মহাসংকটাপন্ন টাঙ্গুয়ার হাওর
রিপন দে- টাঙ্গুয়ার টলটল স্বচ্ছ নীল জলরাশির মূলে রয়েছে তার নিচে লুকিয়ে থাকা জলজ উদ্ভিদ। এই জলজ উদ্ভিদ না থাকলে মহাসংকটে পড়বে হাওর। উপরের ছবিতে আলপনার মত আকা এই দৃশ্য দেখতে যতটা সুন্দর তার উল্টো তথ্য রয়েছে এই আলপনার মত চিত্রে। স্বচ্ছ পানিতে গোল গোল আলপনার মত এই বৃত্ততেই লুকিয়ে আছে টাঙ্গুয়ার হাওর বিপন্ন হওয়ার তথ্য। ১২০টি বিল নিয়ে ৯৭৮৭ হেক্টর আয়তন টাঙ্গুয়ার হাওরের। এই হাওরে ভরপুর বিপুল প্রাণ-প্রকৃতি। পানির নিচে রয়েছে হাওরের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কারেন্ট জাল, ভেটজাল, লাঠিজালসহ বিভিন্ন জাল দিয়ে প্রতিদিন ৪০০-৫০০ নৌকা দিয়ে এখানে মাছ ধরা হয়। পোনা মাছ থেকে মা মাছ সবই তারা ধরছেন। মাছ ধরার নিয়ম নীতি না মেনে মাটি ঘেষে জাল টানার কারণে হাওরের নিচে থাকা জলজ প্রাণ এবং বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গুয়ার হাওরে পানির নিচে থাকা উদ্ভিদ প্রায় ২০০ প্রজাতি মাছের বাসস্থান এবং খাদ্যের যোগান দেয়। পানির নিছে থাকা জলজ উদ্ভিদ প্রাকৃতিকভাবে পানি ফিল্টারিং করে। সেই সাথে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন রাসায়নিক দিয়ে মাছ ধরা এবং আশেপাশের জমিতে প্রচুর পরিমাণে সার এবং কীটনাশক ব্যবহার ও প্রভাব ফেলছে এই হাওরের উপর । ফলে এই হাওরটি বর্তমানে মহাসংকটে পতিত হয়েছে।
১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হাওর হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং এর থেকে উত্তরণের জন্য নানা পদক্ষেপ নিলেও বর্তমানে উল্টো সংকটাপন্ন থেকে বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। দিন রাত ৪০০-৫০০ নৌকা দিয়ে মাছ ধরার পাশাপাশি মাছ ধরতে ব্যাবহার করা হচ্ছে নিষিদ্ধ জাল। যার কারণে হাওরে পানির নিচে থাকা জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এর প্রমাণ মিলেছে ড্রোন থেকে তোলা ছবিতে। মাটি ঘেঁষে জাল টেনে মাছ ধরার কারণে টাঙ্গুয়ার পানির নিচে থাকা জলজ উদ্ভিদ নষ্ট হয়ে গেছে। জালের টানে মাটি থেকে উদ্ভিদ শিকরসহ উঠে আসছে। অক্সিজেন কমে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়েছে জলজ উদ্ভিদে জীববৈচিত্র্যে এবং মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে মারাত্মকভাবে। এ বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক কারিশমা সিনহা জানান, হাওরের পানির নিচে উদ্ভিদ থাকে যা পানিকে অটোফিল্টারিং করে। মাছ এই সব উদ্ভিদের মধ্যেই বংশ বিস্তার করে। মাছের বাসস্থান এবং খাদ্য এই উদ্ভিদকে ঘিরে। বলা যায়, মাছের আতুর ঘর এই উদ্ভিদ।
তিনি বলেন, সাধারণত হাওরের গভীরতা বেশী থাকে না। তাই যখন জেলেরা মাছ ধরার জাল টেনে হেঁচড়ে নিয়ে আসে তখন পানির নিচে থাকা উদ্ভিদ শিকরসহ চলে আসে। সেই উদ্ভিদের সাথে মাছের রেনুও চলে আসে। পরবর্তীতে শিকরসহ উপরে আসা এই উদ্ভিদ পচে পানির অক্সিজেন নষ্ট করে মাছের বসবাসের অনুপযোগী করে তুলে। নিষিদ্ধ কারেন্ট জালসহ বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে টাঙ্গুয়ার হাওরকে ধ্বংস করা হচ্ছে। পানির উপরে যে বৃত্তের মত দেখা যাচ্ছে সেটা হাওর ধ্বংসের আলামত বলতে পারেন। অন্যদিকে হাওরের জলজ উদ্ভিদসহ সামগ্রিক পরিবর্তনে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে। দিনে দিনে উষ্ণতা বৃদ্ধি পানির স্তর নিচে নামাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে যে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা থেকে উত্তরণের জন্য হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। বুয়েটের অধ্যাপক জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি যেখানে হাওরের অবস্থা ভাল, হাওরের নিচের উদ্ভিদের অবস্থান ভাল সেখানে পানির স্তর ঠিক থাকে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে যেভাবে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে তা মোকাবিলায় হাওরের জলজ বনসহ উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে। তিনি আরও জানান, হাওরের আশেপাশের এলাকার উষ্ণতা অন্য এলাকা থেকে কম থাকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দিন দিন উষ্ণতা বাড়ছে। এই উষ্ণতা মোকাবেলায় হাওরের জলজ বন এবং উদ্ভিদকে রক্ষা করত হবে।
টাঙ্গুয়ার জলাবন এবং পানির নিচের উদ্ভিদ কমে যাচ্ছে স্বীকার করে সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক জানান, হাওরটি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। আমরা মৎস্য বিভাগ থেকে মাঝে মাঝে আমরা অভিযানে যাই কিন্তু আমাদের জনবল সংকট। সরকার শত কোটি টাকা খরচ করলেও টাঙ্গুয়ার উন্নতি না হয়ে অবনতি হচ্ছে এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেন এই মৎস্য কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, ২০০০ সালে রামসার সম্মেলনে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায় টাঙ্গুয়া। এর পরিবেশ ও প্রকৃতি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ২০০৩ সালে সরকার বিশেষ ব্যবস্থাপনা শুরু করে। ৬০ বছরের ইজারা প্রথা বিলোপ করে হাওরটি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরিত হয়। ২০০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় আইইউসিএনের সহায়তায় টাঙ্গুয়া হাওরের সার্বিক উন্নয়নে প্রথম ধাপে ৬৩ কোটি টাকা বরাদ্দের ভিত্তিতে ১০ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। গৃহীত প্রকল্পের আওতায় টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী ৮৮টি গ্রামের অধিবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ, হাওর ইকোট্যুরিজম, ৫১টি বিল এলাকার পরিবেশ-প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনা, মাত্রাতিরিক্ত সম্পদ আহরণ রোধ, এলাকাবাসীর বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জনগণকে সংগঠিত করার ব্যবস্থা রেখে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, টাংঙ্গুয়ার হাওরে সরকার শত কোটি টাকার খরচ করেছে। টাকা খরচ হলেও এর ফলাফল মিলছে না। কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনো পাওয়া যায়নি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। টাঙ্গুয়ার ব্যবস্থাপনার নামে লুটপাট ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। হাওরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় রামসার কনভেনশনে বিশ্ব রামসার কমিটি ও বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নীরব।