মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভায়োলেন্স দেখে
তসলিমা নাসরিন::সবার হাতেই মোবাইল ফোন। যা কিছু মধুর, যা কিছু তিক্ত – সবকিছুর ছবি কেউ না কেউ তুলে রাখছে। এই ছবিগুলো আজকাল অন্তর্জালে ভেসে বেড়ায়। চোখে পড়ে ভায়োলেন্সের ছবি। দু’দিন স্কুলে যায়নি বলে বাবা তার ছেলেকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে, রান্নায় নুন হয়নি বলে স্বামী তার স্ত্রীকে নির্মমভাবে পেটাচ্ছে অথবা পণের টাকা দেয়নি বলে পেটাচ্ছে, ভিখারি ছেলেকে দু’চার টাকা চুরির দায়ে পেটাচ্ছে কেউ, পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলছে, লোকেরা যৌন হেনস্থা করছে মেয়েদের যেহেতু বিশ্বাস করে যৌন হেনস্থা করার অধিকার তাদের আছে, ব্যাভিচারের দায়ে এক পাল ধর্মান্ধ পাথর ছুঁড়ে মুসলিম মেয়েদের মারছে, ধর্মের সমালোচনা করেছে বলে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে মারছে মুক্তচিন্তককে। মানুষ দেখছে, কিন্তু চুপ করে আছে। মানুষ ভিড় করে দেখছে। কিন্তু কিছু বলছে না। ভায়োলেন্স করছে একজন বা দু’জন। দেখছে দু’শ জন, এই দু’শ জনও দু’জনকে থামাচ্ছে না। দু’শ জনের মধ্যে শিশুও আছে, দু চোখ মেলে শিশুরাও দেখছে বর্বরতা, দেখে ভয়ে চিৎকার করছে না বা দৌড়ে পালাচ্ছে না। কারণ ভায়োলেন্স দেখতে দেখতে শিশুরাও অভ্যস্ত। প্রাপ্ত বয়স্করাও কখনও ভায়োলেন্স থামাতে চেষ্টা করে না। যেন দূর থেকে দেখাই তাদের কাজ।
সেদিন দেখলাম সবুজ ধানখেতের পাশে পড়ে থাকা লালা জামা পরা বিউটি আক্তারকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পনেরো কুড়িজন পুরুষ। বিউটির মরে পড়ে থাকা দেখছে। যদি বিউটি আক্তারকে বাবুল নামের লোকটি ধর্ষণ করছে এমন অবস্থায় দেখতো ওরা, একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার মনে হয় না কেউ বাধা দিত ধর্ষককে। খুন করতে দেখলেও মনে হয় না বাধা দিত। একশ’ লোকের মধ্যে একজনও যাবে না খুনির হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে। অন্যায় অবিচার দেখতে দেখতে, অত্যাচার নির্যাতন দেখতে দেখতে, খুন-ধর্ষণ দেখতে দেখতে বেড়ে উঠছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। চুপচাপ দেখাটাই শিখছে, রুখে ওঠাটা শিখছে না।
সবাই নিরাপদ দূরত্বে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে যায়। এইসব ভায়োলেন্স শিখে নিজেরা যখন ভায়োলেন্স করবে, তখন তারা চাইবে মানুষও দূরে দাঁড়িয়ে ভায়োলেন্স দেখুক। আজকাল ভায়োলেন্সটা বড় জলভাত হয়ে গেছে। বড় সংক্রামকও। কেউ বাধা দেয় না? যেহেতু ভায়োলেন্স যে করছে, সে পুরুষ, যেহেতু পুরুষের পেশিতে জোর আছে! হাতে যদি ছুরি কাঁচি কিছু থাকে, তাহলে তো আর কথাই নেই, কেউ ধারে কাছে ঘেষার সাহস করে না। মনে আছে কত মানুষের চোখের সামনে বদরুল নামের এক লোক তার এক প্রেমিকাকে কুপিয়ে মেরেছিল দিন দুপুরে! কেউ বাধা দেয়নি বদরুলকে। এই বাধা না দেওয়া মানুষগুলোর আরেক নাম সম্ভবত ‘দেশ’। দেশ ক্রমশ নির্বিকার হয়ে উঠছে। ভায়োলেন্স এখন আর দেশকে, দেশের কোনও মানুষকে অবাক করে না।
চলন্ত রেল গাড়ির তলায় ফেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে সেদিন মেরে ফেলা হয়েছে। ওর কাটা মাথা ছিটকে পড়েছে, এদিক ওদিক টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে পা হাত পেট। পড়ে আছে মেয়েটির ব্যাগ, ব্যাগের বই খাতা। এসব দেখতে দেখতে আমরা অভ্যস্ত হচ্ছি। কেউ চোখের সামনে দেখছে, আর কেউ দেখছে হোয়াটস অ্যাপে, ফেসবুকে, টুইটারে। অধিকাংশ মানুষের কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা ছি! ছি! করছে, তাদের যদি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় ভায়োলেন্সের সামনে, তারাও হয়তো অন্যদের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভায়োলেন্স দেখবে। মানুষ এখন গা বাঁচিয়ে চলতে শিখে গেছে। অন্যের যা হয় হোক, আমার যেন কিছু না হয়। না ভাই নাক গলাতে যাবো না, পরে আবার পুলিশ এসে হাঙ্গামা করবে। এটি কি কোনও কারণ নাক না গলানোর? যদি পুলিশি ঝামেলার ব্যাপার না থাকতো, আমার মনে হয় না কেউ ভায়োলেন্স বন্ধ করার চেষ্টা গায়ে পড়ে করতো। কারণ অন্যের বাড়ি জ্বললে আমার কী, অন্যকে পুড়িয়ে মারলে আমার কী, অন্যকে ধর্ষণ করলে আমার কী, অন্যকে মেরে ফেললে আমার কী– এই ‘আমার কী’ ভাবনাটা মানুষের মস্তিস্কের কোষে কোষে, লক্ষ করছি, সাঁতার কাটছে।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ভায়োলেন্স দেখা মানুষগুলোর মুখ দেখে আমি অনেক বার বোঝার চেষ্টা করেছি তারা কি কষ্ট পাচ্ছেন, নিরীহ মানুষের ওপর নিষ্ঠুর সবলের আঘাত দেখে তাদের মুখের রেখায় বেদনা প্রকাশ পাচ্ছে কি? না, মানুষগুলো নির্বিকার দেখছে, কারো কারো মুখে দেখেছি হাসির রেখা। যারা চুপচাপ দেখে, তারা হয়তো অত্যাচারীর পক্ষ নেয়, অত্যাচারিতের পক্ষ নেয় না। তারা অন্যায়ের পক্ষ নেয়। সে কারণেই তাদের পক্ষে দেখা সম্ভব হয় সবটা ভায়োলেন্স, শুরু থেকে শেষ অবধি। চড় থাপ্পড় থেকে খুন অবধি। তাদের রাগ ক্রোধ হয় না, তাদের চোখ বন্ধ করে ফেলতে ইচ্ছে করে না, তাদের চিৎকার করতে ইচ্ছে করে না, কাঁদতে ইচ্ছে করে না। তাদের শুধু নৃশংসতার সাক্ষী হতে ইচ্ছে করে। এই ইচ্ছেটা বড় অদ্ভুত। চোখের সামনে অপরাধ ঘটছে দেখেও কেউ পুলিশকে খবর দেয় না, মানুষ ডাকে না, যারা অন্তত অপরাধীকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করতে পারে। শুধু দেখে। অবশ্য শুধু দেখে না, কেউ হাসে, কেউ ছবি তোলে, কেউ ভিডিও করে। রাজনকে যখন পেটানো হচ্ছিল, এমনই তো ঘটেছিল। সৌদি আরবে যাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, রাস্তার মাঝখানে তাদের বসিয়ে এক এক করে মুণ্ডুগুলো তরবারির এক এক কোপে উড়িয়ে দেয় জল্লাদেরা। আমি ভেবেছিলাম, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীরা মুণ্ডু কাটার ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ডুকরে কেঁদে উঠবে। কিন্তু না, কেউ কাঁদে না। বরং সকলে উল্লাস করে। খুন খারাবি দেখতে মানুষ যে কী বীভৎস আনন্দ পায়!
কেন নিরীহ অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে না মানুষ! এর কারণ, যারা দাঁড়িয়ে অপরাধ ঘটতে দেখে, তারা বেশিরভাগই বুঝতে পারে না যে যা ঘটছে তা অপরাধ। বুঝতে পারে না তারা একটি ভয়ঙ্কর অপরাধের সাক্ষী। সম্মিলিত অজ্ঞতা বলে একটি জিনিস আছে, এই অজ্ঞতার কারণেই কেউ বাঁচায় না অত্যাচারিতকে। ধরা যাক, ভিড়ের কেউ বুঝতে পেরেছে অপরাধ ঘটছে, বুঝতে পেরেছে অপরাধ ঘটা উচিত নয়, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকা অন্যদের লক্ষ করে, অন্যরা কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না সাহায্য করতে, তখন নিজে একা এগিয়ে গেলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াবে ভাবে। ভাবে লোকেরা সবাই হয়তো হাসবে তাকে দেখে, তাকে সবার মধ্যে খুব বোকা বোকা লাগবে দেখতে। ভায়োলেন্স বন্ধ করতে সে কারণেই কেউ এগোয় না, এগোতে চাইলেও এগোয় না। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর, যাকে মারা হচ্ছে, যে কোনও সময় তার মৃত্যু হতে পারে, এমন সময় জরুরি ভিত্তিতে কিছু একটা করতে হবে, অত্যাচারীর হাত থেকে লাঠিটা বা চাকুটা কেড়ে নিতে হবে, আর দ্রুত পুলিশে খবর দিতে হবে। এই ব্যাপারগুলো করার উদ্যোগ নিলে লোকে যদি বলে এ কোনও সিরিয়াস ব্যাপারই না, মেরে খানিকটা শিক্ষা দিচ্ছে রাজনকে, বা বিশ্বজিতকে, এরকম যে একজন ভাবে তা নয়, অনেকেই হয়তো ভাবে। অনেকেই তাই চুপ থাকে।
আবার দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে থাকলে দায়িত্ব হালকা হয়ে যায় । একজন যদি কোনও অপরাধ ঘটতে দেখে, তাহলে তার ঘাড়ে শতকরা ১০০ ভাগ দায়িত্ব এসে পড়ে অপরাধীর হাত থেকে নিরপরাধকে বাঁচানোর। যদি বাঁচায়, সে-ই বাঁচায়, অন্তত চেষ্টা করে। পাঁচজন যদি সাক্ষী কোনও অপরাধের, তাহলে একেকজনের ঘাড়ে দায়িত্ব এসে পড়ে ২০ ভাগ। ১০০ ভাগে আর ২০ ভাগে তফাত অনেক। আর ১০০ জন যদি দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে, তাহলে একজনের ওপর দায়িত্ব ১ ভাগ। তখন ওই ১ ভাগ হালকা-দায়িত্ব নিয়ে কেউ পা বাড়ায় না কাউকে বাঁচাতে। ভাবে, নিশ্চয়ই আমার চেয়ে ভালো কেউ আছে বাঁচাবার, আমার চেয়ে বেশি যোগ্য, বেশি বুদ্ধিমান। আমি কেন, তারাই এগিয়ে যাক। এই জন্য দেখা যায়, ভিড়ের লোকেরা অসহায়কে সাহায্য করে না।
ধরা যাক একটি পাউরুটি চুরি করার অপরাধের জন্য কোনও লোক একটি বাচ্চা ছেলেকে লোহার পিলারের সঙ্গে হাত পা বেঁধে মারছে, ভয়াবহ মারের চোটে ছেলেটি রক্তাক্ত হচ্ছে, আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন, আপনার মতো ১০০ জন দাঁড়িয়ে দেখছে। এখন আপনি সবার চেয়ে আলাদা, আপনি দাঁড়িয়ে না থেকে ছেলেটিকে বাঁচাতে চাইলেন, তখন কিন্তু ভিড়ের লোকদের বললে চলবে না, চলুন ছেলেটিকে বাঁচাই, তাহলে কেউ এগোবে না। ভিড় কাউকে সাহায্য করে না। ভিড় নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে থাকে। ভালো হয়, আপনি যদি কাউকে, কারো চোখের দিকে তাকিয়ে নির্দিষ্ট করে বলুন এগিয়ে আসতে, তাহলে বরং বাচ্চা ছেলেটিকে বাঁচানোর জন্য একজন ব্যক্তির সাহায্য আপনি পেলেও পেতে পারেন। মানুষ ভাবে যত বেশি লোক ভায়োলেন্স দেখবে, তত তাড়াতাড়ি ভায়োলেন্স বন্ধ হবে। আসলে উলটো, যত বেশি লোক ভায়োলেন্স দেখবে, তত বেশি বাধাহীন ভাবে ভায়োলেন্স এগোবে। একটি লোক একটি মেয়েকে মারতে মারতে মেরে ফেলবে, একটি লোক একটি বাচ্চাকে মারতে মারতে মেরে ফেলবে, একটি লোক আরেকটি লোককে মারতে মারতে মেরে ফেলবে– মানুষ ভিড় করে শুধু দেখবে।
মানুষের চোখের সামনেই তো কত কেউ মরে যাচ্ছে প্রতিদিন। আমরা দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ। মানুষের মধ্যে এই বোধটুকু এখনই জাগিয়ে তুলতে হবে যে, যখনই কোথাও দেখবে মানুষ ভিড় করে কোনও অপরাধ ঘটছে দেখছে, তখনই অপরাধ বন্ধ করার জন্য ১০০ ভাগ দায়িত্ব নিয়ে নিতে হবে। এভাবে নিস্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থেকে আমরা একটি অপদার্থ, স্বার্থপর, সংকীর্ণ, ভীরু সমাজ তৈরি করছি, যে সমাজটার দিকে তাকালেও ঘেন্না হবে। মনে রাখতে হবে নির্যাতনের শিকার একদিন আপনিও হতে পারেন। তখন ভিড় করে যারা দেখবে আপনাকে কী করে নির্যাতন করা হচ্ছে, চিৎকার করে তাদের সাহায্য চাইবেন, তখন কিন্তু কেউ আপনাকে সাহায্য করতে আসবে না! তার চেয়ে এখন থেকেই মানুষ মানুষকে দুরবস্থা থেকে বাঁচাবে, এমন প্রতিজ্ঞা করি না কেন!
লেখক: কবি, সাহিত্যিক, মুক্তচিন্তক, নারীবাদী, মানববাদী, ডাক্তার