মুফতি মাসুদ কেন ধর্ম ছাড়লেন?
এক. অামার শ্রদ্ধেয় পিতাও ইমাম ছিলেন। অামার মা, ভাই-বোন সবাই খুব ধর্মপ্রাণ, তারা অামার মতাদর্শের বিরোধী।অামার জানামতে, অামার চৌদ্দপুরুষে কোন নাস্তিক নেই। সম্পূর্ণ ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ডেড অামি। অামি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের মানিকদীর অাল-অামিন জামে মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স-এর ইমাম ও প্রিন্সিপাল ছিলাম। অামি ব্যক্তি হিসেবে কেমন এ বিষয়ে অামার মুসুল্লি ও শুভানুধ্যায়ীরা সাক্ষ্য দেবে। অামি যখন নিজেকে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের মত হতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলাম, তখনই চাকুরী থেকে অব্যাহতি নিলাম। অামার চাকুরী ছাড়ার পর অামাকে প্রদত্ত ফেয়ারওয়েলে মুসুল্লিদের কান্নার রোল পড়েছিল। অামার মুসুল্লি ও শুভাকাঙ্খীরা যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন পাঁচমাস ধরে তার জবাব বোধহয় এটাই— অন্যান্য অালেমদের সাথে চিন্তার ভিন্নতা নিয়ে ইমামতি করে নৈতিকতা বিসর্জন দিতে চাইনি। নৈতিকতার স্থান থেকে কখনো বিচ্যুতও হইনি, অামার মুসুল্লিরা এখনও এ কথার সাক্ষ্য দেবেন। অামি স্বপ্ন দেখি একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবীর। অামি স্বপ্ন দেখি একটি সুন্দর পৃথিবীর। এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি যেখানে মানুষকে “কাফের, নাস্তিক, মুসলিম, হিন্দু, ইহুদী” ইত্যাদি কারণে হত্যা করা হবে না। যেখানে সবার পরিচয় হবে মানুষ। ধর্মের পরিচয়ের চেয়ে মানুষের পরিচয় অনেক বড়।
দুই. পৃথিবীতে অামাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন অামার মা এবং স্ত্রী। অামার লেখালেখি ও মতাদর্শের সবচেয়ে বিরোধীও অামার স্ত্রী। একজন অাদর্শ পুরুষ হিসেবে সে অামাকেই সবচে বেশি নাম্বার দেবে, কিন্তু ধর্ম এবং ফতোয়া তাঁকে অামার থেকে দূরে রাখছে। “নাস্তিকের সাথে সংসার করা হারাম” ফতোয়া পাবার পরেই অামার স্ত্রী অামাকে ত্যাগ করেছে। অামি তো নাস্তিক নই, কিন্তু চিন্তায় ভিন্নতা অাছে। সামান্য ভিন্নচিন্তা করলে, মানবাধিকারের পক্ষে বললে, নারী স্বাধীনতার পক্ষে কথা বললেই তাঁকে নাস্তিক বলা হয় কেন? নাস্তিক অাখ্যা দিয়ে কাউকে হত্যা করলে তার বিচার চাওয়া হয় না কেন? সামান্য ভাস্কর্য নিয়ে হেফাজত যে তাণ্ডব চালালো সে হেফাজত কেন অভিজিত, নিলয়, দীপন, ওয়াশিকুর হত্যার প্রতিবাদ করলো না? এখানেই অামার সাথে দূরত্ব অামার পরিবারের, এখানেই পার্থক্য মানুষ এবং ধার্মিকের। নিজের স্ত্রীই যাকে ত্যাগ করেছে তাঁকে অার কি মানা যায়? -মুমিনীয় যুক্তি।
জবাব: হযরত লুত এবং নূহকেও তাদের স্ত্রীরা চেনেনি, জানেন তো!
তিন. অামার চরিত্র সম্পর্কে জানতে চান? অামি যে মহল্লার ইমাম ছিলাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন। অামার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে জানতে চান? যে বাসায় ভাড়া ছিলাম তাদেরকে বা প্রতিবেশিদের জিজ্ঞেস করুন। অামার ছাত্রজীবন সম্পর্কে জানতে চান? অামার ক্লাসমেটদের জিজ্ঞেস করুন। (তারা অনেকেই অামার ফ্রেন্ডলিস্টে অাছে, তারা সবাই হুজুর।)
চার. হাজার চেষ্টা করেও নিজেকে মিথ্যার উপর ধরে রাখতে পারিনি। মিথ্যার উপর থাকলে অামার রোজগার, সম্মান, দাম্পত্য, বন্ধু-বান্ধব, অাত্মীয়-স্বজন কিছুই হারাতাম না। অনেক সময়ই মনে হত— কেন রিস্ক নেব! এরচেয়ে বরং অন্যান্য ইমামদের মতো ওজু ছাড়া নামাজ পড়াবো, রোজার মাসে মসজিদের ইমাম রুমের দরজা বন্ধ করে চুপিসারে খাবো, গোপনে গোপনে হিন্দি ও ইংলিশ মুভি দেখবো, হজ্বব্যবসা ও দানব্যবসা করে পয়সা কামাবো, নেতা ও ধনীদের তোয়াজ করে টুপাইস পকেটস্থ করবো! অামি এসব পারিনি। ঝামেলাটা করলো কিশোর বয়স থেকে প্র্যাকটিস করা ‘নৈতিকতা।’ অামার নৈতিকতা ছিল নিজস্ব রীতিতে। অামার পিতা প্রচণ্ড নৈতিক ছিলেন, তিনি ধর্মপ্রাণও ছিলেন। তিনি ভণ্ড মোল্লাদের পছন্দ করতেন না। এমন কোন ইমাম পাইনি যার মোবাইল, ট্যাব, পিসিতে পর্ণ ভিডিও নেই। ফোল্ডার লকের ভল্টে পাসওয়ার্ড দিয়ে রাখে এরা। এমন কোন ইমাম পাইনি যে অাল্লাহর জন্য নামাজ পড়ায়। হেফাজতীরা যতই লাফালাফি করুক, তারা নিজেরা বেশিরভাগই মনে মনে এক্স মুসলিম, কিন্তু নৈতিক নয়। নৈতিকতা না থাকার কারণে ধর্মব্যবসা করে। অাহমদ শফিও মুসলিম কিনা সন্দেহ! তসলিমা, ভাস্কর্য, নাস্তিক, নারীনীতি এসব কিছুই পয়সা কামানোর ধান্ধা। একেকটা ইস্যু দাঁড় করালে এর নাম ভাঙ্গিয়ে ধনীদের কাছ থেকে মোটা অংক বাগানো যায়, অামার কাছে প্রমাণ অাছে। তসলিমা বিরোধী অান্দোলনে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে টাকা কালেকশন করেছেন অামার হুজুররা, অামি তখন ছোট ছিলাম, কিন্তু বোকা ছিলাম না।
পাঁচ. অামি অাসলে অালেম কিনা, অালেম হলেও অারবি কতটুকু জানি, ইসলামের ইতিহাস কতটুকু জানি, কোরঅানের নাসেখ মানসুখ, হাদিসের উসুল জানি কিনা— সে বিষয়ে অামি ইন্টারভিউ দেব অচিরেই। ঢোল বাজানোর প্রয়োজন নেই, কথায় প্রমাণ দেব— কিছুটা হলেও ইসলাম বুঝি। অামার চেনাজানারা জানেন— অামি কে!
ছয়. অামি কোন ধর্মের শত্রু নই, অামি শুধু অমানবিকতার শত্রু, অামি শুধু ভণ্ডামির শত্রু। অামি যেমন বাংলাদেশে ধর্মের নামে সংখ্যালঘু হত্যার বিরোধী, ঠিক তেমনি বার্মায়ও ধর্মের নামে সে দেশের সংখ্যালঘু নিধনের বিরোধী।
সাত. বাংলাদেশ ও অারবের অালেমদেরকে ইনভাইট করছি অামার বক্তব্য শুনতে ও পড়তে।
অারবদেশের অালেমরা অামার সাথে অারবিতেই ডিবেট করতে পারবেন।
উপসংহার: রাষ্ট্র হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ। সংখ্যালঘু শব্দের বিলুপ্তি হতে হবে। কলমের জবাব কলম দিয়ে চাই, অস্ত্র দিয়ে নয়।
লেখক: আব্দুল্লাহ আল মাসুদ। ১০ বছর টানা মসজিদে ইমামতি করেছেন মুফতি মাসুদ, দীর্ঘদিন একটি কওমী মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যালের দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯-০৮-২০১৭
মুক্ত মতামত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত ও মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। www.sunamganjbarta.com এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে www.sunamganjbarta.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।