সিলেটজুড়ে বজ্রপাত আতঙ্ক চার জেলায় মারা গেছে ২৫ জন
ওয়েছ খছরু:-
মৌসুমের শুরুতেই সিলেটে বজ্রপাত নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি হলেই ঘরে ভয়ে আটকে থাকেন মানুষজন। হাওরের কৃষকরা সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। এখন পর্যন্ত সিলেট অঞ্চলে বজ্রপাতে অন্তত ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যারা মারা গেছেন তাদের বেশির ভাগই হাওরের কৃষক কিংবা শ্রমজীবী মানুষ। আবার বজ্রপাত আঘাত হানছে শহুরের গ্যাস রাইজারে।জ্বলছে মানুষের বাসাবাড়িও। ঘরে পুড়ে মারা যাচ্ছে মানুষও। বজ্রপাত রোধে গেলো বছর প্রশাসন থেকে ‘তালগাছ’ রোপণের কর্মসূচি গ্রহণ করা হলেও পরবর্তীকালে সেটি ঝিমিয়ে পড়ে। সিলেটে এখন দাবি উঠেছে- বজ্রপাত রোধে দ্রুত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি খুঁজে বের করা প্রয়োজন। আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন- গেলো ৩-৪ বছর ধরে সিলেট অঞ্চলে বজ্রপাত আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর কারণে সিলেটে বৃষ্টিপাতও বেড়েছে। বৃষ্টিপাত হলেই প্রচণ্ড ঝড়-ঝাপটা হয়। বাড়ে বজ্রপাতও। বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে এক দিনের বজ্রপাতে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে মারা গেছে ৬ জন। এতে করে হাওরাঞ্চলে তীব্র আতঙ্ক দেখা দেয়। ধানকাটারত অবস্থায় মারা গেছে দেখে- অন্যসব কৃষকের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এতে করে ধান কাটায়ও ব্যাঘাত ঘটে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- বাংলাদেশে দুটি মৌসুমে বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে ‘প্রাইমারি সামার’। এপ্রিল-মে মাসজুড়ে এই প্রাইমারি সামারের বিস্তৃতি। এ সময়ে ভার্টিক্যাল ক্লাউড বা সম্ভু মেঘ থাকে বলে ঘন ঘন কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রপাত হয়। এই প্রাইমারি সামারের কারণেই সিলেটজুড়ে অব্যাহতভাবে ঘটছে বজ্রপাতের ঘটনা। ঘন ঘন বজ্রপাতের বিষয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- ‘পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, জলবায়ুর পরিবর্তন এসব কারণে মেঘের মধ্যে তড়িৎ প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। যে কারণে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ সোমবার সিলেট বিভাগের তিন জেলায় বজ্রপাতে পাঁচজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। হবিগঞ্জ জেলায় দুজন, মৌলভীবাজারে দুজন এবং সুনামগঞ্জে একজনের মৃত্যু হয়েছে। হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নে বজ্রপাতে দুই ধানকাটা শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহতরা হলেন উপজেলার কবিরপুর গ্রামের নাদু বৈষ্ণবের ছেলে ধানকাটা শ্রমিক অধীর বৈষ্ণব (২৭), তেলঘরি গ্রামের বীরেশ্বর বৈষ্ণবের ছেলে বসু বৈষ্ণব (৩২)। স্থানীয়রা জানান- সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় বৃন্দাচিত্তা হাওরে কয়েকজন শ্রমিক বৃষ্টির মধ্যে ধান কাটতে যান। এ সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই অধীরের মৃত্যু হয়। আর গুরুতর অবস্থায় বসুকে নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎস তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় আহত কৃষ্ণধন বৈষ্ণব (৩২) তেলঘরি গ্রামের হরিচরণ বৈষ্ণবের ছেলে। তাকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। মৌলভীবাজার সদর ও শ্রীমঙ্গল উপজলোয় বজ্রপাতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সদরের খলিলপুর ইউনিয়নের খলিলপুর গ্রামে ও শ্রীমঙ্গলের কালাপুর ইউনিয়নের হাইল হাওরে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন সদর উপজেলার খলিলপুর গ্রামের ফয়েজ উদ্দিনের ছেলে আবু সামাদ (১৫) এবং শ্রীমঙ্গল উপজেলার বরুনা গ্রামের ইসলাম মিয়ার ছেলে মফিজ মিয়া (৩০)। সকালে ধানক্ষেতে কাজ করার সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই আবু সামাদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রশীদ মিয়া (৩৬) ও মো. রফিক মিয়া (৬০) নামের দুই ব্যক্তি আহত হয়েছেন। তাদেরকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এদিকে, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরে ধান মাড়াই করার সময় বজ্রপাতে এক কৃষক নিহত হয়েছেন। নিহত নবকুমার দাস (৬৫) উপজেলার নিয়ামতপুর গ্রামের বাসিন্দা। সুনামগঞ্জে বিভিন্ন স্থানে বজ্রপাতের ঘটনায় ২ নারীসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসময় আহত হয়েছে আরো ৪ জন। গতকাল দুপুরে এসব ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের ভাটি তাহিরপুর গ্রামের মুক্তুল হোসেনের ছেলে কৃষক নূর হোসেন (২২), বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের পুরানগাঁওয়ের হজরত আলীর স্ত্রী শাহানা বানু (৩৫), একই উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের ক্ষিরদরপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের মেয়ে সুরমা বেগম (২২), দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও ইউনিয়নের ডুব বন্ধ গ্রামের আরশাদ আলীর ছেলে ফেরদৌস (১২) ও দিরাই উপজেলার ৯ নম্বর কুলঞ্জ ইউনিয়নের টংগর গ্রামের মুসলিম উদ্দিন (৭৫)। স্থানীয়রা জানায়- দুপুরে ভাটি তাহিরপুরে মুক্তুল হোসেন গ্রামের পাশে শনির হাওরে ধানক্ষেতে কাজ করছিলেন। এসময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পরে আত্মীয়স্বজনরা তার মরদেহ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। অপরদিকে, বিশ্বম্ভপুর উপজেলার দক্ষিণ বাদাঘাট ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামে শাহানা বানু বাড়ির আঙিনায় কাজ করছিলেন। এসময় বজ্রপাত হলে আহত হন তিনি। আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। একই সময় ওই উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের ক্ষিরদরপুর গ্রামে সুরমা বেগম (২২) নামে এক নারী মরিচ ক্ষেতে কাজ করা সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এসময় লিলি বেগম নামে এক শিশু আহত হয়। ফতেহপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রণজিৎ রাজন ও বিশ্বম্ভরপুর থানার ওসি (তদন্ত) নব গোপাল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বজ্রপাতে দোয়ারাবাজার উপজেলায় ফেরদৌস (১২) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। দোয়ারাবাজার থানার ওসি সুশীল রঞ্জন দাস জানান, দুপুরে বাড়ির পাশের ডোবায় মাছ ধরছিল ফেরদৌস। এসময় বজ্রপাত হয়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এছাড়া দিরাই উপজেলার ৯ নম্বর কুলঞ্জ ইউনিয়নে ধানের খলায় কাজ করার সময় বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই মুসলিম উদ্দিনের মৃত্যু হয়। অপর এক বজ্রপাতের ঘটনায় জামালগঞ্জ উপজেলায় ধানের খলায় কাজ করার সময় তিন কৃষক আহত হয়েছেন। এরা হলেন- ফেনারবাঁক ইউনিয়নের হঠামারা গ্রামের বাসিন্দা ওয়াহেদ আলীর ছেলে তৈয়বুর রহমান (১৭), একই গ্রামের আব্দুল আহাদের ছেলে আব্দুর রহমান ও সাহেব আলী ছেলে নবী হোসেন। সিলেট আবহাওয়া অফিসের প্রধান কর্মকর্তা আবহাওয়াবিদ সাইদ আহমদ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, আগামী এক সপ্তাহ সিলেটে বজ্রপাত হবে বলে আবহাওয়া পূর্বাভাস দিয়েছে। আর বৃষ্টি হলেই বজ্রপাত হয়। এবং সিলেট অঞ্চলে বজ্রপাত বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে এমনটি হতে পারে। তিনি বলেন- মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গলে আগামী এক সপ্তাহ বৃষ্টিপাত হবে। পাশাপাশি সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও সিলেটের হাওর এলাকার বৃষ্টিপাত হবে। এজন্য সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। এদিকে- বজ্রপাতরোধে ‘তালগাছ’ লাগানোর জন্য গত বছর থেকে সিলেটের প্রশাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অনেক স্থানে তালগাছের চারা রোপণ করা হয়েছিল। কিন্তু দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা তো নবীন তাল চারা দিয়ে সম্ভব নয়। এ কারণে তালগাছ চারা লাগানোর বিষয়টি ঝিমিয়ে পড়েছে। হাওর অঞ্চলে বজ্রপাত রোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে গতকাল বিকালে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মানববন্ধন করা হয়েছে।