মুক্তিপণের টাকা দিতে না পারায় দেশে ফিরতে পারছেন না নাসিমা
চলতো সংসার। অভাবের সংসারে কিছু অর্থের যোগান দিতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। রাত-দিন ভাবতে থাকেন কি করা যায়। মিরপুরেই পরিচয় হয় ঢাকার এক ট্র্যাভেলস এজেন্সির কর্মকর্তার স্ত্রীর সঙ্গে। অল্প কয়েকদিনেই নাসিমার সখ্য গড়ে উঠে তার সঙ্গে। নাসিমা নিজের অভাব-অনটনের সব কথাই তার সঙ্গে শেয়ার করেন। পরে সেই মহিলা পরিচয় করিয়ে দেন বারিধারার হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অফিসে। তাদের মাধ্যমেই নিজের স্বপ্নপূরণে পাড়ি জমান সৌদি আরবে। সেখানে গিয়ে স্বামী মাখন মিয়াকে কাজে যোগদানের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। বেশ ভালোভাবেই যায় এক মাস। কিন্তু এক মাস পরেই তার উপর শুরু হয় নানা হেনস্তা। এই বাসায় দু’দিন আরেক বাসায় এক সপ্তাহ। এভাবে অন্তত ৮ থেকে ১০ টি বাসায় তাকে পাঠানো হয় গৃহকর্মীর কাজে। সেই সঙ্গে কারণে-অকারণে করা হয় নির্যাতন। প্রতিটি বাসার গৃহকর্তারাই তাকে নির্যাতন করেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়। হাতের আঙ্গুলের নখ ফাটিয়ে দেয়া হয়। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করা হয়। এভাবেই চিকিৎসা ছাড়াই চলে আরো কিছুদিন। তারপরও তারা থামেনি। একপর্যায়ে অসুস্থ নাসিমাকে নিয়ে যায় তারা মরুভূমি এলাকায়। কোন ঘর বাড়ি ছাড়া একটি এলাকায় কয়েকটি সারিবদ্ধ অন্ধকার ঘরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। সেখানে নাসিমা ও আরো দুইজন মহিলাকে একসঙ্গে রাখা হয়। সারিবদ্ধ অন্য ঘরগুলোতে এ রকম অনেক মহিলাকে আটকে রাখা হয়েছে। তারা সবাই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে গেছেন কাজের সন্ধানে। কিন্তু দেশের দালালরা খরচ ছাড়া তাদের বিদেশে পাঠানোর নামে বিক্রি করে দিয়েছেন সৌদি আরবের দালালদের কাছে। আর এখন দালালরা তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করছে। দালালদের উদ্দেশ্য একটাই, মারধর করে গৃহকর্মীদের কাছে থেকে টাকা আদায়। যে টাকা দিতে পারছে সে মুক্তি পাচ্ছে। আর যে টাকা দিতে অপারগতা দেখাচ্ছে তার জীবনে নেমে আসছে নির্মম নির্যাতন। বিভিন্ন বয়সী এসব মহিলাকে অমানসিক নির্যাতন করে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। লোহার রড, কাঁচের টুকরা, লোহার তালা, প্লাস্টিকের শক্ত পাইপ, কাঠের লাঠি দিয়ে তাদের মারধর করা হচ্ছে। এমনকি ড্রিল মেশিন দিয়ে অনেকের হাত ফুটো করেছে। শরীরের অনেক স্থানে আগুনের ছেঁকা দিয়ে এবং গরম পানি দিয়ে ঝলসে দিয়েছে। এক দুইদিন পর পর একটা শুকনা রুটি দেয়া হয় তাদের। চাইলে এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত পাওয়া যায় না।
বাঁচা-মরার লড়াইয়ে থাকা নাসিমার একটি গোপন মোবাইলে সে তার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তুলে ধরছে পাষণ্ডদের নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। নাসিমার স্বামী মাখন মিয়া জানান, অভারের সংসারে কিছুটা সাহায্যর জন্য স্ত্রীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে স্ত্রীকে ফেরত পাবেন কিনা। কারণ যাদের মাধ্যমে নাসিমা বিদেশে গিয়েছেন তারা এখন ফোন রিসিভ করে না। যোগাযোগের অনেক চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে নাসিমা বিদেশ থেকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বার বার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। সে বলছে তাকে বাঁচানোর জন্য। ওরা তাকে মেরে ফেলবে। পশুর মতো ব্যবহার করছে তার সঙ্গে। মুক্তিপণের টাকার জন্য একটু পর পর নির্যাতন চালায়। মাখন মিয়া আরো জানান, সৌদি আরব থেকে স্ত্রীর এমন বাঁচার আকুতি শুনে কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কি করবেন তিনি কিছু ভেবে পাচ্ছেন না। ঘরে ছোট ছোট প্রাইমারি স্কুলপড়ুয়া দু’টি সন্তান। মায়ের জন্য শুধুই কান্নাকাটি করছে। একদিকে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে রাখতে হচ্ছে। আবার অন্যদিকে স্ত্রীর মুক্তিপণের টাকার জন্য দৌড়াদৌড়ি। টানাটানির সংসারে খেয়ে পরে চলাই যেখানে দায় সেখানে মুক্তিপণের ২ থেকে ৩ লাখ টাকা তিনি কিভাবে ব্যবস্থা করবেন। এজন্য তিনি একবার ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গে আবার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে যাচ্ছেন। তিনি জানান, ট্রাভেলসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। তারা আজ আসবে কাল আসবে এ রকম বলছে। এমনকি তারা কিছু টাকা দেয়ার কথা বলছে। টাকা দিলে নাকি খুব তাড়াতাড়ি নাসিমাকে দেশে ফেরত আনা যাবে।