আনিস আলমগীর-একটি বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন ৯২ বছরের মাহাথির মোহাম্মদ। আমার কাছে বিস্ময়টা তার ৯২ বছর বয়স নয়, কারণ দূরে যাওয়ার দরকার নেই, আমাদের শেরে বাংলা ফজলুল হকও এমন ইতিহাস রেখেছেন। কিংবা মাহাথির ২২ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে ১৬ বছর পর আবার ফিরে আসাও নয়। আমার কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ময় হচ্ছে তিনি তার আগের দল/জোট নয়, ক্ষমতায় ফিরেছেন তার প্রতিপক্ষ জোটের নেতা হয়ে।আরও সহজ করে বলি। মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে আমরা এখন মাহাথির মডেল হিসেবে কল্পনা করছি বাংলাদেশের শাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে, তিনি ২২ বছর একটানা প্রধানমন্ত্রীত্ব করে অবসর নিয়েছেন। দিন কেটে যাচ্ছে। তারই শিষ্যরা পালা করে ২ বার ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু তিনি দেখলেন দুর্নীতি বেড়ে গেছে, দলের অবস্থা খারাপ, আর নতুন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় তহবিল তসরুফ করছেন। দলে ওনার আর পাত্তাও নেই। শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন পুরনো বন্ধু-বান্ধব সহকর্মীদের নিয়ে নতুন একটা দল করবেন। করলেন। আর নির্বাচনে বিজয়ের জন্য তারই আওয়ামী লীগের চির প্রতিপক্ষ বিএনপি-জোটের সঙ্গে মিলে সেই জোটের নেতা হয়ে নির্বাচন করলেন এবং জয়ী হয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন। বয়স তখন তার ৯২। প্রধানমন্ত্রী হয়ে যাকে তিনি জেলে রেখেছিলেন আগে, নতুন করে প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং দুই বছর পর তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বাংলাদেশে এমনটা ঘটলে যেমন হতো মালয়েশিয়ায় সে রকম একটি বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে এবং তারই জন্ম দিয়েছেন মাহাথির মোহাম্মদ নামক পশ্চিমাবাদের চোখে স্বৈরাচারী আর নিজ দেশের উন্নয়নের কাণ্ডারি বিবেচিত লোকটি।

গত বুধবারের নির্বাচনে প্রমাণিত হলো যে কারও সৎ ও মহৎ কর্ম হারিয়ে যায় না। মাহাথির দীর্ঘ ছয় দশক ক্ষমতায় থাকা নিজের পুরনো দলকে পরাজিত করতে নতুন জোটে যোগদান করেছিলেন মাত্র দেড় বছর আগে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় আমরা অনুরূপ কিছু নেতার সাক্ষাৎ পাই যারা ‘হইয়াও হইল না শেষ’। ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণকে তার দেশের লোক বার্কানু বলে ডাকতো। বার্কানুর অর্থ হলো ‘বাবা’। জাকার্তার পতিতালয়ের পতিতারা নাকি বালিশের নিচে বার্কানুর ছবি রাখতো কারণ তারা বিশ্বাস করতো সকালে ওঠে বার্কানুর মুখ দেখলে আয়-রুজি ভালো হবে।শুরুতে শেরে বাংলার কথাও বলেছিলাম। হ্যাঁ, ৯২ বছর বয়সে উনিও এমন এক বিস্ময় দেখিয়েছেন বাংলার মাটিতে। বাংলাদেশের শেরে বাংলা ফজলুল হক দীর্ঘ ১৫ বছর রাজনীতি থেকে নির্বাসনে থাকার পর ১৯৫৪ সালে যখন মুসলিম লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কৃষক শ্রমিক পার্টি আর আওয়ামী লীগ অন্যান্যদের নিয়ে যুক্তফ্রন্ট করে গর্জে উঠলেন তখনও এদেশের মানুষ ৯২ বছর বয়সের শেরে বাংলাকে বিস্মৃত না হওয়ার প্রমাণ দিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন লাভ করেছিল। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয়; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়। এ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত ছিল। প্রধানমন্ত্রী হন শেরে বাংলা ফজলুল হক।  বাংলার মানুষ তাকে ফিরিয়ে এনে সেই সম্মান দিয়েছিল কারণ বাংলার মুসলমানকে শিক্ষায় দীক্ষায় গড়ে তোলার ব্যাপারে শেরে বাংলার অবদান ছিল কিংবদন্তির মতো। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ, মুসলমান ছাত্রদের থাকার জন্য বেকার্স হোস্টেল তিনিই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অবৈতনিক প্রাইমারি শিক্ষাতো তারই অবদান। ঋণ সালিশি বোর্ড করে বাংলার মুসলমানদের হিন্দু মহাজনের চক্রবৃদ্ধি সুদের হাত থেকে রক্ষা না করলে মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা না করলে মুসলমানদের হাতে তো জমি জিরাত কিছুই থাকতো না।

‘সৎ কর্ম, মহৎ কর্ম কখনও হারিয়ে যায় না’। মাহাথিরকেও হারিয়ে যেতে দেয়নি মালয়েশিয়ার জনগণ তার কাজের জন্য। তাকে আবার প্রধানমন্ত্রী করেছে তারা। মাহাথির মোহাম্মদ ২২ বছর (১৯৮১-২০০৩) প্রধানমন্ত্রীত্ব করার পর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন। তারপর প্রধানমন্ত্রী হন আবদুল্লাহ্ আহাম্মদ বাদাবি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের নির্বাচনি ফলাফল খারাপ হলে মাহাথির বাদাবির তীব্র সমালোচনা করেন এবং বাদাবি পদত্যাগ করেন। তখন নাজিব রাজাক প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৮ সাল থেকে নাজিব রাজাক মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।১০ মে বৃহস্পতিবার মাহাথির মোহাম্মদ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপৎ গ্রহণের পর দীর্ঘ ছয় দশক ক্ষমতা ভোগ করার পর ‘ইউনাইটেড মালয়িস ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন’ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ালো। ২০১৬ সালে মাহাথির পার্টির মাঝে অপ্রসাঙ্গিক হয়ে যাওয়ার পর কিছু প্রবীন বন্ধু বান্ধব নিয়ে নতুন দল করে বিরোধী পাকাতান হারাপান জোটে যোগদান করেছিলেন। পাকাতান হারাপানের নেতা হচ্ছেন আনোয়ার ইব্রাহীম। বর্তমানে তিনি জেলে আছেন। পাকাতান হারপানের অর্থ হচ্ছে ‘আশার জোট’। আনোয়ার ইব্রাহীম যে অভিযোগে জেল খাটছেন সে সমকামিতার অভিযোগও এনেছিলেন মাহাথির মোহাম্মদ। তখন তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। আনোয়ার ইব্রাহীম, বাদাবি, নাজিব রাজাক এরা কিন্তু সবাই এক সময়ে মাহাথিরের লেফটেনেন্ট ছিলেন। মাহাথির মোহাম্মদ এবং আনোয়ার ইব্রাহীম দু’জনেই এক সময় এ জোটের সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং উপ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মাহাথির তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে জেলে দিয়েছেলেন। আনোয়ার ইব্রাহীম আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই জেল থেকে ছাড়া পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিন বছর আগে সমকামিতার জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত ইব্রাহীমকে সম্পূর্ণ ক্ষমা করে দিতে রাজি হয়েছেন দেশটির রাজা। মাহাথির মোহাম্মদ আরও বলেছেন, তিনি আগামী দু’বছরের মধ্যে পদ ছেড়ে দেবেন এবং তখন আনোয়ার ইব্রাহীমই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন।

কয়েকজন ছোট ছোট রাজার রাজ্য নিয়ে মালয়েশিয়া গঠিত, ১৯৫৬ সালে ব্রিটিশের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে রাজারা নিজেদের রাজ্যগুলোর অস্তিত্ববিলোপ করে মালয়েশিয়া গঠন করেছিলেন। রাজাদের একটা কাউন্সিল অব কিংস্ রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এক একজন রাজা পাঁচ বছরে জন্য রাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হয়ে থাকেন। দেশে নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জারি রয়েছে।  নির্বাচিত পার্লামেন্টই রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২২২ জন।  মাহাথির মোহাম্মদের জোট নির্বাচনে ১১৩ সিট পেয়েছে।  মালয়েশিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক হচ্ছে মালয়ান, তারা মুসলমান। মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশি অরিজিন লোক বলে একটি কথা প্রচলিত আছে।  তাদের বাড়ি চট্টগ্রামের আমিন জুট মিলের পূর্ব পার্শ্বে।  তার দাদা নাকি জাহাজে চাকরি করতেন।  তিনি জাহাজ থেকে নেমে মালয়েশিয়ায় থেকে যান এবং স্থানীয় মেয়ে বিয়ে করেন। মাহাথির একবার বাংলাদেশ সফরের সময় তার পিতৃপুরুষের ভিটা দেখতে গিয়েছিলেন। মাহাথির ২২ বছর ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের ভাগ্য পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিলেন। মালয়েশিয়ায় প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য্য রয়েছে। তাদের প্রধান উৎপাদিত দ্রব্যের মাঝে রাবারই প্রধান। বিশ্বের ১৩ অংশ রাবার উৎপাদন হয় মালয়েশিয়ায়। বিশ্বের সর্বাধিক পাম্প অয়েল উৎপাদন হয় মালয়েশিয়ায়। ভোজ্য তেল হিসেবে সয়াবিনের মতো পাম্প ওয়েলেরও বিশ্ব বাজার রয়েছে।  পাম্প ওয়েল সয়াবিন ওয়েল থেকে সস্তা। দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানের মতো মালয়েশিয়াও এখন শিল্প সমৃদ্ধ দেশ।  শিক্ষা ব্যবস্থাও উন্নত হয়েছে।  বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বহুদেশে থেকে ছাত্র যায় লেখাপড়া করার জন্য। মাহাথিরের ২২ বছরের শাসনের সময় তার বিরুদ্ধে এক নায়ক সূলভ আচরণের অভিযোগ ছিল।  তিনি দেশের নিরবিচ্ছিন্ন উন্নয়নের জন্য বিরোধী দলকে কখনও বেশি রাজনীতি করার অবকাশ দিতেন না।তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের উন্নয়ন করতে হলে ক্ষমতার কনটিনিউটি দরকার আর দেশে রাজনৈতিক শৃঙ্খলারও প্রয়োজন।  এবার তিনি দুর্নীতির ওপর বিরক্ত হয়ে ক্ষতায় রদবদল ঘটালেন।  দেখা যাক। তিনি কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।  নাজির রাজাকের চেয়ে ভালোভাবে দেশ চালাতে পারবেন তাতে প্রত্যেক বিশ্লেষক একমত। তবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দিয়ে পুনরায় একনায়ক সুলভ আচরণ করে কিনা কে জানে।

লেখক: সাংবাদিক

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn