মুক্তিযুদ্ধের কোনো বিকল্প ছিল না
হেলাল হাফিজ:: আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মূল আকাঙ্খার বীজ রোপিত হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য এতোটাই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ছিল যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদসহ সবকিছু লুটপাট শুরু করলো— গুলি করে আমাদের মারতে লাগলো। যদিও অখণ্ড পাকিস্তানে আমরা ছিলাম সংখ্যাগরিষ্ঠ। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকজন আমাদের সঙ্গে বৈরী মনোভাব দেখাতো, সেইভাবে আচরণও করতো। শুধু তাই না অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের দাবিয়ে রেখেছিল। শোষণ আর শাসনে তো রূঢ়ভাব ছিলই।
বাঙালির রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের আকাঙ্খার মধ্য দিয়ে আমাদের অধিকারের দাবি প্রথমবারের মতো প্রতিষ্ঠিত হলো। এরই ধারাবাহিকতায় ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ছয় দফার মধ্য দিয়ে আমাদের নিজেদের দেশ— আমাদের ভূমির দাবিটি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠলো। আসলে দাবিটি ছিল পূর্ণ সায়ত্তশাসনের। ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’— এমন শ্লোগান তো আর একদিনেই জন্ম নেয়নি। ধীরে ধীরে এই শ্লোগান এক মানুষ থেকে আরেক মানুষে, এভাবে আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেই দাবিগুলো না পাওয়ায় আমাদের ক্ষোভ আরো বাড়তে লাগলো। মানুষ হতে থাকলো আরো সংগঠিত।
অধিকাংশ মানুষ এই আকাঙ্খার পক্ষেই ছিল। কিছু কিছু মানুষ এটার বিরোধিতা করেছে। এই আকাঙ্খার সঙ্গে, এই আন্দোলনের সঙ্গে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী মানে শিল্পী সমাজ— সৃজনশীল সমাজ আরো ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হতে থাকলো। ফলে স্বাধীনতার এই স্পৃহা দ্রুত মানুষের মনে জায়গা করে নিল। এই আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ পেল ’৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানে। বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বে সেই আন্দোলন শুরু হলো। মানুষ কী চাচ্ছে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। পুরো আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকলো তাঁর নির্দেশে।
৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’তে লিখেছিলাম, ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয়েছিল এই কবিতার পংক্তি। ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের কাছে এই কবিতা। সেই সময় আমি একজন কবি হিসেবে কোনো ছাত্র সংগঠনের কর্মী ছিলাম না বা পরবর্তীকালে কোনো রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলাম না। রাজনৈতিক সংগঠনের কোনো কর্মী না হয়েও আমি কবিতাটি লিখতে বাধ্য হয়েছিলাম। সেই উত্তাল সময় আমাকে দিয়ে এই কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। এতেই বোঝা যায়, এই আন্দোলন কতটা সর্বগ্রাসী, কতটা সর্বব্যাপী ছিল।
সেই সময় এই ভূ-খণ্ডের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্খায় আমাদের আবেগ ছিল যতটা, অবকাঠামোগত প্রস্তুতি ততটা ছিল না। আমরা একটা সশস্ত্র যুদ্ধ করবো, আমাদের যে প্রস্তুতি দরকার, তার কিছুই ছিল না। আমি মনে করি, তত্কালীন পাকিস্তান সরকার আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। সাড়ে সাত কোটি মানুষের কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই ছিল না। সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও তার দল জয়লাভ করলেও ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তাঁকে বলতে হলো, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করতে হবে’। এরপরের কথা তো সবারই জানা। সমগ্র জাতি, কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক দলমত নির্বিশেষে সবাই সামিল হয়েছে মুক্তির লড়াইয়ে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের যৌথ স্বপ্ন, নাড়ির স্পন্দন তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘একটি পতাকা পেলে’ কবিতায় লিখেছিলাম, ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে, আমি আর লিখবো না বেদনায় অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা’। যে স্বপ্ন ও আকঙ্খা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, যুদ্ধ জয়ের পরে আমাদের সেই স্বপ্ন পুরোপুরি পূর্ণতা পায়নি। স্বপ্ন পূরণের এ দায় আমাদেরই। মুক্তির লড়াই এখনো শেষ হয়নি।
লেখক: কবি