রাজনীতির রহস্যপুরুষ সিরাজুল আলম খান ভীষণ অসুস্থ
সালেম সুলেরী:-
সিরাজুল আলম খান ভীষণ অসুস্থ। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। পিঠে বিশাল ফোঁড়া। লন্ডনে অপারেশন করাবেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সঙ্গতি নেই। স্বাধীনবাংলা নিউক্লিয়াসের নেপথ্য নেতার আজ করুণ হাল।’ -এসব তথ্য জানালেন হাজ্বী আনোয়ার হোসেন। যুক্তরাষ্ট্র জাসদের সভাপতি তিনি। বহুদা-বিভক্ত জাসদ-এর আসম রব পন্থী।
বললাম- বিষয়টি দুঃখজনক। তবে একটি স্মৃতিতথ্য জানাই। সম্ভবত ২০১০ সাল। তখন যুক্তরাষ্ট্র জাসদের সভাপতি ছিলেন মাসুম মো. মহসীন। একদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাঁকসাইটে নেতাও ছিলেন। নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে ওনার একটি প্রশস্ত অফিস ছিলো। ৩৭ ও রুজভেল্ট এভিনিউ-এর ৭৫ স্ট্রিটে। পরবর্তী অফিস ব্রসন্স বিল্ডিং-এর কাছাকাছি। সেখানে সিপিএ কার্যক্রম নিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ তাফাজ্জল করিমও অফিস করতেন।
তখন পবিত্র রমজান মাস। জনাব তাফাজ্জল করিম ও ডা. জোয়ার্দার একজোট হয়েছেন। নতুন একটি সেবাপ্রকল্পের ঘোষণা দেবেন। ঢাকার আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে প্রবাসীদের সেবাপ্রদান প্রকল্প। এজন্যে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করলেন। সেটিকে পুরোপুরি ইফতার মাহফিলও বলা চলে। ৮/৯ জন সাংবাদিক এবং ১০ জন সমমনা প্রবাসী। পরিচয় পত্রিকার প্রতিষ্ঠিাতা সম্পাদক নাজমুল আহসানও ছিলেন। তৎকালীন জেবিবিএ নেতা মাসুম মো. মহসীনও উপস্থিত।
আয়োজনটি হঠাৎ মহার্য-সভায় পরিণত হলো। কারণ স্বয়ং সিরাজুল আলম খান তাতে উপস্থিত। ১৯৬২-এর স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের অন্যতম অনুঘটক। আব্দুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ ছিলেন সতীর্থ। ১৯৬৩-৬৫ মেয়াদে ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার প্রথম পতাকা ও ইশতেহার ঘোষণার পরামর্শক। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেরও একজন পরিকল্পক। মুক্তিযুদ্ধে মুজিববাহিনী বা বিএলএফ-এর স্মৃতিময় সংগঠক। ১৯৭২-এর অক্টোবরে জাসদ প্রতিষ্ঠার নীতি-নির্ধারক। মুজিবসরকারবিরোধী গণবাহিনী গঠনেরও কুশীলব। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ও ৭ নভেম্বরের বিপ্লবেও নানাভাবে সম্পৃক্ত। ‘দাদা’ পরিচয়ে বাংলাদেশ-ভারত-প্রবাসে সমধিক পরিচিত। রাজনীতির রহস্যপুরুষ হিসেবে সচেতন মহলে আলোড়িত। বৃহত্তর বরিশালে পৈতৃকবাস এই অকৃতদার রাজনীতিকের। তবে সারাবিশ্বই যেন তার ভ্রমণ-সংসার। অ্যামেরিকার উইসকনসিন রাজ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অধ্যাপনাও করেছেন। অসকস বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯৬-৯৭ সালে ছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর।
যথারীতি সাদা পোশাক, মুখ ভরা দাড়ি। রক্তাক্ত দু’চোখ, মোটা ফ্রেমের চশমা। পাঞ্জাবির কোনায় চশমা ঘঁষার মৃদু অভ্যাস। সানন্দ চিত্তেই আসন নিলেন ইফতার মাহফিলে। সবার মনোযোগ কেড়ে নিলেন সুউচ্চ সিরাজুল আলম খান।
আমার হৃদয়ে তখন শেষ সাক্ষাতের অংক। সম্ভবত ২০০১/ ২০০২ সাল হবে। ঢাকায় হোটেল শেরাটনে সান্ধ্যকালীন আড্ডা। ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতন হলো। এরপর থেকে তিনি শেরাটন-কে ‘সেকেন্ড হোম’ বানালেন। রাজনৈতিক সহকর্মী বা গুণগ্রাহীরা সেখানেই সাক্ষাৎ করতো। তাঁকে ঘিরে যেন ‘মিনি মাজার’। কেউ কেউ বলতো ‘দাদার মাজার’। আমি তখন সাদাকালো ম্যাগাজিন সম্পাদনায় ব্যস্ত। সাহিত্য-সংস্কৃতির পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রতিবেদনেও অগ্রণী। এছাড়া নিউইয়র্কের ঠিকানা পত্রিকার সক্রিয় বিশেষ প্রতিনিধি। এজন্যে কিছু অজানা স্মৃতিতথ্য সংগ্রহে নিবেদিত। কিন্তু শেরাটনে দাদা’র আসরে সুবিধে করা গেলো না। সিরাজুল আলম খান অন্য কথা শোনালেন। অনেকটা দু’হাত জড়ো করে ক্ষমা চাইলেন। বললেন, রাজনীতি নিয়ে কোন কথা নয়। বরং একটা কাজ করো সুলেরী। তোমার কবিতার বই থাকলে দাও। আমি এখন কবিতা পড়ে সময় কাটাতে চাই। রাজনীতির ভারযুক্ত মাথাটা একটু হালকা হোক। কিছুদিন পদ্যময় থাকি, কি বলো।
কাঁধব্যাগে আমার একটি নতুন কাব্যগ্রন্থ ছিলো। ‘বারুদে যে ফুল ফোটে।’ অটোগ্রাফসহ হাতে তুলে দিলাম। তিনি সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। বললেন, এরকমটাইতো চেয়েছি। প্রথমে বারুদ, তারপর ফুল ফোটানো। দেখলেতো, বিপ্লব ছাড়া কিছু হয়না। তুমিও বারুদের কথাই বলেছো। কবিরাও অনেক বিপ্লবী। নির্মলেন্দু গুণ যেন কি লিখেছিলো- সমাজতন্ত্র নিয়ে? বললাম, ‘তার আগে চাই সমাজতন্ত্র।’
হ্যা সমাজতন্ত্র চেয়েছিলো। আর আমরা চেয়েছিলাম বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। দূরত্ব কোথায়? কবিতা আর রাজনীতির অনেক সমযাত্রা রয়েছে। আমি তোমার কবিতাগুলো পড়তে চাই। রাজনীতির আসল কথা কি জানো তো? একটি কবিতাময় সুসাম্যের দেশ। সেই দেশ আনতে হলে কবিতাকে ভালোবাসতে হবে। পদ্যের ভাবজগতকে জয় করতে হবে।
সালেম সুলেরী
বর্ষিয়ান রাজনীতিকের কাব্যপ্রীতি আমাকে অবাক করেছিলো। একদশক পরে অধিকতর অবাক হলাম নিউইয়র্কে। পবিত্র ইফতার আয়োজনে একি করলেন তিনি! সকলের শ্রদ্ধাপাত্র সিরাজুল আলম খান! মধ্যমনি হলেও তিনি আসন নিয়েছিলেন পূর্ব-কোণায়। নিচতলায় পিঠাপিঠিভাবে আমরা প্রায় ১৯ জন। সভার উদ্দেশ্য বয়ন করা হয়ে গেছে। আয়োজক তাফাজ্জল করিম, ডা. জোয়ার্দার ব্যস্ত হলেন ইফতার সামলাতে। অফিসের একজন পুরুষ ও দুই নারী সহকর্মীও তৎপর। সবার হাতে পৌঁছানো হলো সুস্বাদু ইফতারের প্লেট। সরবত আর ঠান্ডা পানিতো রয়েছেই। মাগরিবের আজানের আর প্রায় সাত মিনিট বাকি। প্রবাসের একটি নবপ্রস্তুত টিভিতে তখন পবিত্র হামদ-নাত। কে একজন আগরবাতিও জ্বালিয়ে দিলেন। ১৯ জনের দু’জন হিন্দু সম্প্রদায়ের। কিন্তু ইফতার সংস্কৃতিতে যেন পূর্ণপ্রাণ নিবেদিত। পৃথক করে দেখবার কোনোই উপায় নেই। এটাই যেন ‘ইফতার মাহফিলে’র অনিন্দ্য সুন্দর মাহাত্ম।
সেকেন্ডের কাঁটা মিনিটের ঘর ছুঁয়ে এগুচ্ছে। এইতো আর মাত্র ছয়টি ঘোরা। সবাই যেন অপেক্ষার প্রহরকে উপভোগ করছে। একেবারেই পিন-পতন নীরবতা। হঠাৎ করেই আড়মোড়া ভাঙ্গলেন সিরাজুল আলম খান। হাতে পবিত্র ইফতারের সুসজ্জিত দস্তরখানা। মুখে অবাক করা সংলাপ। বললেন, স্যরি, আমি রোজা নেই। এজন্যে আর অপেক্ষাও করবো না। আমি হিপোক্রেট নই। যে অযথা প্লেট নিয়ে বসে থাকবো। আমার হাতে টাটকা খাবার। এবং আমি খেতে শুরু করলাম।
তিনি সশব্দে বেগুনি মুখে নিলেন। পেয়াজু খেতে শব্দ হয়। তা অবলীলায় চিবুতে লাগলেন। তরমুজ থেকে রস ঝরছিলো। সেটিও গলাধঃকরণ করছিলেন। বললেন, জিলাপি খেতে মানা আছে। জ্যাকসন হাইটসে বেশ টাটকা জিলাপি হয় দেখছি। এক-আধদিন খেলে কি হয়! সবার সামনেই গলা ভরে রস।
তরমুজ থেকে রস ঝরছিলো। সেটিও গলাধঃকরণ করছিলেন। বললেন, জিলাপি খেতে মানা আছে। জ্যাকসন হাইটসে বেশ টাটকা জিলাপি হয় দেখছি। এক-আধদিন খেলে কি হয়! সবার সামনেই গলা ভরে রসস্বাদ নিতে থাকলেন।
রাজনীতিক সিরাজুল আলম খানের পাশে যুক্তরাষ্ট্র জাসদ সভাপতি হাজী আনোয়ার হোসেন।
অবশ্য দ্বিতীয় আর কেউ প্লেটে হাত দেননি। আজান হওয়া’তক অপেক্ষা করেছেন। অ-রোজাদার হিন্দু সম্প্রদায়ের দু’জনও। অন্যদের মধ্যে সবাই রোজা ছিলেন, সেটিও নয়। তবে কেউ রোজার বিধানকে অস্বীকার করেননি। কিন্তু সেই সর্ব-সম্মানের নেতাটি যা খুশি- করলেন। ওনার খাদ্য-ধৈর্যহীনতার নাটকে সবাই হতবাক। ঐ খাদ্য-ভক্ষণ-মহড়া দেখতে দেখতেই কেটে গেছে ছয় মিনিট। ছয় হাজার দিনেও সেই অলীক কান্ড ভুলতে পারিনি!
যুক্তরাষ্ট্র জাসদের সভাপতি ফোন দিয়েছিলেন। জোর অনুরোধ, দাদাকে নিয়ে কিছু লিখতে হবে। ওনার এখন চিকিৎসা হওয়াটা জরুরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনার জন্যে ওনারা লড়েছেন। এখন ওনাদের বাঁচাতে জনগণ এগিয়ে আসছে না। সরকারও অনেকটা নীরব। কোনই পদক্ষেপ নেই। আপনারা লেখক-সাংবাদিক। আপনারা কেনো নীরব থাকবেন। আপনাদের দায়িত্বটুকু পালন করুন।
আমি এই সরলমতি সভাপতির আহ্বানকে উপেক্ষা করিনি। লিখলাম সিরাজুল আলম খানের কিছু খন্ডচিত্র। সাদাকালো’য় মেশানো বর্ণাঢ্য জীবন। যারা অতীব ঘনিষ্ঠ, তারা ঢের কিছু জানেন। বোঝেনও অনেক কিছু। কিন্তু আমি বুঝি- আমার দায়িত্বের কথা। আমাদের কর্তব্যের বিষয়াবলী। জাতির জন্যে অনেকের একজীবন অবদান। পাল্লায় মাপলে, সিরাজুল আলম খানও দিয়েছেন বেশি। অতএব ওনার জীবন সুরক্ষায় একটা ঝাঁকুনি চাই। মাত্র ৫০ লাখ টাকা চিকিৎসা খরচ! জাতির পক্ষে কি সম্ভব নয় সংস্থানের? এটুকুর জন্যে কি এতো কথার প্রয়োজন। এতো লুট এতো ব্যাংক ডাকাতির দুঃসংবাদ। পাশে একটু সুসংবাদ কবে শুনবো? স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের সংগঠক সুচিকিৎসা পেলেন! তিনি মহাচিন্তা থেকে আশংকামুক্ত। তাঁরা হাসলেই তো বাংলাদেশ হাসবে! আপনারা কি বলেন?