সাংবাদিক দীপঙ্কর হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন
এক যুগ পর বহুল আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাবেক সহ-সভাপতি ও স্থানীয় দৈনিক দুর্জয় বাংলার নির্বাহী সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। ঢাকার হলি আর্টিজান হামলার আসামি শীর্ষ জেএমবি নেতা জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী বগুড়ার আদালতে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। মঙ্গলবার বগুড়া পুলিশ সুপারের কনফারেন্স রুমে ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আসাদুজ্জামান বিপিএম বলেন, হলি আর্টিজান হামলার আসামি রাজিব গান্ধী রিমান্ডে থাকা অবস্থায় এই হত্যায় জড়িত বলে তথ্য দেয়। পরে সে গত সোমবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও প্রদান করেছে।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার আমলী আদালতের জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আহসান হাবিব তাঁর জবানবন্দী গ্রহণ করেন। ওই জবানবন্দীতে রাজীব গান্ধী উল্লেখ করে, জেএমবি’র তৎকালীন শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুল আউয়ালের (শায়খ আব্দুর রহমানের জামাতা) নির্দেশে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যা করা হয়। দীপঙ্কর চক্রবর্তী জেএমবি ও বাংলা ভাইকে নিয়ে নেতিবাচক লেখালেখির কারণে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত হয়। হত্যাকাণ্ডে রাজীব গান্ধিসহ আরো ৩ জন অংশগ্রহণ করে। তারা হলো সারোয়ার জাহান মানিক, সানাউল্লাহ এবং নুরুল্লাহ।
তাদের মধ্যে মানিক সম্প্রতি আশুলিয়ায় জঙ্গি বিরোধী অভিযানকালে নিহত হয়েছে। বগুড়ার জহুরুলনগরে একটি মেসে বসে ওই হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। হত্যার আগের রাত ১০টায় মানিক মটর সাইকেল দিয়ে সানাউল্লাহ ও নুরুল্লাহকে নিয়ে শেরপুরে যায়। এর আগে বাসযোগে সেখানে পৌঁছে রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর দায়িত্বে ছিল গতিবিধি লক্ষ্য করা, আর হত্যার দায়িত্ব ছিল সানাউল্লা ও নুরুল্লাহ। রাত ১২ টায় বগুড়া থেকে কাজ শেষে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী শেরপুরে নেমে একটি হোটেলে চা খান। পরে বাসায় যাওয়ার পথে বাসার সামনে তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
পুলিশ সুপার আরো জানান, সাংবাদিক নেতা দীপঙ্কর চক্রবর্তী গত ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর রাতে শেরপুর উপজেলার সান্যালপাড়ায় নিজ বাড়ির সামনে খুন হন। হত্যাকারীরা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার দেহ থেকে মাথাকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। তৎকালীন সময়ে উক্ত ঘটনা বগুড়াসহ সারাদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনার পরপরই ভিকটিম দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। উক্ত মামলাটি প্রথমে শেরপুর থানা পুলিশ তদন্ত করে।
পরবর্তীতে ডিবি পুলিশ ও সিআইডি তদন্ত করে পরপর তিন দফা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবারই বাদী ওইসব রিপোর্টের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন জানান। একারণে মামলাটি পুণরায় তদন্তের আদেশ হয় এবং সর্বশেষ ২০১৪ সালের ১২ ডিসেম্বর জেলা গোয়েন্দা পুলিশ(ডিবি) বগুড়ার ওপর দায়িত্ব প্রদান করে। পুলিশ সুপার আরো বলেন, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে নাছির ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাস ওরফে জাহিদ ওরফে জাকির ওরফে আদিল ওরফে টাইগার ওরফে আবু ওমর আল বাঙ্গালকে (৩৩) পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার জোয়ানপুরে জেএমবি আস্তানায় বোমা বিস্ফোরণের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ড নেওয়া হয়। রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী উক্ত ঘটনার সাথে জড়িত থাকাসহ দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে।
পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে রাজীব গান্ধী জানায়, ২০০১ সালে জেএমবিতে যোগদান করে এবং ২০০৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে সারোয়ার জাহান ওরফে মানিক তাকে হিজরত করতে বলে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থেকে সিরাজগঞ্জ জেলায় ডা. নজরুলের নিকটে যায়। ডা. নজরুল তাকে একটি মেসে নিয়ে যায়। সেখানে শাহাদত, মানিকসহ ৫/৬ জনকে দেখতে পায়। প্রায় ২ মাস উক্ত মেসে অবস্থান করেছিল। একদিন মানিক জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীকে বলে বগুড়ায় একটা কাজ করতে হবে। রাজীব গান্ধী তাতে রাজি হওয়ায় ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মানিক তাকে সিরাজগঞ্জ হতে বগুড়া জহুরুল নগর এলাকায় ভাইবোন ছাত্রাবাসে নিয়ে আসে।
ওই মেসে সে নুরুল্লাহ, সানাউল্লাহ, রাহাত, শিহাব, ওসমানসহ মোট ১০/১২ জনকে দেখতে পায়। উক্ত মেসে ৩টি রুম ছিল তার মধ্যে একটি রুম ফাকা ছিল। তারা দুই জন রাতে ওই মেসে অবস্থান করে। পরে দিন সকাল ১০ টায় আব্দুল আওয়াল ওই মেসে একজন ব্যক্তিসহ আসে এবং সেখানে একটি মিটিং হয়, সেখানে রাজীব গান্ধীসহ উক্ত ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিল।
উক্ত মিটিং এ আব্দুল আওয়াল আলোচনা করে যে, জেএমবি সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি এবং বিভিন্ন মিটিং এ জেএমবি কার্যক্রম সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করায় সুরা সদস্য সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই দুর্জয় বাংলার সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে এবং সেখানে শায়ক আব্দুল আওয়াল সাংবাদিককে হত্যার বিস্তারিত পরিকল্পনা করে।
সেই সিদ্ধান্ত অনুয়ায়ী জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, নুরুল্লাহ, সানাউল্লা এবং মানিক মিলে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তাবায়ন করবে। এরপর নুরুল্লাহ, মানিক চাপাতি দিয়ে সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর ঘাড়ে আঘাত করে হত্যা নিশ্চিত করে মটর সাইকেল যোগে পালিয়ে যায়। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় বগুড়া পুলিশ সুপার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান এসব কথা জানান। এসময় উপস্থিত ছিলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল, আব্দুল জলিল ও সনাতন চক্রবর্তী, সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের (এসআই) মজিবর রহমান।