সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন প্রথম কে দেখেছিলেন?
ড. জফির সেতু-
সিলেটে একটি উচ্চতর বিদ্যাপীঠের স্বপ্ন প্রথম কে দেখেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব শক্ত কাজ। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে এই বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা নেবে এবং ডিগ্রি প্রদান করবে-এমন প্রস্তাব তৃতীয়বারের মতো পেশ করেছিল ভারতের কাউন্সিল অব এডুকেশন। কিন্তু তা গা করছিল না কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ওই বছর হাউস অব লর্ডসের সিলেক্ট কমিটিতে এডুকেশন ডেসপ্যাচ পেশ হলে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে তা প্রতিবেদন আকারে ভারতের তৎকালিন শিক্ষাব্যবস্থা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়। এর ভিত্তিতেই কলিকাতার সঙ্গে মাদ্রাজ ও বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যাপারে তখন পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়নি। এদিকে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্টকে বাংলার ঢাকা বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। তার অনেক পূর্ব থেকেই শ্রীহট্ট ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতির একটা কেন্দ্র। উত্তর-পূর্ব ভারতকে তারও অনেক পর পর্যন্ত কলেজ-শিক্ষাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে। শ্রীহট্ট এই বাস্তবতার ভেতরে পড়েছিল। অন্যদিকে ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে শ্রীহট্ট ছিল একটা দোদুল্যমান অবস্থায়। কখনো আসামের সঙ্গে, কখনো বঙ্গের সঙ্গে। ফলে কর্তৃপক্ষের মনও ছিল সংশয়াচ্ছন্ন। যখন বঙ্গের সঙ্গে ছিল তখন ছিল একটি প্রান্তিক জেলা, আবার আসামের সঙ্গেও যুক্ত হলো প্রান্তবর্তী জেলা হিসেবে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় শ্রীহট্ট ভাগ হয়ে এক অংশ পড়ল ভারতের সঙ্গে, অপর অংশ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে। তাও পূর্বপাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হলো রেফারেন্ডামের মাধ্যমে। এসব পরিস্থিতি শ্রীহট্টে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে। ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষও হিন্দুদের ইংরেজি শিক্ষা আর মুসলমানদের মাদরাসা শিক্ষার মতো দ্বিবিধ আগ্রহ ও ফাটল বা মতদ্বৈধতার সুযোগ নিয়ে একদিকে মুরারিচাঁদ কলেজকে (১৮৯২) রাষ্ট্রীয়করণ করে এবং অন্যদিকে আলিয়া মাদরাসা (১৯১২) প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখে। সে হিসেবে মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজই আসামের প্রথম কলেজ; এবং দ্বিতীয় কলেজ হচ্ছে কটন কলেজ (১৯০১)। একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে মুরারিচাঁদ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন তৎকালীন শ্রীহট্টের জমিদার ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব রাজা গিরিশচন্দ্র রায় (১৮৪৫-১৯০৮)। সে হিসেবে শ্রীহট্টের উচ্চতর শিক্ষার স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে তাকেই অভিহিত করা চলে।
১৯১২ সালে মুরারিচাঁদ কলেজ রাষ্ট্রীয়করণ হয় এবং একইসালে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে আসেন। ভারতে উচ্চশিক্ষা বিস্তারে তার বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করলে ভারত সরকার শিক্ষাসংস্কারের পরিকল্পনা হতে নেয়। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল আঞ্চলিক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণার সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন। এ-সময়কার আসামের চিফ কমিশনার ছিলেন স্যার আর্চডেল আর্ল। ততদিনে আসামের দ্বিতীয় কলেজ কটন কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে, অহমিয়াদের বাঙালিবিদ্বেষ ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধির কারণেই। এবং সিলেটের জনমানুষের মনে একটা ক্ষোভেরও সঞ্চার হচ্ছে, সরকার নিজেও এ-ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। সরকার দ্বিতীয়শ্রেণির কলেজ হিসেবে এমসি কলেজকে অধিগ্রহণ করেছিল, কার্যভার গ্রহণের চার মাসের মাথায় চিফ কমিশনার সিলেট সফরে এসে ‘দরবারে’ এমসি কলেজকে প্রথম শ্রেণির কলেজ ঘোষণা করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে কটন কলেজ ও তদনুরূপ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা পরিবর্তিত হবে। আসলে এই আশাবাদের ভেতর শ্রীহট্ট অঞ্চলে একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বীজ’ নিহিত ছিল। এই আশাতেই এমসি কলেজকে শহর থেকে টিলাগড়ে থাকারে টিলায় স্থানান্তরিত করা হয়। যদিও মাঝখানে কলেজের জন্য একটা অশনি সংকেত দেখা দিয়েছিল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োজিত ‘স্যাডলার কমিশন’-রিপোর্টে মুরারিচাঁদ কলেজকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে। কারণ হিসেবে কটন কলেজের উন্নতি সাধনের সুপারিশ গৃহীত হয়, যাতে কালক্রমে সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হতে পারে। যদিও আসাম সরকার রিপোর্টটিকে প্রত্যাখ্যান করে। এ-ক্ষেত্রে লর্ড কানিংহ্যামের অবদান প্রশংসনীয়।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ অক্টোবর প্রথম শ্রেণির কলেজ হিসেবেই অঙ্গীকারবদ্ধতার ঘোষণা আসে আসামের চিফ কমিশনার স্যার এনডি বিটসন বেলের কাছ থেকে। ‘দরবারে’ অকুণ্ঠচিত্তে চিফ কমিশনার বলেছিলেন, ‘আমি স্থির নিশ্চিত, সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন সিলেট ও গৌহাটি সংযুক্ত আসামের অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজে রূপান্তরিত হবে।’ চিফ কমিশনারের বক্তব্যে এতদ্অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন আবারও জেগে ওঠে। চিফ কমিশনারের বক্তব্যে রাজনৈতিক উচ্চবাচ্য থাকার সম্ভাবনা থাকলেও ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তিনি সিলেটের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিলেন, ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে। শুধু তাই নয় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতা ‘বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট’ পাশ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার দায়িত্ব ভারত সরকারের নিকট থেকে বঙ্গের প্রাদেশিক সরকারের নিকট হস্তান্তরিত হয়, ফলে মুরারিচাঁদ কলেজের ভবিষ্যৎ তথা আসামে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন স্থবির হয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
২
১৯২১ সালে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ফলে আসাম চিফ কমিশনারের পরিবর্তে গভর্নর-শাসিত প্রদেশে রূপান্তরিত হয়েছিল। এবং গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পান স্যার উইলিয়াম মরিস। অন্যদিকে আসামের শিক্ষাব্যবস্থা প্রাদেশিক বিষয় হিসেবে নির্বাচিত সরকারের অধীনে মন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত হয়েছিল। তখন আশ্চর্যজনকভাবে আসামের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন এমসি কলেজেরই অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ সিআইই ওরফে কাপ্তান মিয়া। তিনিই ১৯২১ সালের ১৯ আগস্ট নবনিযুক্ত গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিসকে দিয়ে কলেজের প্রশাসনিক ভবনের ভিত্তি স্থাপন করিয়ে নিয়েছিলেন। গভর্নর তার ভাষণে উচ্চশিক্ষা প্রসারে গিরিশচন্দ্র রায়ের যে-বিশেষ প্রশংসা করেছিলেন। সুতরাং চিফ কমিশনারের ঘোষণা ও গভর্নরের প্রশংসা সিলেটে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তাই প্রশাসকদের কাছে যে উপলব্ধ হয়, তা-ই প্রমাণ করে এবং সিলেটবাসী একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের দিকেই এগোয়।
কাপ্তান মিয়া ১৯২২ সালের জুন মাসে লোকান্তরিত হন, এবং তার স্থলাভিষিক্ত হন আরেক শিক্ষানুরাগী নেতা রায় বাহাদুর প্রমোদচন্দ্র দত্ত সিআইই। তিনিও এমসি কলেজের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই দুই কৃতীই এমসি কলেজের অগ্রগতির দিকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে যার যার দায়িত্ব পালন করেন। তবে খান বাহাদুর সৈয়দ আবদুল মজিদ সিআইই ওরফে কাপ্তান মিয়ার স্বপ্ন সবার স্বপ্নকেই ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তার স্বপ্নই ছিল সিলেটে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তার স্বল্পকালীন মেয়াদে এ-ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন নি। তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন এমসি কলেজকে টিলাগড়ের ৪০০ একর ভূমিতে স্থানান্তরের মাধ্যমে এখানেই গড়ে উঠবে বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু তার সে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল।
এসময় গৌহাটিতে অসমীয়রা বিশ্ববিদ্যালয়ের জোর দাবি জানায়, সেই সঙ্গে সিলেটিরাও। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে সিলেটি ও অসমীয়ারা মুখোমুখিও হন। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী আর্থিক মন্দার কারণে এক প্রদেশে দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কিন্তু ১৯৩৬ সালের পর প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন পূর্ণভাবে প্রচলিত হলে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব পুনরায় ওঠে। এমতাবস্থায় সিলেটের জননেতা শ্রীব্রজেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা ১৯৩৬ সালে সিলেটে University Convention আহ্বান করেন। সে Convention-এ-ই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ‘ব্লুপ্রিন্ট’ প্রস্তুত হয়। এভাবে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৪১ সালে আসাম প্রাদেশিক বিধান সভায় সুনামগঞ্জের অধিবাসী শিক্ষামন্ত্রী সুনাওর আলী সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপক্ষে বক্তব্য রাখেন। এরপরে শুরু হয়ে যায় ভারত-স্বাধীনতা আন্দোলন।
৩
ভারত-স্বাধীন ও বিভাগ-পূর্বকালে আসাম ও বঙ্গদেশে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজসমূহের মধ্যে এমসি কলেজ ছিল দ্বিতীয় স্থানে, প্রথম ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজ। এবং এটা ঠিক যে, শ্রীহট্ট-আসামে সহসা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত না-হলেও মুরারিচাঁদ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই একটা ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিল জ্ঞান বিতরণ, জ্ঞানসৃষ্টি ও শিক্ষা-গবেষণার ক্ষেত্রে। তার বড়ো প্রমাণ কলেজটির কৃতী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ, যারা এখানে শিক্ষাদান ও শিক্ষালাভ করে বিশ্বব্যাপী জ্ঞানতাত্ত্বিক আলোড়ন তুলেছিলেন। ইতোমধ্যে এমসি কলেজে শিক্ষকতাসূত্রে ও শিক্ষার্থীসূত্রে জড়ো হচ্ছেন অনেক মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। প্রবোধসেন গুপ্ত, নীহাররঞ্জন রায়, যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মতো শিক্ষার্থীর জন্ম দিতে পেরেছে কলেজটি প্রতিষ্ঠার কবছরের মধ্যেই। এবং শিক্ষক হিসেবেও পেয়ে গেছে পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, কমলাকান্ত গুপ্ত, অধরচন্দ্র দাস ও উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখকে। সুতরাং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে সুনাম। ১৯২০ সালের ১৫ অক্টোবরের ঘোষণা সিলেট অঞ্চলের জনমনে যে আশার সঞ্চার করেছিল ও পরে যে-জ্ঞানদীপ্ত মশাল হয়ে জ্বলছিল কলেজটি, তাতে কলেজটিকে ঘিরে প্রত্যাশাও বাড়ছিল মানুষের। ক্রমে আসে কলেজটির সুবর্ণজয়ন্তী।
মুরারিচাঁদ কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নীহাররঞ্জন রায় কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে (১৯৪২) একটি বক্তৃতা করেন, পরে বক্তৃতাটি সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যার তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এটি লিখিত হয়েছিল ইংরেজিতে, শিরোনাম ছিল: What Murarichand College Can do for Sylhet। এই প্রবন্ধ রচনাকালে লেখকের ভেতরে যে-একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মানচিত্র কাজ করেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা তিনি তার প্রবন্ধে একটা রূপকল্প দিয়েছিলেন, যেটা কলেজের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়, এটা নিতান্তই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপার। আসলে তার বক্তব্যে জ্ঞানতাত্ত্বিকভাবেই সিলেট অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব যেমন অনুভূত হয়, তেমনি অন্তরালে একটি বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। প্রবন্ধটিতে এমসি কলেজকে কেন্দ্র করে জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাগবেষণার ক্ষেত্রে যে-সব কিছু যুক্তি ও পরামর্শ দিয়েছিলেন তা ছিল অকাট্য ও সর্বজনস্বীকৃত।
৪
নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, সিলেটে ‘…একটি অর্থনৈতিক সমীক্ষাও আর একটি অন্যতম একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়। সিলেট কৃষিজ ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এবং তার কিছু উৎপন্ন দ্রব্যের বিস্তৃত বাজার রয়েছে। এখনও পর্যন্ত এই সম্পদগুলোর মালিকানা ও দেখাশোনা নিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সুশৃঙ্খল ও পর্যায়ক্রমিক সমীক্ষা করেনি। চুনাপাথর, পেট্রোল ও কয়লা সিলেটের এবং কাছাড়ের তিনটি প্রধান খনিজ দ্রব্য। এগুলো জাতীয় সম্পদ হলেও বর্তমান সামাজিক বিধানে এগুলোর মালিক হচ্ছে ব্যক্তি বা দল। এমনকি ভবিষ্যতের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পনা-প্রণয়নের জন্য বস্তুগত অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। এ-সম্পদসমূহের বিপণনের জন্য এ-পর্যন্ত কোনো জরিপ করা হয়নি। এদের আর্থসামাজিক সম্ভাবনাকেও খতিয়ে দেখা হয়নি, এমনকি মূলধন এবং শ্রমিকের সঙ্গে বিদ্যমান তাদের কাজের সমস্যা নিয়েও কেউ আলোকপাত করেনি। সিলেটে এমন অঞ্চল রয়েছে যেখান থেকে লবণ ও লোহা পাওয়া যেতে পারে। এই সম্ভাবনাময় শিল্প সম্পর্কেও কিছু করা হয়নি। কৃষিপণ্যের মধ্যে চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে চুন, কয়লা এবং তেলও সমান গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপীয় চা-করদের কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে সিলেটের চায়ের ব্যবসা এ-পর্যন্ত অন্যান্য স্থানের মতন আর্থসামাজিক রহস্য রয়ে গেছে।
সিলেট দেশীয় শিল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তার থেকে উৎপন্ন দ্রব্য জেলার ভিতরেই সরবরাহ করা যায়। এই পণ্যসমূহের কয়েকটিকে বর্তমানে আরও বেশি করে উৎপন্ন করার পরিকল্পনা চলছে। এগুলোর বিপণন ও বর্ধিত উৎপাদনের সম্ভাবনা নিয়ে কোনো বিজ্ঞানসম্মত পর্যালোচনা এখনও করা হয়নি। এটা দুঃখজনক যে এগুলোর পূর্ণ ও যথার্থ অর্থনৈতিক সুবিধা সম্পর্কে খুব কম মানুষই অবহিত। আমাদের মধ্যে কজন জানে যে সিলেট এক সময় বার্নশ শিল্পের কেন্দ্র ছিল, যা এখন প্রায় মৃত; অথবা এক ধরনের আগরকাঠ যা মোগলরা সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করত, তারও উৎপাদন প্রায় বন্ধ। হাড় (অস্থি) এবং হাতির দাঁতের ব্যবসায়ও এক সময় সিলেটের বিশেষত্ব ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই শিল্পও মৃতপ্রায়। এটা অর্থনীতির ছাত্র-শিক্ষকদের নৈতিক দায়িত্ব যে, তাদের বের করতে হবে কী জন্য এই বিপর্যয় কুঠির শিল্পের ওপর নেমে এসেছে তা খুঁজে দেখা। যদি আর্থিকভাবে সফল হয় তবে কীভাবে একে পুনরুজ্জীবিত করা যায় এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে ইজারা প্রদান করা যায় এবং পরিকল্পিত সমবায় ভিত্তিতে কিংবা অন্য কোনো কর্মপরিকল্পনার সাহায্যে এগুলোকে পরিচালনা করা যায়-সে-বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে।
কুটিরশিল্পের মতো একই মন্তব্য বেত ও বাঁশ শিল্প, কাঁসা ও পোশাক শিল্প এবং কাঠ শিল্পের ক্ষেত্রে করা যায়। একটি গ্রামীণ অর্থনৈতিক সমীক্ষাও এর জন্য প্রয়োজন। এটি বাংলার অন্যত্র হয়েছে, কিন্তু প্রত্যেক জেলার রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। এটি অসম্ভব কিংবা এজন্য প্রত্যেক গ্রামকে সমীক্ষার আওতায় আনা জরুরি; এক্ষেত্রে প্রত্যেক থানার চার-পাঁচটি আদর্শ গ্রামকে বেছে নিয়ে এবং সুপরিকল্পিত প্রশ্নমালার মাধ্যমে তথ্য যোগাড় করতে হবে। এ-ধরনের প্রশ্নমালা কোনো বড়ো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই প্রণয়ন করা যেতে পারে-যদি একজন এই সকল প্রশ্নের প্রতি এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের বিভিন্ন স্থানের পরিচালিত সমীক্ষার ওপর নজর দেয়। এ-ধরনের সমীক্ষার গুরুত্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়া উচিত নয়। বিশেষত কেউ যখন জাতিভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা বিবেচনা করবে তখন সে-সমীক্ষার ফলাফল থেকে অবগত হবে, যার ফলে এই ধরনের পরিকল্পনা শ্রমিক নিয়োগের পূর্বশর্ত হিসেবে কাজ করবে। এই কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য অংশ ছাত্রদের দিয়ে তাদের অবকাশের সময় করানো যেতে পারে।
পরোক্ষভাবে যে-কোনো সমীক্ষায় ছাত্র এবং শিক্ষকদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলবে, একই সঙ্গে আমাদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়বে এবং নিজের দেশকে তারা আরও ভালো করে জানতে পারবে।…যদি আমাদের শিক্ষক ও সারস্বতসমাজ দেশ ও জনগণকে আমাদের সকলের কাছাকাছি নিয়ে আসতে সাহায্য করেন, তাহলে ধরে নেয়া যায় আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সহায়তা করবে।’ শুধু তাই নয়, নীহাররঞ্জন রায় গবেষক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-উপস্থাপিত আসাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদনের প্রসঙ্গ টেনে সিলেটের বিভিন্ন সমাজতাত্ত্বিক উপাদান, নৃ-পরিচয়, ধর্মবোধ, লোকসাহিত্য, ভাষা-সংস্কৃতির অফুরন্ত উপাদান, ঐতিহাসিক দিক, প্রত্নতত্ত্ব, বাণিজ্যসহ সকলকিছু বিষয়ে মৌলিক গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তার ভাষায়, ‘…আমি ব্যক্তিগতভাবে এমন স্বাধীন প্রচেষ্টার বিপক্ষে নই, বরং গুরুত্ব দিচ্ছি আঞ্চলিক ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিকতার, যেখানে সকল শিক্ষক অংশগ্রহণ করবেন, সহযোগী হিসেবে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে ছাত্রদেরও।’ পণ্ডিত নীহাররঞ্জন রায়ের এই বিবেচনাবোধ ও প্রত্যাশার সঙ্গে চিফ কমিশনারের আশার বাণীর একটা যোগসূত্র আমরা দেখতে পাই, যা সিলেটের জনমনেরও প্রত্যাশা বলে আমরা ধরে নিতে পারি। পরে যখন সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন শুরু হয়, আন্দোলনটি ক্রমশ বেগবান হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এ-আন্দোলনে দলমত ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলেই সমান পতাকাতলে আসীন হয়েছিলেন।
ড. জফির সেতু, কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।