সংকট পিছু ছাড়ছে না ক্ষমতাসীনদের
দেশে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে, শুরু করা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা থমকে গেছে নানামুখী সংকটে। উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ, রোহিঙ্গা ইস্যু- একের পর এক সংকট মোকাবিলা করতেই সময় যাচ্ছে আওয়ামী লীগের।চলতি বছরের মে মাসে আওয়ামী লীগের এক সংসদীয় দলের সভায় এমপিদের সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেছিলেন, আগামী নির্বাচনে জনবিচ্ছিন্ন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। তারপর এমপিরা নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক গণসংযোগ ও নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে হাত দেন। জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারে- মাটি কাটা থেকে মাছ ধরা, হাল চাষ থেকে দরিদ্রের ঘরে টিনের চালা লাগিয়ে দেয়া- সবই করা শুরু করেছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিরা। তারপর হঠাৎ বন্যা আর ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে মাতামাতিতে সব থমকে যায়। এ দুটির রেশ না কাটতেই চরম আকার ধারণ করেছে রোহিঙ্গা সমস্যা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৯ সালে। নির্বাচনী মাঠ দখলে নিতে, দুই বছর বাকি থাকতেই নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ। দলের কেন্দ্র থেকে নির্দেশ পৌঁছেছে মাঠ পর্যায়ে। সে অনুযায়ী তৃণমূল নেতারা কাজ শুরু করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী এমপিরা শুরু করেছিলেন উঠান বৈঠক। সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। ভবিষ্যতে সরকার আরও কী কী কাজ করবে সেটাও জানান দিচ্ছিলেন তারা। কিন্তু হঠাৎ সংকটে পড়ে শ্লথ হয় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আবহ তৈরির চাকা।
তবে দলের অনেক নেতা মনে করেন, বন্যায় ত্বরিত ত্রাণ তৎপরতার মধ্য দিয়েও আওয়ামী লীগ জনগণের অনেক কাছাকাছি যেতে পেরেছে। চলতি বন্যায় সরকার ও দলের পর্যাপ্ত ত্রাণ বিতরণ ছিল ঐতিহাসিক। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল এভাবে জনগণের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ায়নি। এছাড়া দিনাজপুরের বিরলে এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ বিতরণ রীতিমত জনসভায় পরিণত হয়েছিল।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ঈদের পর আবারো নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড শুরু করবে আওয়ামী লীগ। ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর রাজশাহী যাওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড উদ্বোধন করে তিনি জনসভায় ভাষণ দেবেন। এর মধ্য দিয়ে আবারো দলের নেতা-কর্মীরা নির্বাচনমুখী হবে। সেখানে আবারো প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা-কর্মীদের নতুন বার্তা দিতে পারেন।
‘৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর হবে না’ এবং আগামী নির্বাচনে আমি আর কারো দয়িত্ব নিতে পারব না- প্রধামনমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পরপরই বর্তমান এমপি এবং মনোনয়ন প্রত্যাশীদের জনসংযোগের এক রকম প্রতিযোগিতা শুরু হয়। বিএনপি থেকে অভিযোগও আসছিল সরকার বিএনপিকে বাদ দিয়েই নির্বাচনী আবহ তৈরি করতে চায়। কিন্তু উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২২ জেলার বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় শতাধিক লোকের মৃত্যু এবং ৩৩ লাখ মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে সারা দেশেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচারণা থমকে দাঁড়ায়। উদ্ধার তৎপরতা ও ত্রাণ বিতরণেই গত এক মাস ব্যস্ত ছিল সরকার ও আওয়ামী লীগ।
এর মধ্যেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পর্যবেক্ষণের কিছু অংশের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল নেতারা জনমত গঠন করে। আগস্ট মাস জুড়ে শত শত আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগ নেতারা ব্যস্ত ছিলেন ষোড়শ সংশোধনীর পর্যবেক্ষণের কিছু অংশ নিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা গওহর রিজভীর সঙ্গে প্রধান বিচারপতির বৈঠকের পর দৃশ্যপট পাল্টায়। কিন্তু স্বস্তি ফেরেনি আওয়ামী লীগে। মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। এত শরণার্থীর ভরণ-পোষণ ও জায়গা দেয়া বাংলাদেশের জন্য অনেকটাই কষ্টসাধ্য। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সরকারের কূটনীতিক প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের পুশ ইন বন্ধে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহ্বান জানিয়েছেন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধিতা, দেশব্যাপী বন্যার ছোবল, ঈদযাত্রায় রাস্তার বেহাল দশা, কিছুদিন আগের বগুড়ার ধর্ষণকাণ্ড, ৫৭ ধারায় মামলা বিড়ম্বনা, বরগুনায় ইউএনও’র নামে মামলা এসব সংকট আওয়ামী লীগ কাটিয়ে উঠেছে।
এদিকে বর্তমানে বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে কী কৌশল আঁটছেন তারা, তাও ভাবিয়ে তুলছে আওয়ামী লীগকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐতিহ্যগতভাবেই সংকট মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ আজ এ পর্যায়ে এসেছে।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সংকট সমাধান করতেই আওয়ামী লীগের জন্ম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে ইতিহাসের প্রতিটি সংকটকে সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ এ জাতিকে স্বাধীনতা দিয়েছে। ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে। আওয়ামী লীগই একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করেছে। সংকট মোকাবিলা করে আওয়ামী লীগ দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছে। আওয়ামী লীগ কোনো সংকটকে ভয় পায় না; সাহস নিয়ে মোকাবিলা করে।