ফসল রক্ষা বাঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মামলা করবে দুদুক
হাওরে বাঁধ নির্মাণের জন্য কর্তব্যে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের হাওরে কম-বেশি দুই হাজার কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে। বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের দিকে তাদের নজর ছিল। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে দায়িত্ব বাস্তবায়ন করেননি। দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
জানা যায়, পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের হাওরে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির ঘটনা অনুসন্ধান করছে দুদক। পরিচালক বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বিশেষ দল এক মাসের বেশি সময়ের অনুসন্ধান শেষে শিগগির কমিশনে প্রতিবেদন পেশ করবে। বাঁধ নির্মাণে দায়িত্বে অবহেলা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের এরই মধ্যে চিহ্নিত করেছে দুদক। দুদক সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, অনুসন্ধানে দুর্নীতির সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, হাওরে বাঁধ নির্মাণের নামে অর্থ আত্মসাতের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে যা যা করা প্রয়োজন তাই করা হবে।
সূত্র জানায়, বিশেষ দলের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা, আত্মসাতে সহায়তা ও অপরাধ সংগঠনের চেষ্টার তথ্য উল্লেখ করা হচ্ছে। কমিশন প্রতিবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে। এর পর কমিশনের অনুমোদনক্রমে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। জানা যায়, বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িতরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা ও দন্ডবিধির ১০৯, ৫১১, ৪০৯ ধারা লঙ্ঘন করেছেন, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব ধারায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। সুনামগঞ্জ জেলার ৩৮টি হাওরে বাঁধ নির্মাণের সব ধরনের নথি জব্দ করেছে দুদক। ওইসব নথি ঘেঁটে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। কতজন অভিযুক্ত হতে পারে সে বিষয়ে মুখ খুলছেন না সংশ্লিষ্টরা। দুদক সূত্র জানায়, এবার সুনামগঞ্জ জেলার ৩৮টি হাওরের ১ হাজার ৫২২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ (পুনরাকৃতিকরণ) ও মেরামতে বরাদ্দ ছিল ১০১ কোটি টাকা। ওই বাঁধ নির্মাণের জন্য ১৬০ জন ঠিকাদার ও ২৩৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে (পিআইসি) কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে পিআইসি গঠনে অহেতুক বিলম্ব করা হয়। ১০৬ জন ঠিকাদারকে যথাসময়ে কার্যাদেশ দেওয়া হলেও কাজে অংশ নেয় ১৫১ জন। বাকি ৯ জন কোনো কাজই করেনি। সূত্র আরও জানায়, সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের নথিতে ঠিকাদারদের ৬৫ শতাংশ বাঁধ নির্মাণ ও পিআইসির ৫৬-৫৭ শতাংশ বাঁধ মেরামতের কাজ হয়েছে বলে উল্লেখ করে। একই সঙ্গে ঠিকাদারদের জন্য এবার ৯ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ও পিআইসির জন্য ১১ কোটি ৭৭ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ছাড় করা হয়। দুদকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, এবার ঠিকাদার ও পিআইসির মাধ্যমে বড়জোর ২০-৩০ শতাংশ বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ কাগজপত্রে বাস্তবায়ন বেশি দেখানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রেই বাঁধ নির্মাণের নামে সরকারি অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে।
জানা যায়, হাওরের ফসল রক্ষায় প্রতি মৌসুমে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে পিআইসি গঠন করে বাঁধ মেরামতের কার্যাদেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারকেও কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারির মধ্যে মেরামত ও নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। এর মধ্যে ফসল রোপণ শুরু হয়। প্রতি মৌসুমে ১৫ এপ্রিলের মধ্যে ফসল কেটে ঘরে তোলা হয়। এবার সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের ক্ষমতার অপব্যবহার, কর্তব্য পালনে অবহেলার কারণে পাহাড়ি ঢলে হাওর ডুবে ব্যাপক ক্ষতি হয়। দুদকের অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, হিসাব অনুযায়ী গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে তিন মাসে বাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা ছিল। অথচ বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজই শুরু করা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারিতে। পরে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির এক জরুরি সভায় ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। হাওরে পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে ২৭ মার্চ। প্রতি বছরের মতো এবারও ওই জেলার হাওরের ফসল ঘরে ওঠার কথা ছিল ১৫ এপ্রিলের মধ্যে।