মারুফ কিবরিয়া-ছিলেন রিকশাচালক। হঠাৎই ব্যবসায়ী রূপে তার আবির্ভাব। গড়ে তোলেন এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশন। প্রতিষ্ঠানের নামে চার ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০০ টাকা ঋণ নিয়ে পুরোটাই লোপাট করেন এরশাদ আলী। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে শুধু এবি ব্যাংক থেকেই তোলা ঋণের ১৫৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়া বাকি তিন ব্যাংক ও একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি অনুসন্ধান চলমান। এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের মালিক এরশাদ আলী একা এই লোপাটের সঙ্গে জড়িত নন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায় এবি ব্যাংকের আরো ১৭ ব্যাংক কর্মকর্তার।
শিগগিরই এই ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদক। সূত্র জানায়, সামর্থ্য যাচাই না করেই এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনকে ৬ ধাপে ঋণ দেয় এবি ব্যাংক। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ১১৪ কোটি টাকা উত্তোলন করে এরশাদ ব্রাদার্স। দুদক সূত্র বলছে, এরশাদ গ্রুপ সবচেয়ে বড় ঋণ নিয়েছে কাকরাইলে এবি ব্যাংকের ইসলামী ব্যাংকিং শাখা থেকে। সিনোহাইড্রো কর্পোরেশনসহ চীনা তিন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া পদ্মা ব্রিজের রেল সেতু প্রকল্পে পাথর সরবারহের ওয়ার্ক অর্ডার দেখিয়ে এরশাদ ব্রাদার্স ২০১৫ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৬ ধাপে ১১৪ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে লোপাট করে। অন্য দুই প্রতিষ্ঠান হলো-চীনা মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড, চীনা রেলওয়ে মেজর ব্রিজ গ্রুপ।
অনুসন্ধান বলছে, এরশাদ আলীকে এবি ব্যাংকের কাকরাইল ইসলামী ব্যাংকিং শাখার সাবেক ম্যানেজার এবিএম আব্দুস সাত্তারসহ ৫ কর্মকর্তা ওয়ার্ক অর্ডারসহ সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই এই ঋণ দেয়।
বিশাল অঙ্কের এই ঋণ ছাড়ের ব্যাপারে এবি ব্যাংকের প্রধান কার্যলয়ের সঠিক তদারকি না থাকার প্রমাণও পেয়েছে দুদক। জালিয়াতির ঘটনায় এরশাদ আলীসহ ব্যাংকের সাবেক এমডি মসিউর রহমান চৌধুরী ও শামীম আহমেদ চৌধুরীসহ সর্বমোট ১৭ জন জড়িত। যা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক আবুল কালাম আজাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এবি ব্যাংক থেকে নেয়া ১১৪ কোটি টাকা ঋণ বর্তমানে সুদ আসলে দাঁড়িয়েছে ১৫৪ কোটি টাকায়। দুদক সূত্র জানায়, জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করতে কমিশনের কাছে অনুমতি চেয়েছে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা।
এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের টাকা লোপাটে এবি ব্যাংকের যেসব কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে তারা হলেন- ব্যাংকটির ইসলামী ব্যাংকিং শাখা কাকরাইলের সাবেক ইভিপি এবিএম আব্দুস সাত্তার, সাবেক এভিপি ও রিলেশনশিপ ম্যানেজার আব্দুর রহিম, এসভিপি ও সাবেক রিলেশনশিপ ম্যানেজার আনিসুর রহমান, ভিপি শহিদুল ইসলাম, ও এভিপি রুহুল আমিন। এছাড়াও আরো যাদের যোগশাজসের প্রমাণ মিলেছে- এবি ব্যাংকের সাবেক এমডি মসিউর রহমান চৌধুরী, শামীম আহমেদ চৌধুরী, ইভিপি এবং হেড অব সিআরএম ওয়াসিকা আফরোজী, ভিপি ও সিআরএম’র সদস্য মুফতি মুস্তাফিজুর রহমান (স্বপন), সাবেক এসইভিপি এবং হেড অব সিআরএম সালমা আক্তার, এভিপি ও সিআরএম সদস্য এমারত হোসেন ফকির, সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার তৌহিদুল ইসলাম, এসভিপি ও সিআরএম’র সদস্য শামীম-এ-মোরশেদ, ভিপি ও সিআরএম’র খন্দকার রাশেদ আনোয়ার, সিরাজুল ইসলাম, সাবেক ভিপি মাহফুজ-উল-ইসলাম।
সূত্র জানায়, এরশাদ আলী একসময় রাজশাহীতে রিকশা চালাতেন। এর ফাঁকে শুরু করেন বালুর ব্যবসা। পরে রড-সিমেন্টের ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এসব ব্যবসার পর ঢাকায় এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান করেন তিনি। যার মাধ্যমেই পাঁচটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ৩০০ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়েছেন, যা বিস্ময়কর। কারণ ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সময় প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য যাচাই করেনি। এরশাদ আলীর বিষয়ে অনুসন্ধানে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য আমলে নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে অনুসন্ধানে নামে দুদক। এবি ব্যাংক ছাড়া অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে এরশাদ আলীর এরশাদ ব্রাদার্স ঋণ নিয়ে লোপাট করেছে সেগুলো হলো- সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের ৮৭ কোটি টাকা, ফিনিক্স ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ২৯ কোটি টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকের ১৫ কোটি টাকা এবং সাউথ ইস্ট ব্যাংকের পাঁচ কোটি টাকা। এছাড়াও আরো কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সব ঘটনায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের ১১ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
অনুসন্ধান সূত্রে আরো জানা যায়, ঋণের টাকায় এরশাদ আলীর রাজশাহীতে বেশ কয়েকটি বাড়ি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে, যার সবই বিভিন্ন ব্যাংকে বন্ধক রাখা। ঢাকার ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু জমি ক্রয়ের তথ্যও পাওয়া গেছে। শুধু ঋণের টাকা আত্মসাৎ নয়, এরশাদ আলীর অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানও করছে দুদক। একই সঙ্গে এরশাদ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এরশাদ আলীর ভাই আমিনুল ইসলামের সম্পদের খোঁজেও রয়েছে সংস্থাটি।