যেভাবে বুঝবেন আপনার হোয়াটস্অ্যাপে কেউ আড়ি পেতেছে
এপ্রিল মাসে ফস্টিন রুকান্ডোর হোয়াটস্ অ্যাপে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে রহস্যজনক কল আসে। তিনি কলটি রিসিভ করলেও অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। রুকান্ডো সে নম্বরটিতে কল করলেও কেউ রিসিভ করছিল না। রুয়ান্ডার অধিবাসী রুকান্ডো ব্রিটেনের লিডসে বসবাস করেন। নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সম্পর্কে তিনি ছিলেন সচেতন। যে নম্বর থেকে তার কাছে কল এসেছিল সে নম্বরটিকে তিনি অনলাইনে সার্চ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি খুঁজে পান যে নম্বরটির কোড সুইডেনের। বিষয়টি তার কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। কিন্তু দ্রুত সেটি ভুলে যান রুকান্ডো। এরপর আরো কিছু অপরিচিত নম্বর থেকে তার কাছে কল আসতে থাকে। ফলে নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন রুকান্ডো। ফলে নতুন আরেকটি ফোন ক্রয় করেন তিনি। কিন্তু সেটি ক্রয়ের একদিনের মধ্যে তার কাছে আবারো সেই অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রুকান্ডো বলেন, ‘আমি যখনই সে নম্বরটিতে ফোন করি, তখন কেউ সাড়া দেয়না। তখন আমি বুঝতে পারলাম যে কোন একটা সমস্যা আছে। কারণ, আমার মোবাইল থেকে ফাইল হারিয়ে যাচ্ছিল।’
মে মাসে তিনি সংবাদপত্রে একটি খবর দেখতে পান যে হোয়াটস্অ্যাপ হ্যাক করা হয়েছে। তখন তিনি বুঝতে পারেন তার ক্ষেত্রে কী ঘটেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আমার ফোন সেটটি পরিবর্তন করি এবং নিজের ভুল বুঝতে পারি। তারা আমার নম্বরটিকে অনুসরণ করছিল এবং ফোন কল করার মাধ্যমে প্রতিটি নতুন সেটে গোয়েন্দা সফটওয়্যার ঢুকিয়ে দিচ্ছিল’। রুকান্ডো বুঝতে পারেন যে হোয়াটস্অ্যাপে এর ত্রুটিকে ব্যবহার করে হ্যাকাররা প্রায় ১৪০০ ব্যক্তিকে টার্গেট করেছে। রুকান্ডো এবং তার সহকর্মীরা এর মধ্যে রয়েছেন। চলতি সপ্তাহে এ বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া যায় যখন তিনি কানাডার টরন্টো থেকে সিটিজেন ল্যাবের ফোন পান। এই প্রতিষ্ঠানটি গত ছয়মাস যাবৎ ফেসবুকের সাথে একত্রিত হয়ে কাজ করছে হোয়াটস্অ্যাপ হ্যাকিংয়ের বিষয়টি তদন্ত করার জন্য। এর মাধ্যমে তারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে। গবেষকরা বলেন, ‘এই ঘটনায় তদন্তের অংশ হিসেবে সিটিজেন ল্যাব ১০০টির বেশি ঘটনা চিহ্নিত করেছে যেখানে ২০টি দেশের মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের টার্গেট করা হয়েছে।’
রুকান্ডো রুয়ান্ডার শাসক গোষ্ঠীর কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত। স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে যে ধরনের ব্যক্তিদের টার্গেট করা হয়েছে রুকান্ডো তাদের মতোই। হোয়াটস্অ্যাপ হ্যাক করার এই সফটওয়্যার তৈরি করেছে ইসরায়েলভিত্তিক এনএসও গ্রুপ। তারা বিশ্বের ২০টি দেশের সরকারের কাছে এটি বিক্রিও করেছে। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং কূটনীতিকদের উপর নজরদারীর জন্য হ্যাকাররা এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে। রুকান্ডো বলেন, প্রথমবার হ্যাক হবার পর থেকে আর কোন ফোন আসেনি। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তাকে এবং তার পরিবারকে আতংকিত করেছে। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে এই সংস্থাটি হ্যাকিং-এর বিষয়টি নিশ্চিত করার আগেই আমরা আতংকিত হয়েছিলাম। মনে হচ্ছে দুই সপ্তাহ ধরে তারা আমার ফোনে আড়ি পেতেছে এবং আমার সবকিছুতে তারা দেখেছে। সেসময়ের মধ্যে শুধু আমার কর্মকাণ্ড নয়, আমার পুরো ই-মেইল ইতিহাস এবং আমার সব ফোন নম্বর তারা দেখেছে। সবকিছুই তারা দেখেছে- কম্পিউটার, ফোন কোন কিছুই নিরাপদ নয়। আমরা যখন কথা বলি তখনও তারা সবকিছু শুনতে পায়। আমি এখনো নিরাপদ বোধ করিনা।’ রুকান্ডো ২০০৫ সালে রুয়ান্ডা ছেড়ে আসেন যখন সরকারের সমালোচকদের আটক করে জেলে ঢোকানো হচ্ছিল। ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার চেষ্টা করছে হোয়াটস্ অ্যাপে-এর মালিক ফেসবুক। কিন্তু এনএসও গ্রুপ বলছে তারা কোন অন্যায় করেনি। আদালতে দাখিল করা কাগজপত্রে ফেসবুক অভিযোগ করেছে হোয়াটস্অ্যাপ এর অজানা ত্রুটিকে কাজে লাগিয়েছে এনএসও গ্রুপ। পৃথিবীর ১৮০টি দেশের ১.৫ বিলিয়ন মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে। এই অ্যাপটি জনপ্রিয় হবার মূল কারণ ছিল ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তার জন্য।
একজনের কাছ থেকে যখন অপরজনের কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বার্তা যায়, তখন সেটিকে বাধাগ্রস্ত করলেও পড়া সম্ভব হয়না। প্যাগাসাস নামের এই শক্তিশালী সফটওয়্যারটি তৈরি করেছে এনএসও গ্রুপ। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে মোবাইল ফোন থেকে দূর হতে গোপনে তথ্য হাতিয়ে নেয়া যায়। এর মাধ্যমে হ্যাকাররা ফোন সেটের সকল কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে। এর আগের ঘটনাগুলোতে দেখা গেছে, একটি ওয়েব লিংকের মাধ্যমে গোয়েন্দা সফটওয়্যারটি ডাউনলোড করার ফাঁদ পাতা হয়েছিল। কিন্তু ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে ব্যবহারকারীদের ফোনসেটে তাদের অজ্ঞাতে এই সফটওয়্যারটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত এনএসও গ্রুপ বিভিন্ন দেশে রেজিস্ট্রিকৃত ফোন নম্বর ব্যবহার করে হোয়াটস্অ্যাপ অ্যাকাউন্ট খুলেছে। যেসব দেশের ফোন নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে সাইপ্রাস, ইসরায়েল, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, সুইডেন এবং নেদারল্যান্ডস। এরপর এপ্রিল এবং মে মাসে সে গ্রুপটি তাদের টার্গেট করা ব্যক্তিদের হোয়াটস্অ্যাপে ফোন করার মাধ্যমে সেগুলোকে হ্যাক করে। ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আদালতে যে অভিযোগ দাখিল করেছে সেখানে বলা হয়েছে, হোয়াটস্ অ্যাপ-এর ভেতরে থাকা কারিগরি বিষয়গুলো এড়িয়ে যাবার জন্য এনএসও গ্রুপ এমন এক ধরণের কোড উদ্ভাবন করেছে যেটি ব্যবহার করে হোয়াটঅ্যাপ-এ ফোন করলে মনে হবে যেন এটি সত্যিই অন্য আরেকটি হোয়াটস্অ্যাপ নম্বর থেকে আসছে। এই কলের মাধ্যমে হ্যাকাররা তাদের টার্গেট করা ফোন সেটটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। যাদের টার্গেট করা হচ্ছে বিষয়টি তাদের কাছে সম্পূর্ণ অজানা থেকে যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা শুধু লক্ষ্য করে যে তাদের হোয়াটস্ অ্যাপ কল লিস্টে কিছু রহস্যজনক মিসডকল জমা হয়েছে। এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজির উপর নজরদারীর জন্য তার হত্যাকারীদের স্পাইওয়্যার সরবরাহ করা হয়েছিল। তবে এনএসও গ্রুপ এটি অস্বীকার করে বলেছে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর বিষয়ে তারা আদালতে লড়বে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ‘এনএসও গ্রুপের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে প্রযুক্তি সহায়তা দেয়া যাতে তারা সন্ত্রাস এবং গুরুতর অপরাধের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে’।