সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং000
জেসমিন চৌধুরী–অবশেষে ফেসবুক লাইভে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এ সপ্তহের বহুল আলোচিত অখাদ্য একটি ভিডিওর নির্মাতারা। ইউটিউবে প্রচারিত এসব ফালতু জিনিস আমি কখনোই দেখি না কিন্তু এই আবর্জনাটি দেখতেই হলো। আমার এক বন্ধু একটি অনলাইন নারী বিষয়ক পত্রিকা চালান, তিনি আমাকে ভিডিওটি দেখে প্রতিক্রিয়া লিখতে অনুরোধ করেন। ভিডিওটি দেখতে শুরু করে মনে হলো বন্ধুর অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে গিয়ে পুরো একটা রাইস মিল মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছি, গিলতেও পারছিনা আবার উগলেও ফেলতে পারছি না। যারা ভিডিওটি বানিয়েছেন তাদেরই সমবয়সী আমার পুত্রটি মাথার উপর দাঁড়িয়ে দেখছিল, সে পরামর্শ দিল এসবে প্রতিক্রিয়া না দেয়াই ভালো, খামাখা ভিডিওটি গুরুত্ব পাবে। পুত্রের পরামর্শ উপেক্ষা করেই বন্ধুর সনির্বন্ধ অনুরোধে পরপর কয়েকটি রিয়েকশন লিখে ফেললাম। সেগুলো বিভিন্ন পেইজে এবং পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছে এবং আজ ইনাদের ক্ষমা প্রার্থনা দেখে মনে হলো ভুল করিনি।
এখন প্রশ্ন হলো ভিডিওটিতে কী এমন ছিল যে পুরা জাতি এই ভিডিও দেখার জন্য হুমড়ে পড়ল, ফেসবুকের পাতায় পাতায় স্থান পেল একটি দুর্গন্ধ-ছড়ানো পরিবেশনা? ভিডিওটির মূল বক্তব্য হচ্ছে মেয়েরা চাইলে গোপনে সিগারেট খেতে পারে, কিন্তু প্রকাশ্যে নারীর ধূমপান অত্যন্ত জঘন্য একটা কাজ। যুক্তি হিসেবে নির্মাতারা কারণ দেখিয়েছেন, নারী চাইলেই পুরুষের মত তার উর্ধাংগের কাপড় খুলে প্রকাশ্যে চলাফেরা করতে পারবে না কাজেই নারী প্রকাশ্যে ধূমপানও করতে পারবে না। ধূমপানরত কোনো মেয়েকে দেখলেই তার ভিডিও বানিয়ে সেটাকে ভাইরাল করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে ভিডিওটিতে যা আইনের পরিপন্থী। যত নিম্নমানেরই হোক না কেন, এধরনের ভিডিও ভালো প্রচারণা পেয়ে যায় কারণ দেশের বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিই এরকম। ভিডিওটি দেখবে অনেকেই, তাদের মনে কিছুটা হলেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে, মেয়েদের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে উঠবে আরো সংকীর্ণ। কাজেই এধরনের প্রচারণার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে, রুখে দাঁড়ালে ফল যে পাওয়া যায় এবার আমরা তার প্রমাণও পেলাম।
আমি একমুহুর্তের জন্যেও বিশ্বাস করি না যে এরা আসলেই দুঃখিত। নিজেদের আজম্ম লালিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এরা এই ভিডিওর স্ক্রিপ্ট লিখেছে, ভিডিও তৈরির সমস্ত পরিকল্পনা করেছে, ব্যবস্থাপনা নিয়েছে। একটা ভিডিও বানানো একেবারে কম ঝক্কির ব্যাপার নয় কিন্তু। এতো ঝক্কি ঝামেলা করে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করতে যায় লোকে তখনই যখন তার বিশ্বাস পাথরের মত অনড়, সাগরের মত গভীর। এই বিশ্বাস হিন্দী ফিল্মের মত এক মিনিটে পরিবর্তিত হবার কথা নয়। তারা সরি বলছে আইনবিরোধী প্রচারণার জন্য, কিন্তু তাদের ভাবনার অসারত্বের কথা তারা জানে বলেই আমার মনে হয় না। তারপরও বলব আমাদের প্রতিবাদ কাজে এসেছে কারণ এধরণের প্রচারণা চলতে দিতে থাকলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভাবনার অসারত্ব বৃদ্ধিই পাবে।
যারা এই ভিডিওতে উপস্থাপিত ধারণাগুলোর সাথে একাত্মতা পোষণ করেন আমি তাদেরকে কিছু কথা বলতে চাই। পাবলিক প্লেসে সিগারেট খাওয়া একটা অশোভন বিষয়, কিন্তু তা নারী-পুরুষ উভয়েরই জন্য। ঘরের ভেতরে সিগারেট খাওয়া প্যাসিভ স্মোকিং এর মাধ্যমে পরিবারের নন-স্মোকারদের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। সেটাও নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ধূমপান একটা সুখকর বদভ্যাস যা নানান জটিল রোগের জন্ম দিতে পারে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। ধূমপান একটা স্টুপিড কাজ, পয়সা খরচ করে শরীরের ক্ষতি করা, তাও নারী-পুরুষ উভয়েরই জন্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ধূমপানের কারণে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়ে ঘরবাড়ি পোড়া এবং মৃত্যুর ভুরিভুরি উদাহরণ রয়েছে। ধূমপান থেকে বিরত থাকতে পারলে ভালো, না পারলে অন্যের ক্ষতি না করেই করা উচিত, নারী-পুরুষ উভয়েরই।
আমার ছোটফুফু সিগারেট খেতেন। সকালবেলা একটা স্টার সিগারেট না ফুঁকলে তার স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়াকর্ম চালু হতো না। তিনি বলতেন তার স্বামীই আদর করে তাকে ধূমপান করা শিখিয়েছিলেন। নারীর ধূমপানের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তাকে লুকিয়ে সিগারেট খেতে হতো। আমার আব্বাও ধূমপান করতেন, সমস্তদিন ধরে এবং প্রকাশ্যে। দু’জনেই ধূমপায়ী অথচ একজনকে এ নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হতো কারণ তিনি নারী। অথচ এই দুইজন মানুষই আমার দেখা শুদ্ধতম চরিত্রের মানুষগুলোর মধ্যে অন্যতম। ফুফু কী রোগে মারা গিয়েছিলেন আমার মনে নেই তবে আব্বা ফুসফুসের ক্যান্সারে পরিণত বয়সে মৃত্যবরণ করেন। ধূমপানের কারণে যেসব রোগবালাই হয় তারাও নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য করে না, আপনারা কেন করবেন? আপনারা কি রোগ-বালাই থেকেও নিম্নস্তরের? আমি ধূমপানরত অবস্থায় নিজের কোনো ছবি কখনোই শেয়ার করব না, ইচ্ছে করে অন্যদের দেখিয়ে দেখিয়েও ধূমপান করব না কারণ এই বদভ্যাসকে প্রমোট করবার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে যদি কখনো আপনারা কেউ আমার হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট দেখেই ফেলেন তাহলে কি ধরে নেবেন আমি একজন দুশ্চরিত্র নারী?
যদি পুরুষের বেলায় এমনটা মনে না করা হয়, আমার বেলায় কেন? ভিডিওতে বলা হয়েছে নারীরা পুরুষের মত উর্ধাঙ্গের পোষাক প্রকাশ্যে খুলতে পারবে না। খুবই অসাড় একটা যুক্তি। নারী যে কারণে তার জামা খুলতে পারবে না ঠিক সেই কারণেই পুরুষও প্রকাশ্যে তার প্যান্ট খুলতে পারবে না। ধূমপানের মতই পাবলিক প্লেসে উদোম গায়ে ঘুরে বেড়ানোও সিভিলাইজড সমাজে অশালীন, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। তবু আপনাদের দাবি মেয়েরা একটু বেশি ঢেকেঢুকে চলতে হবে। মানুষ কাপড় পরতে শুরু করেছিল আবহাওয়া থেকে নিজের শরীরকে বাঁচানোর জন্য। কানাডার -৩০ ঠান্ডায় নারী-পুরুষ সবাই যত পুরু সম্ভব জাব্বাজোব্বা পরে নিজেকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন কিন্তু গরম পড়লেই পুরুষরা সবগুলো পরত খুলে ফেলেন, নারীকে তখনো প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জাব্বাজোব্বা লাগিয়ে রাখতে হয়। কেন?
কারণ নারীর বক্ষ পুরুষ অপেক্ষা বেশি স্ফীত, ওড়নার বিপজ্জনকতা নিয়ে কথা বলতে গেলেও আপনারা সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেন। আমি আপনাদেরকে দুটো কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। নারীর বক্ষ সন্তানকে দুধ পান করানোর জন্যই আপনারটার তুলনায় বেশি স্ফীত। আপনার মারটা, বোনেরটা, কন্যারটা- সবারটাই। নারীর স্ফীত বক্ষ দেখে আপনার যেমন কুছ কুছ হোতা হায়, আপনার লোমশ বক্ষ দেখেও নারীর কুছ কুছ হোতা হায়। কালাহারি মরুভূমীর বুশম্যানদের নারীরা বক্ষ উন্মুক্ত রেখেই চলাফেরা করে। তাদের উপর পুরুষরা যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে না, উন্মুক্ত বক্ষ দেখে তাদের কুছ কুছ হয়না। তাদেরও পারিবারিক সামাজিক নিয়মকানুন এবং মূল্যবোধ আছে কিন্তু তা নারীর পোষাক বা ধূমপানের দ্বারা প্রভাবিত নয়। আপনারা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করেন কিন্তু আমার মতে আপনারা চিন্তার মুক্তিতে, ভাবনার সৌন্দর্যে বুশম্যানদের থেকেও পিছিয়ে আছেন। বিশ্বাস না হলে সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত বহু পুরনো একটা ছবি ‘দ্য গডস মাস্ট বি ক্রেজি’ দেখুন। ইউটিউবে পাওয়া যাবে। ধূমপান অথবা পোষাককে নারীর চারিত্রিক শুদ্ধতার পরিমাপক হিসেবে দেখা বন্ধ করুন। সভ্যতা বোধ হয় আপনাদের জন্য নয়। তার চেয়ে বরং আপনারা বুশম্যান হোন, সেই ভালো। সবশেষে বলব আমাদের প্রতিবাদে হয়ত রাতারাতি মানুষের দৃষ্টিভংগি পালটে যাবে না কিন্তু নারীর প্রতি অবমাননাকর একটি ভিডিও ও যদি আমরা ব্যান করতে পারি, অবমাননাকারীদের ক্ষমা চাইতে বাধ্য করতে পারি তাই বা কম কি? সামথিং ইজ বেটার দ্যান নাথিং।
জেসমিন চৌধুরী : অভিবাসী শিক্ষক, লেখক ও অনুবাদক; ম্যানচেস্টার, ইউকে।