মন্ত্রী মহোদয়ের হরিলুট তত্ত্ব ও হাওরপাড়ের বাস্তবতা
হাসান হামিদ-
আমরা সাধারণ মানুষ যারা; যারা রাজনীতি বুঝি না, চামচামি করি না, বিশ্বাস করি যে যাই বলেন, তাদের কপালে প্রতিদিন কী জুটে আজকাল? রাতের দুঃস্বপ্ন আমাদের কাতর করে, জলহীন নিজস্ব নদীতে আমরা স্নান সেরে বলি, আহা! এই তো জীবন। খুব মন খারাপ হয়, যখন বড় মানুষগুলো আমাদের এটা-সেটা বুঝাতে আসেন। বড়দের ছোট মিথ্যাচার; আমরা ধরেই নিয়েছি স্বাভাবিক, কিন্তু যখন সেটা দেয়ালে ঠেকানো পিঠে এসে লাগে, তখন চুপ হয়তো থাকি; কিন্তু রাতে ঘুম হয় না আমাদের। চালের দাম বাড়ার কারণে যখন একবেলা খেয়ে শুনি দাম নাগালে, তখন ভাবি, আমরাই তবে অযোগ্য। পাঁচ টাকা বাঁচাতে আমরা যখন অর্ধ মাইল হাঁটি, তখন আমাদের কোটি টাকা লুট হয়। অরে তা নিয়ে জমে উঠে কৌতুক। এবার লুট আর হরিলুট এর গল্প বলবো।
সিপিডি গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বন্যা-২০১৭ : ক্ষয়ক্ষতির হিসাব ও বন্যা–পরবর্তী ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে। খবরে দেখলাম, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এতে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বন্যা-পরবর্তী সংস্কারকাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে, তবে হরিলুট হবে না।’ আসলেই তো, হরিলুট তো হয়নি। এ সংলাপে দেশের বন্যা, দুর্যোগ ও পানিবিশেষজ্ঞরা বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনকাজে কৃষি খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি মন্ত্রীরা বাঁধ নির্মাণ বা মেরামতের কাজে দুর্নীতির বিষয়ে সজাগ থাকতে বলেছিলেন। সংলাপে সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ইঁদুরে বাঁধ কাটার কারণে, নাকি মেরামত ত্রুটির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হলো—তা ভেবে দেখার জন্য পানিসম্পদমন্ত্রীকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আমাদের মাননীয় মন্ত্রী অন্য কথা বলেন, ‘বন্যা–পরবর্তী সংস্কারকাজ নিয়ে লুটপাট হতে পারে, তবে হরিলুট হবে বলে আমি মনে করি না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজে কোনো দুর্নীতি হয় না—এমন কথা আমি বলব না। কিন্তু দুর্নীতির কারণে বাঁধ ভেঙে বন্যা হয়েছে, এটা আমি মানতে রাজি না।’ মানে কী? তাহলে কী কারণে বাঁধ ভেঙেছিলো?
এবার বাংলা অভিধান অনুযায়ী হরিলুটের চেয়ে লুট বা লুটপাট শব্দটি অধিক বিপজ্জনক কিনা সেটা একটু দেখি। দেখা যাচ্ছে, মন্দিরে সংকীর্তনের পর ভক্তদের উদ্দেশে যে বাতাসা বিলানো হয়, তাকে হরিলুট বলে। সেবায়েতরা বাতাসা না বিলালে কেউ তার কাছ থেকে লুট করে নেয় না। আর লুট হলো অন্যায়ভাবে কারও সম্পদ আত্মসাৎ বা ডাকাতি করা। এখানে জনগণের সম্পদের কথাই বোঝানো হয়েছে। বন্যার হাত থেকে মানুষ ও ফসল বাঁচাতে প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে যে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, তা কোথায় কীভাবে খরচ হলো সেটি জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে। কেননা এসব বাঁধ নির্মাণ বা সংস্কারের অর্থ মন্ত্রী ও পাউবোর কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের পকেট থেকে দেন না।
আরও কিছু হাস্যকর কথা তিনি বলেছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কারণে বন্যা হয়েছে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, দিনাজপুরে বাঁধের ওপরে একটি ফুলগাছ ছিল। সেটি ভেঙে গিয়ে ওই ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে বন্যা হয়েছে। দেশের অনেক এলাকায় ইঁদুর এসে বাঁধ ফুটো করে দেওয়ায় সেখান দিয়ে পানি ঢুকেছে। তাহলে আর কী! সবই প্রাকৃতিক কারণে হয়েছে বলে আমাদের শ্রদ্ধেয় মন্ত্রীই বলে দেন, তাহলে তদন্ত করে যে ফায়দা তেমন হবে না, সেটা বুঝে গেছি।
এবার একটু ইতিহাস মেলে দেখি। সুনামগঞ্জ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে আদালতে মামলা করেছিল সুনামগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতি। এতে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শাহ কামালসহ ১৪০ জনকে আসামি করা হয়েছিল। বিশেষ জজ আদালতে সমিতির পক্ষে মামলাটি করেছিলেন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল হক। বিচারক মো. মুজিবুর রহমান তা গ্রহণ করে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন। তাতে আসামিরা হলেন- পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৫ কর্মকর্তা, ৪৬ ঠিকাদার এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) ৭৮ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল- এদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে হাওরের বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে কাজ শুরুই হয়নি। অথচ বরাদ্দ করা টাকা ঠিকই তুলে নিয়ে আত্মসাৎ করা হয়েছে। সময়মতো ও মানসম্পন্ন কাজ না হওয়ার কারণেই বাঁধ ভেঙে বোরো ফসল ডুবে হাওর এলাকায় দুর্যোগ নেমে আসে। আরও অভিযোগ করা হয়, ঠিকাদাররা ৮৪টি প্যাকেজের কাজ দরপত্রের শর্ত মোতাবেক সম্পন্ন করেননি। শুধু চলতি বছর নয়, আগের বছরেও তারা একই কাজ করেছেন। পাউবো কর্মকর্তারা এ কাজে সহযোগিতা করেছেন। এর মাধ্যমে তারা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। তদন্তকালে এদের অবৈধ সম্পদ জব্দ করার আবেদনও জানানো হয়েছিল এজাহারে। আমরা যারা হাওর পাড়ের মানুষ, তারা জানি, এই অভিযোগ কতোটা সত্য।
এর আগে একই অভিযোগে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় পাউবোর ১৫ কর্মকর্তা ও ৪৬ ঠিকাদারকে (মোট ৬১ জন) আসামি করে আরও একটি মামলা করেছিল দুদক। সংস্থার পক্ষে প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক আহমদ মামলাটি করেছিলেন। তবে ওই মামলায় পিআইসির কোনো সদস্যকে আসামি করা হয়নি। এজাহারে বলা হয়েছিল, ‘গত বোরো মৌসুমে হাওরের বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। কোথাও এ সংখ্যা ২৩৯টি আবার কোথাও ২৪৬টি। পাউবোর তালিকায় ৭টি পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম উল্লেখ করা হয়নি। দুর্নীতি ও লুটপাটের শেষ পর্যায়ে এসব নম্বর ব্যবহারে কাল্পনিক নাম সন্নিবেশ করে কোটি টাকা লুটপাটের জন্য পরিকল্পিতভাবে এমন লুকোচুরি করা হয়েছে। পাউবো কর্মকর্তাদের এ কাজ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই না।’ পিআইসি প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছিল, ‘কোনো বছরই পিআইসি কর্তৃক কাজের ডিজাইন ও তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না। মামলার আসামি ৩৯টি পিআইসির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাঁধের কোনো কাজ করেননি। কাজ না করেই তারা বরাদ্দকৃত বিলের টাকা পাউবো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রূপালী ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ চার কোটি ২০ লাখ ২৭ হাজার ২০১ টাকা।’ আমরা দেখেছি, দুর্গত মানুষের পক্ষে ও দুর্নীতিগ্রস্তদের বিরুদ্ধে আইনজীবী সমিতির এ মামলাটি ইতিবাচক হিসেবে দেখছিলেন সর্বস্তরের মানুষ। সুনামগঞ্জ জেলা বারের ইতিহাসে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কোনো প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ রকম মামলা সেবারেই প্রথম হয়েছিল। খবরের কাগজ পড়ে আমারা জেনেছি, মামলাটি সুনামগঞ্জে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
গতবার বোরো মৌসুমে বোরোপ্রধান সুনামগঞ্জের হাওরে ১ লাখ ৬৭ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ হয়েছিল। চৈত্রের মাঝামাঝি সময় থেকে আগাম বন্যায় একের পর এক হাওরের বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ হাওরের ফসল। এতে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয় লাখ লাখ কৃষক পরিবার। হাওরের বাঁধ নির্মাণের দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠেন কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। দুর্গত মানুষকে দেখতে এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। তারা হাওরে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এইসবই আমরা জানি। তাহলে সেখানে লুট নাকি হরিলুট হয়েছিল, তা কিছুটা কি আমরা বুঝি না?
লেখক- গবেষক ও সদস্য, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র।