‘সব ভাঁড়ই গোপাল হয় না’

কাকন রেজা-

এক

‘বলতো সুইটজারল্যান্ড কোথায়?’‘স্যার কী যে কন না। বাপের হানিমুনে আমরা তো ওইহানেই গেছিলাম, ‘ফাসকেলাছ ছিনারি’।’ স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘জিওগ্রাফি কী জানিস?’‘আগেই কইছিলাম, স্যার খালি আমারে ঝাড়ি দেয়। ওইহানেও তো আমি এক হপ্তা আছিলাম।’ চাপাবাজি আর বুদ্ধিমত্তা দুই জিনিস। চাপা মেরে কিছুটা সময় হয়তো পার পাওয়া যায়, কিন্তু ঠেকে গেলে বুদ্ধিই কাজে লাগে। ‘জিওগ্রাফি’তে যে থাকা যায় না, এটা বুঝতে গেলে বুদ্ধি লাগে, চাপা নয়। ‘সব ভাঁড়ই গোপাল হয় না’ এ কথাটি চোখে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। সত্যি কথা, সবার বুদ্ধি ও চিন্তার পরিধি সমান হয় না। এমন না হওয়াটা দোষের কিছু নয়, কিন্তু না মেনে নেওয়াটা দোষের। ‘চাপাবাজ’ ছাত্রের ধরা খাওয়ার গল্পটা বলি।শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করছে, ‘কী রে, নেপাল কোন মহাদেশে?’‘স্যার নেপাল তো বাড়িতেই, কোনোও হানে যায় নাই কা।’‘আরে গাধা সেই নেপাল না, দেশের নাম নেপাল।’  ছাত্রের উত্তর, ‘স্যার যে কী জিগান, ওইহানে আমি মায়ের লগে দুইবার গেছি বেড়াইতে।’

দুই

‘রোহিঙ্গা ক্রাইসিসে’ বাংলাদেশের সাথে সবাই আছে এমন কথা শুনছি অনেকদিন থেকেই। বলা হলো ভারত আমাদের সাথে রয়েছে। মোদি মিয়ানমারে গিয়ে ঘোষণা দিয়ে এলেন, ভারত আছে মিয়ানমারের সাথেই। চীন নিয়ে কথা হলো, চীনও বলল, তারা মগদের পাশেই থাকবে। রুশরাও একই সুরে গলা সাধলেন। এখন শুনছি চীন-রাশিয়ার অবস্থানের না কী আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, জাপানসহ অন্যান্যরাও রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক। একই ধরনের কথা বলেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। সম্প্রতি সাংবাদিকদের রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রগতি জানাতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এমনটাই জানিয়েছেন তিনি। খুবই আশা জাগানিয়া কথা। এমন হলে তো আমরা বেঁচে যাই। কিন্তু মাঠের পরিস্থিতি কী এসব কথায় সায় দিচ্ছে? যদি দিত তাহলে বিশ্বব্যাংকের অনুদানের কথা উঠত না, তুরস্কের আবাসন তৈরির ব্যাপারটিও হয়তো সামনে আসত না। দুবলা না পাতলা কী চর যেন নাম, সেখানে রোহিঙ্গা বস্তি তৈরির প্রস্তাবও থাকত অগোচরে। এসব বাদ। আসি জাতিসংঘের কথায়। জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেফ্রে ফেল্টম্যান মিয়ানমার গিয়েছিলেন পাঁচ দিনের সফরে। তার মিশন ছিল বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়া এবং রাখাইনে জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মীদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা নির্বিঘ্ন করা। তার মিশন সম্পর্কে গত বৃহস্পতিবারের গণমাধ্যমের শিরোনাম, ‘মিয়ানমার থেকে শূন্য হাতে ফিরলেন জাতিসংঘ কর্মকর্তা’। এরপরও সাফল্য বিষয়ক ‘গপ্পে’ বলার কিছু থাকে কী! সু চি এবং মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয় এক কথায় পত্রপাঠ বিদায় করেছেন ফেল্টম্যানকে। তবে ফেল্টম্যান বিদায় হলেও আমাদের অনেকেই কিন্তু বিদায় হননি, বলতে পারেন ক্ষান্ত দেননি। তারা দাবি করছেন সাফল্যের, এমন সাফল্যময় দাবির সমর্থনে গণমাধ্যমে নিবন্ধও প্রকাশ হচ্ছে। ক্ষান্ত না দিয়ে ধৈর্য্য ধরাটাও একটি সাফল্য, অনেকটা ‘রবার্ট ব্রুসে’র মতন। ব্যর্থ জাতিসংঘের বিপরীতে আমাদের আশা জাগানিয়া এমন সাফল্য ছোট করে দেখার বিষয় নয়। তবে জাতিসংঘ যেখানে ব্যর্থ, সেখানে আমাদের সাফল্যের পরিমাপকটা কী তা বড় জানতে ইচ্ছে করে। আরেকটা গল্প বলি। আমাদের এলাকায় এক ভিখারি আছেন। পেটে ভাত না জুটলেও তার ‘গপ্পো’ ছিল সেইরকম। একদিন কথায় কথায় সে এলাকার দুই রাজনৈতিক প্রভাবশালীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মেটানোর ‘গপ্পো’ ফাঁদলেন। বললেন, এটা কোনোও ব্যাপার না, আমি দুইজনের সাথেই কথা বলেছি, তারা রাজি আমি শুধু সময় দিতে পারছি না বলেই ক্যাচালটা মিটছে না। এমন ‘গপ্পোবাজ’দের কী বলবেন? বোকা, না বেশি চালাক? তবে তার এমন গপ্পে মজা পেতেন অনেকেই। চায়ের দোকানে ডেকে চা খাইয়ে তার ‘গপ্পো’ শুনতেন লোকজন। বেচারীও বিনিপয়সার চায়ে চুমুক দিত, আর ‘গপ্পো’ চালিয়ে যেত। তবে একদিন হঠাৎ করেই তার ‘গপ্পোবাজি’ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে আরেক ‘গপ্পো’ আরেকদিন বলা যাবে।

তিন

‘আবার তোরা মানুষ হ’ এর কারিগর খান আতাকে নিয়ে সমালোচনা চলছে। আমি অনেকটা সিনেমা বিমুখ মানুষ। বিনোদন জগতে কী হলো না হলো তা নিয়ে আমার মাথাব্যাথা ছিল না, নেইও। কিন্তু তারপরেও খান আতা’র ওই চলচ্চিত্রটিতে ‘আল-মনসুর’ অভিনয় করেছিলেন। যিনি সম্পর্কে আমার বড়ভাই, আমাদের বেলাল ভাই, আমার মেঝ খালার ছেলে। ফোন করে জানতে চাইলাম, ‘আবার তোরা মানুষ হ’তে তার চরিত্রের নামটি। মজার মানুষ। বললেন, সাতদিন আগের কথাই আমার মনে থাকে না, আর তুই জিগাইছস চল্লিশ বছর আগের কথা। সাথে বললেন’ ‘আবার তোরা মানুষ হ’তে অলমোস্ট মুক্তিযোদ্ধারাই অভিনয় করেছিলেন। তিনিও মুক্তিযোদ্ধা, মাঠের যোদ্ধা, কাগুজে নন। তার ছোট ভাই আল-মাহমুদ, হেলাল ভাই, সেও মুক্তিযোদ্ধা এবং মাঠের। বাংলাদেশের অভিনয় জগতে আর যাই হোক আল-মনসুরকে ফেলে দেওয়া যাবে না। যেমন যাবে না বাংলাদেশের সিনেমা ও সংগীতের ইতিহাস থেকে খান আতা’র নাম। সুতরাং খান আতাকে নিয়ে যখন কথা হয়, তখন কানটা স্বাভাবিকভাবেই খাড়া হয়ে ওঠে। মনে বাজে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যিনি ছবি বানিয়েছেন, অভিনয় করিয়েছেন, তাকেই বলা হলো কী না রাজাকার! বড়ই বিচিত্র, আজিব কারবার।  আমাদের দেশে যে কয়জন গুণী ‘সিনেমা মেকার’ ছিলেন বা রয়েছেন, তার প্রথম সারিতেই খান আতা’র স্থান। আর সুরকার ও শিল্পী হিসেবেও তিনি প্রথমসারির মানুষ। সব ‘গুণী’ই মানুষ হয়, তবে সব মানুষই ‘গুণী’ হয় না, খান আতাও তাই। তর্ক বা বিতর্ক কাম্য হলেও কুতর্ক থেকে দূরে থাকাই সমীচীন। কুতর্ক না থামালে নগরের আগুন দেবালয়ও স্পর্শ করবে। সুতরাং কুতর্কের নামে নগরে আগুন না লাগানোই ভালো।  অবশ্য বলতে পারেন, ভালো-মন্দ বিষয়টি আপেক্ষিক। এই মুহূর্তে যা ভালো পরমুহূর্তে তা খারাপ। সময়ের ওপর নির্ভর করে অনেক ভালো-মন্দের বিষয়। ছোট বেলায় বিড়াল আমার খুব প্রিয় ছিল, এখনও আছে। তখন মা থাকতেন ‘ডিপথেরিয়া’র ভয়ে। সময়ের ফেরে জানা হলো, বিড়াল থেকে ওই রোগ হওয়ার কোনোও সম্ভাবনা নেই। ‘মা’ আধুনিক, সময়ের সাথে ‘টিউনড’। সুতরাং এখন মা’ও আছেন এবং ‘ম্যাঁও’ আছে। অবশ্য কারও কারও সময়ের সাথে চলার ক্ষমতা নেই। তাদের মাথায় বিড়ালের মতোই গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে ‘ডিপথেরিয়া’ জাতীয় চিন্তা। ঠিক খান আতা’র সেই গানের মতন, ‘এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে’।

চার

অনেকে বলেন ‘সিনহা’ ইস্যুকে ‘টিস্যু’র মতো ঝেড়ে ফেলতেই খান আতা বিতর্ক শুরু। খালেদা জিয়া’র গ্রেফতারি পরোয়ানাও তাই। রাজনীতি থাক; আমি ছা-পোষা মানুষ এসব রাজ-রাজড়ার নীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না। এমনিতেই আমাদের দেশে ইস্যু’র অভাব নেই। একটি কিছু ঘটতে না ঘটতেই আরেকটি হাজির। গণমাধ্যমের অনেক ‘রিপোর্টার’ বলেন ভাইরে, ইস্যু’র চাপে অনেক সময় ‘হিসু’ করার ‘টাইম’ থাকে না। চাপ আসলেই ভয়াবহ জিনিস। চাপের চোটে কোনো কিছুই ঠিক থাকে না। যেমন থাকে না গোপাল ভাঁড়ের। পুরানো গল্পটা আবার বলি। গোপালের গরু হারানোর গল্প। গরু খুঁজতে হয়রান গোপাল বাড়ি ফিরেই দাওয়ায় বসে পড়ল। বাপের ‘হাতে হ্যারিকেন অবস্থা’ দেখে ছেলে সামনে যেতেই গোপালের হাঁক, এক গ্লাস ‘জল’ দে তো ভাই।  ঘর থেকে গিন্নি চেচিয়ে উঠল, মিনসের কী মাথা খারাপ হলো গো, ছেলেকে বলছে ভাই।  গরুর শোকে বিপর্যস্ত গোপালের পর্যুদস্ত প্রত্যুত্তর, গরু হারালে এমনি হয় মা।  গরু হারালে মানে চাপে আর কী, এমন অবস্থাই হয়, হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তখন হয় ‘বাছা, আপন প্রাণ বাঁচা’ অবস্থা। সুতরাং যেখানে গোপালেরই এই অবস্থা, তখন অন্যদের দোষ দিয়ে আর লাভ কী।

[লেখকঃকাকন রেজঃ। সিনিয়র সাংবাদিক ও কলাম  প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। আমরা লেখকের মতাদর্শ ও লেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

কাকন রেজা

প্রকাশিত মতামতের সঙ্গে সুনামগঞ্জ বার্তা-এর সম্পাদকীয় নীতির মিল নাও থাকতে পারে।]

এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :Share on FacebookShare on Google+Tweet about this on TwitterEmail this to someoneShare on LinkedIn

এ বিভাগের আরো খবর

একজন খোকন মাষ্টার- সুপ্ত বাসনা যার হৃদয়ে

একজন খোকন মাষ্টার- সুপ্ত বাসনা যার হৃদয়ে

শিক্ষা গুরু বাবু সুবোধ রঞ্জন দাস

শিক্ষা গুরু বাবু সুবোধ রঞ্জন দাস

মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর

মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর