আদিত্য রিমন –

মেয়াদ পার হওয়ার পরও নতুন করে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়নি ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের। ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দুই মাস আগে। আর ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে একবছর আগে। সম্মেলনের নতুন তারিখ প্রসঙ্গে সংগঠন দু’টির বর্তমান কমিটি বলছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশ পেলেই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এদিকে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির নেতৃত্বের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছেন নতুন কমিটির পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীরা। ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, ছাত্রলীগ নিজস্ব গঠনতন্ত্র মেনে চলে। সেই অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হলে সম্মেলন করতে হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ে সম্মেলন না হয়, তাহলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশে গঠনতন্ত্র সংশোধন করা উচিত।  ছাত্রদলের পদপ্রত্যাশী নেতাদের মতে, বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ, নতুন করে সম্মেলন করা দরকার—এ বার্তাটি নিয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিংবা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে কেউ তুলে ধরতে পারছে না বর্তমান কমিটি।ছাত্রলীগ

ছাত্রলীগের শেষ সম্মেলন হয়েছে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। ২৬ ও ২৭ জুলাই ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সাইফুর রহমান সোহাগকে সভাপতি ও এস এম জাকির হোসাইনকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর সাত মাস পর গঠিত হয় পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এরপর পার হয়ে গেছে দুই বছরেরও বেশি সময়। এখন সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষণা না করার বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগকে একাধিকার ফোন ও এসএমএস করে সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সম্মেলনের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে আমাদের। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নির্দেশ দিলেই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে।’

এ প্রসঙ্গে সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সায়েম খান বলেন, ‘সম্মেলন কারও ব্যক্তিগত চাওয়া নয়। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ শেষ হলে নতুন সম্মেলন করতে হবে। সম্মেলন হলে নতুন নেতৃত্ব আসবে। এতে সংগঠন আরও গতিশীল-শক্তিশালী হবে। যা আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়ের জন্য কাজ করতে পারবে।’ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যের বিষয়ে সায়েম খান বলেন, ‘আমরাও নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। যদি নেত্রীর সম্মেলন নিয়ে স্পষ্ট কোনও বার্তা থাকে, তাহলে গঠনতন্ত্রে ছাড় দিতে পারি, না হলে আমরা কোনও ছাড় দিতে পারব না।’ গঠনতন্ত্র অনুসারে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ৩০১ সদস্যবিশিষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা কত কেউ তা বলতে পারছে না। সংগঠনটির দফতর থেকেও সঠিক হিসাব মেলেনি। জানা গেছে, বর্তমান কমিটি সদস্য সংখ্যা ৫০০-র বেশি। অভিযোগ রয়েছে,ক মিটির মেয়াদের শেষের দিকে আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন কারণে গণহারে পদ দিয়েছেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা কত জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসাইন বলেন, ‘আমাদের কমিটির সদস্য সংখ্যা চারশ থেকে সাড়ে চারশ হবে।’

তবে দেশে না হলেও প্রবাস কমিটি হচ্ছে ছাত্রলীগের। সারাদেশে কমিটি গঠনের চেয়ে দেশের বাইরে প্রবাসে কমিটি গঠন করতে আগ্রহী বর্তমান ছাত্রলীগ নেতারা। দেশে ১১০টি সাংগঠনিক কমিটি রয়েছে ছাত্রলীগের। এর মধ্যে বর্তমান কমিটি সম্মেলন দিয়েছে ৪৪ ইউনিটের। তবে কোন কোন জেলার কমিটি হয়েছে, সেই তালিকা দিতে পারেনি সংগঠটির দফতর। বাকি ইউনিটিগুলোর সম্মেলন হয়নি। এরমধ্যে কিছু কিছু ইউনিটের কমিটি হয়েছে পাঁচ থেকে সাত বছর আগে। শরীয়তপুর, নরসিংদী, বরিশাল মহানগর, চট্টগ্রাম উত্তর-দক্ষিণ, নোয়াখালী জেলা ও দিনাজপুর উল্লেখযোগ্য।   দেশের বাইরে ২২টি দেশে ছাত্রলীগের শাখা আছে। বর্তমান কমিটি বিদেশের ২০টি ইউনিটের কমিটি দিয়েছে। আগামীতে আরও ৭টি দেশে কমিটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংগঠনটি।ছাত্রলীগের দফতর সম্পাদক শাহজাদা দেলওয়ার বলেন, সারাদেশে ৪৪টি ইউনিটের কমিটি হয়েছে। আগামী মাসে আরও দু’টি জেলার কমিটি হবে। আর বাইরে ২০ দেশে কমিটি হয়েছে। নতুন করে আরও কয়েকটি দেশে ছাত্রলীগের ইউনিট শাখা করা হচ্ছে।

ছাত্রদল

সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙা করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের অক্টোবর  রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ঘোষণা করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পরদিন থেকে বিভক্ত হয়ে যায় সংগঠনটির নেতৃত্ব। ঘোষিত কমিটিকে প্রত্যাখ্যান করে মিছিলও করেছিল একটি অংশ। একপক্ষ আরেক পক্ষের ওপর হামলা, এমনকি নেতাদের অবরুদ্ধ করে রাখার ঘটনাও ঘটেছিল। এসব কারণে ছাত্রদলের রেওয়াজ থাকা সত্ত্বেও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধাও জানাতে পারেনি সংগঠনটির এই কমিটির নেতারা। সর্বশেষ নতুন কমিটির দাবিতে চলতি বছরের ১২ জুলাই রাতে খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে পদ-প্রত্যাশী ছাত্রদল নেতারা। ওই দিন তারা সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল করে।ছাত্রদলের সম্মেলনের নতুন তারিখ ঘোষনা না হওয়া প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও ছাত্রলীগ নেতৃত্বে মতো একই কথা বলছেন। তারা বলছেন, খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নির্দেশ পেলেই সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। তবে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছাড়া সংগঠনের অন্য নেতাকর্মীদের অভিযোগ, কমিটির মেয়াদ শেষে সম্মেলন করা দরকার–এটা দলীয় প্রধানের কাছে তুলে ধরছেন না সংগঠনের শীর্ষ দুই নেতা। বিষয়টি তারা বিভিন্নভাবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন।

ছাত্রদলের সম্মেলন না হওয়া প্রসঙ্গে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘খালেদা জিয়া বললে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি অনুমতি দিলে সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ করা হবে।’ ছাত্রদলের সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট বলেন, ‘কমিটির মেয়াদ শেষ, আমরা অবশ্যই সম্মেলন চাই। সম্মেলন হলে সংগঠন আরও নতুন নতুন নেতাকর্মী আসবে। সংগঠন আরও গতিশীল হবে বলে আমি মনে করি।’ একই কথা বললেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিয়া মো. রাসেল এবং সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মিনহাজুল ইসলাম ভূইয়া। কেন ছাত্রদলের সম্মেলন হচ্ছে না, এই প্রসঙ্গে সংগঠনটির কয়েকজন নেতা বলেন, ‘ছাত্রদলের কমিটির দেখভাল করেন বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক। বর্তমানে দলটির এ পদে কোনও নেতা নেই। ফলে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ, নতুন করে সম্মেলন করা দরকার—এ বার্তাটি নিয়ে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কিংবা সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে কেউ তুলে ধরতে পারছেন না।

এর বাইরে ছাত্রদলের কমিটি দেখভাল করতেন সাবেক ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, সাবেক যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলালসহ বেশ কয়েকজন নেতা। বর্তমান ছাত্রদলের কমিটিতে এই নেতাদের কাছের ‘লোক’ থাকায় তারাও সম্মেলন নিয়ে তেমন একটা ভাবছেন না। এর বাইরে এই নেতারা বিএনপির নির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পদে থাকায় সরাসরি কমিটি নিয়ে খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানকে কিছু বলতে পারেন না। ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক না থাকায় আসলে কোন নেতার কাছে যাবেন, এ নিয়ে একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন আগামী কমিটিতে পদপ্রত্যাশীরা। এছাড়া, দল ক্ষমতায় না থাকায় পদপ্রত্যাশীরা হামলা-মামলার ভয়ে কোনও রকম শোডাউনে যেতেও ভয়ে পাচ্ছেন। এই দুর্বলতার সুযোগে বর্তমান কমিটির নেতারা সম্মেলন দিতে গড়িমসি করছেন বলে অভিযোগ পদপ্রত্যাশীদের।আগে ছাত্রদলের কমিটির দেখভাল করতে এমন একজন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ছাত্রদলের সম্মেলন হওয়া না হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করে তারেক রহমানের ওপর। তিনি চাইলে যেকোনও সময় সম্মেলন হতে পারে। খালেদা জিয়া লন্ডন থেকে দেশে ফিরলে হয়তো ১ জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগে সম্মেলন হতে পারে। না হলে আগামী নির্বাচনের আগে সম্মেলনের কোনও সম্ভাবনা নেই।’

গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত হয়নি ছাত্র দলের

ছাত্রদলের নিজস্ব কোনও গঠনতন্ত্র না থাকায় কমিটির মেয়াদকাল কত বছর হবে, কেন্দ্রীয় কমিটি কত সদস্য বিশিষ্ট হবে, কমিটিতে কারা থাকতে পারবেন, কারা থাকতে পারবে না—এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও নির্দেশনা নেই। কিন্তু মৌখিকভাবে কমিটির মেয়াদকাল দুই বছরই ধরা হয়। সেই হিসেবে এ কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। কেন্দ্রীয় কমিটির কত সদস্য বিশিষ্ট হবে তারও কোনও নির্দেশনা নেই। তাই যত ইচ্ছা পদ দিতে পারেন ছাত্রদল নেতারা। এ প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বলেন, ‘আমাদের একটা খসড়া গঠনতন্ত্র আছে। ২০০১ সালে এটি করা হয়েছিল, কিন্তু তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’ সে হিসেবে গত ১৬ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি খসড়া গঠনতন্ত্রটি।

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn