সাড়ে ছয় কোটি রাজাকার
মনজুর আহমদ-
বাহাত্তর সালে ঢাকার সাপ্তাহিক ‘হলিডে’ পত্রিকার একটি বিখ্যাত শিরোনাম ছিল- ‘সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন রাজাকারস’। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মুখে বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। সাড়ে সাত কোটির মধ্যে এক কোটি। বাংলাদেশের তখনকার জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাড়ে ছয় কোটিই দেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিল। স্বাধীনতার পর এই সাড়ে ছয় কোটি মানুষকে মুখোমুখি হতে হয় এক বড় ধরনের প্রতিকূলতার, এক বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের। সীমান্তের ওপার থেকে ফিরে আসা মানুষেরা সবাই পরিচিতি পেলেন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। আর দেশের ভেতরে থাকা সাড়ে ছয় কোটি মানুষ? তাদেরকে হতে হয়েছে ধিক্কারের শিকার। তাদের ভাগ্যে জুটেছে একটি কলঙ্কজনক তিরস্কার ‘রাজাকার’।
এই সাড়ে ছয় কোটি মানুষকে নিয়েই ছিল ‘হলিডে’র বিশেষ প্রতিবেদন ‘সিক্সটি ফাইভ মিলিয়ন রাজাকারস’। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পেছনের কারণটি ছিল ওপার থেকে ফিরে আসা মানুষদের সেই চ্যালেঞ্জ, তাদের মুখে মুখে উচ্চারিত অভিযোগ। দেশের ভেতরে থাকাকে তখন চিহ্নিত করা হয়েছিল হানাদার পাকিস্তানীদের দালালি হিসাবে। সীমান্তের ওপারে না যাওয়া মানুষেরা ধিকৃত হতে থাকলো মুক্তিযুদ্ধে না যাওয়ার জন্য, তাদেরকে অভিহিত করা হতে লাগলো ‘রাজাকার’ হিসাবে। ‘হলিডে’ প্রশ্ন তুলেছিল, সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়াদের সংখ্যা এক কোটি, তাদেরও আবার সবাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নয়। আর দেশের ভেতরে থেকে যাওয়া মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় কোটি। তাহলে কি এই সাড়ে ছয় কোটি মানুষই রাজাকার?
পঁয়তাল্লিশ বছর সময় পেরিয়ে এসে আজ আবার নতুন করে সেদিনের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল সম্প্রতি সৃষ্টি হওয়া একটি বিতর্কের কারণে, এখন আবার নতুন করে কাউকে কাউকে রাজাকার বলার প্রবণতা দেখে। বলা প্রয়োজন, অপছন্দীয় ব্যক্তিদের ইচ্ছেমত ‘রাজাকার’ বলার যে কালচার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বিদ্যমান, তাতে ‘রাজাকার’ কথাটির শুধু অপব্যবহারই হচ্ছে না, প্রকৃত রাজাকারদের ভয়ংকর চরিত্রকে গৌণ করে দেয়া হচ্ছে। এ তথ্য তো ইতিহাসের অন্তর্গত যে, রাজাকার ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করার জন্য গঠিত একটি বাহিনীর নাম। পাকিস্তানী হানাদারদের সহায়তা করার জন্য দলীয় লোকদের নিয়ে এ বাহিনীটি গঠন করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এ বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল। তারা চালিয়েছিল নির্মম গণহত্যা, চালিয়েছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ। সেই সব রাজাকাররা আজ বিচারের সম্মুখীন। তাদের নেতাদের অনেককেই ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
রাজাকার সেই ভয়ংকর খুনীদের নাম। কারা রাজাকার ছিল তা আজ প্রমাণিত এবং তারা আজ চিহ্নিত। অথচ সেই স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের মতো এখন আবার নির্বিচারে যাকে-তাকে রাজাকার বলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজাকার বলার আগে কি যাচাই করে দেখা হচ্ছে, সে ব্যক্তি রাজাকার বাহিনীর সদস্য ছিলেন কিনা? রাজাকার বাহিনীর সদস্য নন, হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি অপরাধের সাথে জড়িত নন, তারপরেও তিনি রাজাকার হন কেমন করে? এভাবে রাজাকার কথাটির অপব্যবহারের অর্থ হচ্ছে প্রকৃত রাজাকারদের গৌণ করে দৃষ্টির আড়ালে তাদের সরিয়ে দেয়া, তাদের অপরাধকে খাটো করে দেখা।
আমাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন নাট্যজন নাসিরুদ্দিন ইউসুফ এবার চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব মরহুম খান আতাউর রহমানকে রাজাকার বললেন। এ নিয়ে এখন জোর বিতর্ক চলছে। বিতর্কের জবাবে নাসিরুদ্দিন ইউসুফ আত্মপক্ষ সমর্থন করে একাত্তরে পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষ থেকে পত্র-পত্রিকায় পাঠানো একটি বিবৃতির উদাহরণ তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযুদ্ধকালে দেশে থাকা শিল্পী সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ও নাট্যাঙ্গনের ব্যক্তিদের ভূমিকা পর্যালোচনার জন্য ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল, পাকিস্তানের পক্ষে বুদ্ধিজীবীদের দেয়া একটি বিবৃতিতে খান আতা স্বাক্ষর করেছিলেন। স্বাক্ষরকারীদের তালিকায় নয় নম্বর নামটি তার। বিবৃতির যে অংশটি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ তুলে দিয়েছেন সেখানে স্পষ্টই দেখা গেল খান আতার নামটি।
আমি যে বিষয়টি আলোচনায় আনতে চাই তা এই নামের তালিকা। তালিকায় তো শুধু খান আতার নামটিই একমাত্র নাম নয়। সেখানে তো আমরা আরো নাম পড়লাম। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ সেই তালিকা থেকে শুধু একটি নাম বেছে নিলেন কেন? এই বিশেষ নামটি উল্লেখ করার পেছনে তবে কি তাঁর কোন উদ্দেশ্য রয়েছে? খান আতার নামের ওপরের নামটিই তো আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি আহসান হাবীবের। এ তালিকায় নাম রয়েছে সঙ্গীতশিল্পী আবদুল আলীম, ফরিদা ইয়াসমিন, খুরশিদ আলম, শাহনাজ বেগম, রওশন জামিল, এম এ সামাদ ও ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালেরও। এদেরকে কি বলবেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ? একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় যে, প্রতিটি তালিকার নীচেই কমিটি তাদের একটি করে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, ‘এই সব শিল্পী, সুরকার, নাট্যশিল্পী, কথক, কথিকা, রচয়িতা, সংবাদ পর্যালোচক, নাটক ও ঘোষক সম্পর্কে কমিটির কোন মন্তব্য নাই।’
নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটি কেন এদের সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিল তা আমার জানা নেই। তবে জানি, এই কমিটির কাজ খুব বেশি দূর এগোয়নি। মাঝ পথেই এ কমিটি হাত গুটিয়ে নিয়েছিল। কোন সুপারিশ ছাড়াই তারা তাদের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে বিদায় নিয়েছিল। কেন এই কমিটি তাদের কাজ শেষ করেনি এবং কেনই-বা তারা কোন সুপারিশ করা থেকে বিরত ছিল সে প্রশ্নের জবাব অজানা।
তবে এই লেখার সুবাদে সে সময়ের কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরার সুযোগ নিতে চাচ্ছি। স্বাধীনতার পরপরই যখন ওপার থেকে ফেরত আসা মানুষেরা ঢালাওভাবে দেশে রয়ে যাওয়া মানুষদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে শুরু করে তখন সকল মত ও পথের সুধী সমাজের একটি আবেদন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তা ছিল ‘উইচ হান্টিং’ নয়, প্রতিশোধমূলক কোন তৎপরতা নয়। পরে স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে তাঁর প্রথম জনসভাতেই আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভায়েরা আমার, ক্ষমা করো। অনেক রক্ত ঝরেছে, আর রক্তপাত নয়’। বন্ধ হয়েছিল তখনকার ‘উইচ হান্টিং’ প্রবণতা। রাজনৈতিক মহল থেকে বলা শুরু হয়েছিল দেশে যারা ছিল তারাও মুক্তিযোদ্ধা। তারা নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেছেন। দেশের ভেতরে তারা মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছেন। তখনই বন্ধ হয়েছিল ইচ্ছেমত যাকে তাকে ‘রাজাকার’ বলা। তখন প্রকৃত রাজাকারদেরই চিহ্নিত করা হয়েছে।
তখন থেকে এই দীর্ঘ সময় পর যখন নাসিরউদ্দিন ইউসুফের মতো সম্মানীয় ব্যক্তি খান আতাকে রাজাকার বলেন তখন জানতে ইচ্ছা হয়, কেন হঠাৎ এই ‘উইচ হান্টিং’? প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়, এই প্রক্রিয়ায় কাকে ছাড়বেন, কাকে রাখবেন? আরো তো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি তখন দেশে অবস্থান করেছেন। তাদের অনেকের ভূমিকা নিয়েই স্বার্থসংশ্লিষ্ট মহল নানা প্রশ্ন তখন তুলেছে। ‘স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মহল’ কথাটার ওপর আমি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। তখন অনেকের চেহারাই আমরা দেখেছি যা ছিল স্বার্থপরতার চরম প্রকাশ।
বাংলাদেশের মুখোজ্জ্বলকারী কবি শামসুর রাহমানকে যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি তখন পড়তে হয়েছে সে কাহিনী নিশ্চয় অনেকেরই জানা আছে। তিনি সীমান্ত পেরিয়ে ওপারে যাননি, উপরন্তু তিনি পাকিস্তান সরকারের মুখপত্র ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ কাজ করেছেন। এই অভিযোগে স্বাধীন বাংলাদেশের বাংলা একাডেমীর প্রথম মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম তাঁকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিলেন। যতদিন মযহারুল ইসলাম ওই পদে বহাল ছিলেন ততদিন শামসুর রাহমান বাংলা একাডেমীতে প্রবেশাধিকার পাননি। দুজন কবির সে সময় বাংলা একাডেমীতে প্রবেশ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল, কবি শামসুর রাহমান আর কবি ফররুখ আহমদ।
দেশে অবস্থান করে নিজের চাকরি করা যদি অপরাধ বলে বিবেচিত হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যে শিক্ষকরা যোগ দিয়েছিলেন তাদেরকে কি বলা হবে? ২৫শে মার্চের কাল রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছিল সেই বিশ্ববিদ্যালয় আবার খোলার সঙ্গে সঙ্গে যে শিক্ষকরা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে তো ছিলেন আমাদের আর এক গর্ব মুনীর চৌধুরী। যোগ দিয়েছিলেন এমন আরো অনেকেই যারা পরে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছেন, শহীদ হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কাজে যোগদানের খবর ছবি সহ বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। একটি ছবিতে ছিল, শহীদ মুনীর চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে তাঁর অফিসে আরো কয়েকজন শিক্ষকের সাথে হাসি মুখে কাজ করছেন। দেশে থেকে রুটি-রুজির জন্য কাজ করা যদি অপরাধ হয় তাহলে কবীর চৌধুরীও এই কারণে অপরাধী। তিনি তো ঢাকা পতনের সময় পর্যন্ত পুরো নয় মাসই বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলা নাট্য জগতের গৌরব আবদুল্লাহ আল মামুন কি হেনস্থার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি টেলিভিশনে কর্মরত ছিলেন। এই ছিল তাঁর ‘অপরাধ’। একটি মহল তাঁর হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তা জমা দিয়ে তাঁকে স্বাধীনতা বিরোধী প্রমাণের চেষ্টা করেছে।
এ তালিকা দীর্ঘ করতে চাই না। আজ যখন নাসিরউদ্দিন ইউসুফের মতো সম্মানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি রাজাকার অনুসন্ধানে নামেন তখন কথাগুলি প্রসঙ্গক্রমে এসে গেল। তিনি নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত যে কমিটির তালিকাকে আশ্রয় করে খান আতাকে রাজাকার বলেছেন সেই নীলিমা ইব্রাহিমও তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর যোগদানের খবরে বিস্মিত বাংলা বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের দুই ছাত্রী ডিপার্টমেন্টে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে তাঁর কাজে যোগ দেয়ার কারণ জানতে চেয়েছিলেন। তিনি জবাবে বলেছিলেন, বাংলা ভাষাকে তো রক্ষা করতে হবে। তোমরা ক্লাশ কর। পরীক্ষা দাও। বাংলা ভাষাকে রক্ষা কর।
খান আতার পক্ষ নিয়ে আমার এই লেখা নয়। কোন পরিস্থিতিতে তিনি কখন কি করেছেন সে সাফাই দেওয়াও আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু সেই সময়ের একটি ছবি তুলে ধরলাম যা কিনা কাউকে রাজাকার বা স্বাধীনতা বিরোধী আখ্যায়িত করার আগে সংশ্লিষ্ট সকলের বিবেচনার দাবী রাখে।
লেখক: নিউইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক; সম্পাদক, সাপ্তাহিক আজকাল, নিউইয়র্ক।
লেখকের আরো পরিচিতি: দৈনিক বাংলাবাজার ও দৈনিক অর্থনীতির সাবেক নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক দেশবাংলার সাবেক সহযোগী সম্পাদক, অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার চিফ রিপোর্টার, দৈনিক সংবাদ-এর সাবেক সহ-সম্পাদক, খেলাঘর পাতার বিভাগীয় সম্পাদক এবং খেলাঘর-এর ‘ভাইয়া’। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। কলামিস্ট ও গল্পকার।