙ্গে সৌদি মিত্রদের সম্পর্কের অবনতি হলে সামরিক জোটে থাকার পর রিয়াদের কোনো অনুরোধ এক কথায় উড়িয়ে দিতে পারবে না বাংলাদেশ। অন্যদিকে কাতার কিংবা ইরানের সঙ্গেও সম্পর্ক নষ্ট করতে পারবে না ঢাকা। উদভূত পরিস্থিতিতে উভয় সংকটে বাংলাদেশ। এ নিয়ে কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আসুদ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন, নানা বিশ্লেষণ আছে। আন্তর্জাতিকভাবেও এ নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। সেখানে দুশ্চিন্তা আছে, আশাও আছে। তবে পরিস্থিতি এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি। আশা করি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।