গতকাল সন্ধ্যায় ‘দীন মোহাম্মাদ আই হাসপাতালে’ আমার চেম্বারে একটি তরুণী মা তার ৭ মাস বয়সী মেয়েটিকে নিয়ে আসলো। শিশুটি তার জন্মের এক মাস বয়স থেকে আমার রোগী। মার জমজ সন্তান দুটি মাত্র হাজার খানেক গ্রাম ওজনের কিছু বেশী ছিল, জন্ম নিয়েছিলো সময়ের অনেক আগে। যমে মানুষে টানাটানির পর ভাইটি হেরে যায় বেঁচে থাকার যুদ্ধে। বোনটি বেঁচে গেলেও তার চোখের রেটিনা পরিপূর্ণভাবে গঠিত হয়নি আশঙ্কা থাকায় আমার কাছে পাঠানো হয় – যেহেতু আমি চোখের রেটিনার ডাক্তার এবং শিশুদের রেটিনার এই সমস্যার (ROP) জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত।

আমি দেখলাম সমস্যা খুবই গুরুতর। তার ROP-র সবচেয়ে মারাত্মক টাইপটাই হয়েছে – APROP। অন্যান্য এমন শিশুর তুলনায় এই বাচ্চাটার সমস্যা ছিল কিছুটা বেশী কঠিন। চোখে Anti-VEGF ইনজেকশন ও লেজার করার পরও বাড়ছিল এবং এক সময় আশঙ্কা জেগেছিল আদৌ চোখের দৃষ্টি টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা। দ্বিতীয় দফা লেজারের পরে চোখের রেটিনার সমস্যার সমাধান হল। এমন বাচ্চাদের visual field কমে আসে এবং প্রায়শই মোটা চশমা পড়তে হয়। সেই কাউন্সেলিং করা ছিল। কালকে চেম্বারে শিশু চক্ষু রোগ বিশেষজ্ঞ বাচ্চাটার চোখের cycloplegic refraction করে জানালেন যে, তার দৃষ্টি স্বাভাবিক ও কোন চশমাও লাগবে না।

যে শিশুটির চোখ অন্ধ হবার দ্বারপ্রান্তে ছিল তার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক দৃষ্টি পাবার কথা শুনে মা নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পরলেন। বার বার বলতে লাগলেন, “আপনার জন্য আমি সারাজীবন প্রতি ওয়াক্তের নামাজে দোয়া করবো।” মনে পড়লো এমন কথা আমাকে আরেক মাও আগে একবার বলেছিলেন। আমার মনটা এক এক অপার্থিব সুখে ভরে গেল। এর চেয়ে বেশী সঞ্চয় জীবনে আর কি লাগে? আমরা চিকিৎসকরা আসলে অনেক ভাগ্যবান। প্রতিদিন প্রতিটি ডাক্তার কত মানুষের জন্য কত কিছু করার সুযোগ পাই, কত মানুষের ভালবাসা ও দোয়া পাই। মায়ের কান্নায় আমারও চোখে পানি চলে এলো। মা ও তার শিশুর দিকে তাকিয়ে মনে হল, ওরাও জানে না ওদের সেবা করার এই সুযোগ আমাদের জন্যও কত বড় আশীর্বাদ। কবি গুরুর গানের বাণীতে বলি, “আমার জীবন পাত্র উচ্ছলিয়া মাধুরী করেছো দান- তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই, তুমি জানো নাই তার মূল্যের পরিমাণ।”

পাদটীকা:

১. মা বললেন, “আপনার সাথে ওর একটা ছবি তুলে রাখি?” আমি সানন্দে রাজী হলাম ও নিজেও ওর সাথে একটা ছবি তুললাম। মা-বাবার কাছে অনুমতি নিয়েই বাচ্চাটার ছবি দিলাম।

২. ROP (Retinopathy of Prematurity) হচ্ছে মাতৃগর্ভে ৩৫ সপ্তাহ পূর্ণ করার আগে জন্মানো এবং/অথবা ২০০০ গ্রামের নীচে শিশুদের চোখের রেটিনার গঠনগত অপরিপক্কতার জন্য একটি মারাত্মক অসুখ – যা ৩০ দিনের মধ্যে চিকিৎসা না করলে শিশুটি অন্ধ হয়ে যায়। এই সমস্যাটা বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না। Criteria-র মধ্যেও কোন বাচ্চাটার ROP হবে আর কার হবে না – তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই Criteria-র মধ্যে পড়ছে এমন সব বাচ্চাদের Screening অত্যাবশ্যকীয়। যাদের আমরা জন্মান্ধ বলি তাদের অনেকেই হয়ত সময় মত (জন্মের ৩০ দিনের মধ্যে) Retina Specialist /ROP specialist-এর কাছে আসলে স্বাভাবিক দৃষ্টি পেতো। কি আফসোসের কথা, তাই না?

৩. ROP-র screening অনেকদিন ধরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ব বিদ্যালয়, জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সিটিটিউট, বারডেম, ইস্পাহানী ইসলামিয়া আই হসপিটালে এবং বিভিন্ন প্রাইভেট চক্ষু হাসপাতালে হচ্ছে। চট্টগ্রামেও পাহারতলীর (CEITC) হাসপাতালে হচ্ছে। সফল ভাবে এর সব পর্যায়ের চিকিৎসা হচ্ছে বাংলাদেশে। শুধু প্রয়োজন সময় মত referral অর্থাৎ সময়মত Retina Specialist /ROP specialist-এর কাছে পাঠানো। এ জন্য চাই শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ, স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা ও অভিভাবকদের সচেতনতা।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn