রূপপুর বালিশকাণ্ড: টেন্ডারের ৮ মাস আগেই আসবাবপত্র সরবরাহ
বার্তা ডেস্ক :: টেন্ডার আহ্বানের আট মাস আগেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অন্তত তিনটি ভবনের জন্য ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স আইটেম, ওয়াশিং মেশিন, ইলেকট্রিক্যাল আয়রন, বালিশ, তোশক ও আসবাবপত্র সরবরাহ করা হয়। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কয়েক কোটি টাকার এসব মালামাল গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রতিটির দাম বাজারের তুলনায় অস্বাভাবিক ধরা হয়। পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিছানা, বালিশ ও আসবাবপত্র কেনার অনিয়মের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেড়িয়ে আসছে এমনসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। অনুসন্ধানের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, রূপপুর প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম ও একেএম জিল্লুর রহমান (বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলের সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার) এই অনিয়মের গোড়াপত্তন করেন। তারাই ঠিকাদারদের অনিয়মের রাস্তা তৈরি করে দেন। পরে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করতে একাধিক কর্মকর্তাকে কাজে লাগান। ফলে বুঝে হোক বা না বুঝেই হোক, ওইসব কর্মকর্তাও অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বালিশসহ আসবাবপত্র সরবরাহে ঠিকাদার ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি শুরু করেছে দুদক। এছাড়া প্রকল্পের ভবন নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগে জি কে শামীমের বিরুদ্ধে আলাদা অনুসন্ধান করা হবে।
প্রসঙ্গত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ‘বালিশ কেলেঙ্কারি’র ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ৩৪ কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার কথা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে আসে। সূত্র জানায়, দুদকের অনুসন্ধানে এই সংখ্যা কমতে বা বাড়তে পারে বলে জানা গেছে। অনুসন্ধানের পর টিমের পক্ষ থেকে কমিশনে যে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে তাতে পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরা হবে। মন্ত্রণালয়ের তদন্তে যাদের নাম এসেছে, তাদের অধিকাংশই দুদকের মামলায় আসামি হচ্ছেন। আর মামলা প্রামাণের স্বার্থে কয়েকজনকে সাক্ষীও করা হতে পারে। এর মধ্যে একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য রেকর্ড করেছে দুদক টিম। অনেকে লিখিতভাবেও বক্তব্য দিয়েছেন। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবেই তাদের বক্তব্য নেয়া হচ্ছে। সঙ্গে নেয়া হচ্ছে অভিযোগ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস। অনুসন্ধানের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের টিম কাজ করছে। অনিয়মের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেয়া হচ্ছে। এরপর টিমের সদস্যরা কমিশনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন। তাদের মতামত ও প্রতিবেদনের ওপর পরবর্তী আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রূপপুর প্রকল্পে ৯টি ভবনে আসবাবপত্র, বালিশ, মেট্রেস, অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক আইটেমসহ ঘরে বসবাসের উপযোগী অন্যান্য সামগ্রী কেনাকাটা ও সরবরাহে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে দুদক। টেন্ডার আহ্বানের ৮ মাস আগে ২০১৭ সালের আগস্টে প্রকল্পের তিন তলা ভবনের জন্য কয়েক কোটি টাকার আসবাবপত্র ও বিভিন্ন ধরনের মালামাল ঠিকাদাররা সরবরাহ করে। এই অনিয়মে সরাসরি জড়িত মাসুদুল আলম ও জিল্লুর রহমানের কাছে দুদকের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন ছিল- যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দিয়েছেন, আপনারা টেন্ডার আহ্বানের আট মাস আগেই কীভাবে বুঝলেন তারা কার্যাদেশ পাবে?
কীভাবে কোন আইনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মালামাল বুঝে নিলেন? এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তারা। দুদক টিমের পক্ষ থেকে তাদের দফায় দফায় প্রশ্ন করা হলে দায় এড়ানোর জন্য বলেছেন, সরকারের স্বার্থে এ কাজ করেছেন। তাদের প্রশ্ন করা হয়, সরকার কি বলেছে যে, টেন্ডার আহ্বানের আগেই মালামাল বুঝে নিয়ে বিল পরিশোধ করতে? জবাবে তারা ছিলেন একেবারে নিরুত্তর। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধান কাজ করছে। অনুসন্ধানকালে প্রকল্প কাজে অনিয়মের অভিযোগে প্রাথমিকভাবে ৩৪ জনকে পর্যায়ক্রমে জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুদক। পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম প্রকল্পে আসবাবপত্র সরবরাহে দুর্নীতি-অনিয়মের অনুসন্ধান করছে। অপর কর্মকর্তারা হলেন- উপপরিচালক নাসির উদ্দিন, সহকারী পরিচালক মো. আতিকুর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান মিরাজ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৯টি ভবনে রাশিয়ানসহ বিদেশিদের থাকার উপযোগী আসবাবপত্র ও অন্য সামগ্রী সরবরাহের জন্য টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডার আহ্বানের ৮ মাস আগে তিনটি ভবনের মালামাল বুঝে নেয়া ছাড়াও অনিয়মের মাধ্যমে ২টি ভবনে মালামাল সরবরাহের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। এক্ষেত্রেও প্রতিটি আইটেমের মূল্য অস্বাভাবিক ধরা হয়েছে। বাকি ৪ ভবনের কাজের বিল ঠিকাদারকে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। শুরু হয় তোলপাড়। মাসুদুল আলম ও জিল্লুর রহমানসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়মবহির্ভূত কাজে সমর্থন দিলেন কেন- দুদক কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নে রূপপুর প্রকল্পের দু’জন উপসহকারী প্রকৌশলীর একজন বলেছেন, একদিন রাত ৮টার সময় তাদের চাপ দিয়ে মালামাল বুঝে পাওয়ার বিলে সই করিয়ে নেন। অপরজন বলেন, তাকে ভয় দেখিয়ে বিলে সই করানো হয়। সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, ৩৬তম বিসিএস একজন নবীন কর্মকর্তা যোগদানের পর ট্রেনিং একাডেমিতে ওরিয়েন্টেশন কোর্স শেষে ২০১৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কর্মস্থল পাবনা তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর দফতরে যোগদান করেন। যোগদানের দিনেই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর নির্দেশে তিনি ৫এ.৭, ৫এ.৪, ৫.২, ৫.৫, ৫এ.৫ ও ৬.৩ ভবনের ছয়টি প্রাক্কলনের গাণিতিক যোগফল পরীক্ষা করেন এবং তাতে স্বাক্ষর করেন। ওই নবীন কর্মকর্তাকে দিয়ে যোগদানের দিনই এভাবে প্রাক্কলন ব্যয় সংক্রান্ত কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া অস্বাভাবিক ঘটনা বলে উল্লেখ করা হয় মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। এতে আরও বলা হয়, শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে প্রথম কর্মদিবসে রেট সিডিউল এবং ‘অ্যানালাইসিস’ সম্পর্কে কোনো ধারণাই তার ছিল না।
এ অনিয়মের দায় পাবনা গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলীর দফতরের উপসহকারী প্রকৌশলী, সহকারী প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীর। দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের অনুসন্ধানে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হতে শুরু করেছে। এসব তথ্য আরও পর্যালোচনা করা হবে। সরেজমিন প্রকল্পের ভবনে যাবে অনুসন্ধান টিম। প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রতিটি ভবনে ১ হাজার ৩২০টি বালিশ, প্রয়োজনীয় ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ঠিকাদারদের কাছ থেকে নেয়া হয়। দুদক সূত্র জানায়, সরকারি তদন্তে কভারসহ একটি বালিশের মূল্য ৪ হাজার ৩৪ টাকা হিসাবে বিল করা এবং অনভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, দুদকের অনুসন্ধানেও এর প্রমাণ মিলেছে। দুদকের অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, আসবাবপত্র পরিবহন এবং বিভিন্ন তলায় ওঠানোর ক্ষেত্রে গণপূর্ত অধিদফতরের রেট সিডিউল-২০১৮-এর নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। সিডিউলবহির্ভূত আইটেমগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দর নির্ধারণের পদ্ধতিও সঠিক ছিল না। দরপত্র আহ্বানের শর্তাবলিতে পণ্য সরবরাহের কোনো অভিজ্ঞতা না চেয়ে শুধু নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়, যা কোনোক্রমেই যুক্তিযুক্ত নয়। এদিকে প্রকল্পের ভবন নির্মাণে কী ধরনের অনিয়ম হয়েছে, তা-ও অনুসন্ধানের আওতায় আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। দুদকের কাছে অভিযোগ এসেছে, র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া জি কে শামীমের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এককভাবে ৬টি ভবনের কাজ পেয়েছে। তাকে এভাবে কাজ পাইয়ে দেয়ার পেছনে কারা রয়েছেন, কাজ ঠিকমতো হয়েছে কি না, টেন্ডার ঠিকমতো আহ্বান করা হয়েছিল কি না বা সর্বনিু দরদাতা কার্যাদেশ পেয়েছে কি না- এসব বিষয় খতিয়ে দেখছেন দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলমের নেতৃত্বাধীন অনুসন্ধান কমিটির সদস্যরা।
প্রসঙ্গত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প। প্রকল্পের ‘গ্রিন সিটি আবাসিক পল্লী’ ভবন নির্মাণ অংশে গণপূর্ত অধিদফতর ৭টি ২০ তলা ও ২টি ১৬ তলা ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি ৯১ লাখ ৭ হাজার টাকা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা বলা হয়।সৌজন্যে :: যুগান্তর