সিলেটে নির্বাচনের কৌশলী ‘রণপ্রস্তুতি’ কামরান-আরিফের
ওয়েছ খছরু–
একটু দেরিতে গিয়েছিলেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। অর্থমন্ত্রীর পাশে বসা বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। আরিফকে বসাতে তিনিই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আয়োজকরা একটি চেয়ার এনে মিডিয়া কর্মীদের সামনেই বসালেন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে। এর খানিক পর অর্থমন্ত্রী উঠে মঞ্চে চলে গেলেন। তখন সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে ডেকে পাশে নিয়ে বসালেন সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। পাশে বসা দুজনকে বেশ হাসিখুশি দেখালো। তারা কানাকানিও করলেন। হাসলেনও। কামরান ও আরিফের এমন ঘটনা সিলেটে এখন প্রায়ই দেখা যায়। দুজন দুজনকেই ‘সম্মান’ দিয়ে চলেন। যেটি পরিলক্ষিত হলো সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে সিলেট সিক্সার্সের অনুষ্ঠানে। অবশ্য বাইরে দুই জনের সম্পর্ক ভালো থাকলেও ভেতরে ভেতরে মল্লযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন দুজনই। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন আর কয়েক মাস পরে। বর্তমান পরিষদের মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের প্রথমার্ধ্বে। এরপর অনুষ্ঠিত হবে নির্বাচন।
এই নির্বাচনে মাঠের ‘রণপ্রস্তুতি’ শুরু করে দিয়েছেন দুজনই। আগের চেয়ে আরো বেশি সক্রিয় তারা। রাজনীতি, ভোটের মাঠ সহ নানা দিকে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। কামরান ও আরিফ দুই মেরুর দুই বাসিন্দা। দুজনের সবকিছু আলাদা। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই। এক সময় কামরান ছিলেন নির্বাচিত মেয়র। আর আরিফুল হক চৌধুরী ছিলেন নির্বাচিত কাউন্সিলর। সেই আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়ে কামরান চলে গেছেন ব্যাকফুটে। বদরউদ্দিন আহমদ কামরান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের সদস্য। সিলেট আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক মহলের একজন। আরিফুল হক চৌধুরীও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য। তিনিও সিলেট বিএনপির প্রভাবশালী নেতা। রাজনীতির মাঠে দুজন দুজনের চির শত্রু। এরপর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী। আগামী সিটি নির্বাচনে কৌশলে একজন আরেকজনকে ঘায়েল করার ফন্দি আঁটছেন। তাদের চালাচালিতেও রয়েছে রাজনীতির ছোঁয়া। কারণ বিগত নির্বাচনে আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপি থেকে প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ ও বামধারার রাজনীতির অনেকেরই সুনজর কেড়েছিলেন। তাদের সঙ্গে আলাদা সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন।
যেটি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। আবার কামরানও বিএনপি সহ ডানধারার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সফল হয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। কামরান সেক্ষেত্রে লাভবান হতে পারেননি। কামরান ও আরিফের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে অনেক আগে থেকেই। বিএনপির জমানায় কামরান তখন সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র। আর সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান তখন সিলেটের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। সাইফুর রহমানের ডান হাত ছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। ওই সময় রাজনৈতিক কারণে সাইফুরের সঙ্গে কামরানের সখ্য বাড়েনি। ফলে সিলেট নগরের উন্নয়ন নিয়ে টানাপড়েন শুরু হয়। আর এই সুযোগ গ্রহণ করেছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। নির্বাচিত মেয়রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সিলেটে গঠন করেছিলেন ‘নগর উন্নয়ন কমিটি’। আর ওই কমিটির মাধ্যমে সাইফুর রহমান সিলেট নগরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করেন।
এ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সিলেট শহরকে নগরে পরিণত করা ‘রোডম্যাপ’ হিসেবে কাজ করে। সেই উন্নয়নে আরিফুল হক চৌধুরী অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। নির্বাচিত মেয়র হয়েও কামরান তেমন কোনো বাড়তি বরাদ্দ ছাড়াই সিলেট সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। তবে সামাজিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে থাকায় তখন কামরানের জনপ্রিয়তায় একটুও প্রভাব পড়েনি। বিএনপির জমানায় এমন হোঁচট খেলেও কামরান তার জমানায় এমনটি করেননি। আর করার সুযোগও পাননি। কারণ ওয়ান ইলেভেন থেকেই জেলবন্দি ছিলেন আরিফ। এই অবস্থায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কামরান দীর্ঘ দিন পর হাত খুলে উন্নয়নকাজ পরিচালনার সুযোগ পান। কিন্তু নিজের চিন্তাধারায় উন্নয়নকাজ চালাতে গিয়ে তিনি বিরাগভাজন হন নিজ দলের শীর্ষ নেতাদের। এক্ষেত্রে তিনি কিছুটা রোষানলে পড়েন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতেরও।
এই অবস্থায় বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট নিয়ে প্রার্থী হয়েও হেরে যান। কিন্তু কামরানের জনপ্রিয়তায় হ্রাস পায়নি। নির্বাচনে হেরে আগের মতো সামাজিক কর্মকাণ্ডে মেতে উঠেন কামরান। মেয়র না হলেও প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি সিলেটে বিচরণ করছেন। অপরদিকে আরিফুল হক চৌধুরী এবার নির্বাচিত হয়ে প্রথমে সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা, বিস্ফোরক মামলা এবং পরবর্তীতে দিরাইয়ে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলার আসামি হয়ে প্রায় দুই বছর কারাবরণ করেন। নির্বাচিত হওয়ার পর সিলেট নগরীর ছড়া ও খাল উদ্ধারে যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটিয়ে তিনি নজর কেড়েছিলেন অর্থমন্ত্রীর। নগরবাসীরও বাহবা কুড়িয়েছিলেন। তবে মাঝপথে এসে মামলার আসামি হওয়ার জন্য আরিফের ঘনিষ্ঠজনরা নানাভাবে দায়ী করেন কামরানকে।
এর পেছনে কামরানের হাত রয়েছে বলেও তারা অভিযোগ তুলেন। কিন্তু কামরান তাতে কর্ণপাত করেননি। তিনি সব সময় বলেছেন- আইনি প্রক্রিয়ায় তার কোনো হস্তক্ষেপ নেই। আর তিনি ভোটের মাঠেই লড়াই করতে পছন্দ করেন। গোপনে কাউকে ঘায়েল করার রাজনীতি তিনি করেন না। ২৭ মাস কারাবরণের পর সিলেট নগরীতে দৃশ্যমান কিছু কাজ করছেন আরিফুল হক চৌধুরী। এর মধ্যে তিনি সিলেটের কিছু কিছু রাস্তা চার লেনে উন্নয়ন করছেন। সর্বশেষ তিনি চৌহাট্রা-মীরবক্সটুলা-নয়াসড়ক রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ চালাচ্ছেন। আরিফ এখন মেয়র। আর কামরান সাবেক মেয়র। সিলেট নগরে ভোটের মাঠে ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে আগামী সিটি নির্বাচনে তারা দুজনই ফের ভোটযুদ্ধে মুখোমুখি হচ্ছেন। যদিও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ঘরানার নেতারা জানিয়েছেন, তারাই যে প্রার্থী সেটি এখনো চূড়ান্ত নয়।
দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর তারা প্রার্থী হবেন। ইতিমধ্যে কামরানকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিয়েছেন দলের প্রধান শেখ হাসিনা। কামরানের পক্ষে কাজ করতে তিনি দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন। বিএনপি সূত্র জানিয়েছে আরিফও ইতিমধ্যে দলীয়ভাবে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন। তিনিও আগামীতে নির্বাচনে প্রস্তুতিপর্ব চালাচ্ছেন। এই প্রস্তুতিতে দুজন মানসিকভাবে দুজনকে ঘায়েল করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সিলেট নগরের নানা ইস্যুতে তারা মুখোমুখি রয়েছেন। কামরানের নিজের তদবিরে আনা টাকায় নির্মাণ হয়েছে সিলেট সিটি করপোরেশনের নিজস্ব ভবন। ইতিমধ্যে নগর ভবনের কাজ শেষ পর্যায়ে। উদ্বোধনের অপেক্ষা। সেখানে প্রথম মেয়র হিসেবে আরিফ বসবেন- সে প্রস্তুতিও চলছে।