সুনামগঞ্জের উজ্জল নক্ষত্রের নাম আব্দুল হাই-পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ
পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ :-
জুবিলী স্কুলে পড়ি। ছোট শহর। হাতে গুনা বাসা। সবাই সবাইকে চিনেন জানেন। অগ্রজদের আলাপে শুনি আমাদের গুনি মানুষদের নাম। সেই সব গুনি মানুষের ভেতর আলোচনা হয় আব্দুল হাই সাহেবের নাম। আমার শৈশবের বন্ধু যুক্তরাস্ট্র প্রবাসী আব্দুল মুবিন চৌধুরী মাজেদ। তাদের বাসা শহরের আরপিননগরে। তার সাথে যাওয়া হয় তাদের বাড়ীতে। আব্দুল হাই সাহেব মাজেদের চাচা। আরেক বন্ধু যুক্তরাজ্য প্রবাসী আহমদুজ্জামান হাসানের মামা।
কেবি মিয়া প্রাইমারী স্কুলের পেছনে বাসা। স্কুল অতিক্রম করে মাজেদে’র ঘরে যেতে বামপাশের টিনের ঘরটিই আব্দুল হাই সাহেবের। জানালা দিয়ে দেখা যায় ঘরের ভেতর বইয়ের আলমারি। বই ভর্তি ঘর। তখনো তিনি জীবিত। বাড়ীতেই থাকেন। অর্থনীতির শ্রেণী বিভাজনে আমাদের শহরের শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষেরা ছিলেন মধ্যবিত্ত। তার ভেতরেও শহরে কিছু ধনীক শ্রেণীর মানুষের বাড়ীতে দামী আসবাব দেখেছি। তবে আব্দুল হাই সাহেবের মত বই ভর্তি আলমিরা দেখিনি। আমার শৈশবে তাঁর মত ব্যাক্তিগত সংগ্রহে এত বই আর কারো ছিল কি না আমার জানা নেই।
উনার সাথে সরাসরি সম্পর্কের সুযোগ হয়নি। শৈশবে দুর থেকে দেখেছি। বাকিটা অগ্রজদের কাছ থেকে জেনেছি। তাঁর অনেক পরিচয়। পন্ডিত মানুষটি রাজনীতিবিদ ছিলেন। ছিলেন লেখক-গবেষক। সংস্কৃতিবান মানুষটির হাত ধরেই সুনামগঞ্জের শিল্পকলা একাডেমি গড়ে উঠে। ভাষা আন্দোলনসহ মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। সংবাদপত্র বের করেছেন। বহুমুখি প্রতিভা নিয়ে সত্য সুন্দরের সব পথে হেটেছেন। আলোকিত করেছেন সমাজ। একজন সফল শিক্ষক হিসেবে ভুমিকা রেখেছেন সুনামগঞ্জের শিক্ষার প্রসারে।
অসাধারন মেধা নিয়ে জন্মেছিলেন। প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় সেই সময়ের সমগ্র আসামে প্রথম স্থান অর্জন করে শৈশবেই তাঁর মেধার জানান দিয়েছিলেন।
দেশপ্রেমের চেতনায় রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। কারাবরণ করেছেন। কারাগারে বসে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ফলাফলে চমক দেখিয়েছেন। বহুমুখি প্রতিভা উনাকে যেদিকেই নিয়ে গেছে সবখানেই আলো ছড়িয়েছেন। জাতীয় রাজনীতিতে অভিষিক্ত হয়েছেন। আবার চলে এসেছেন নিজ শহরে। অগ্রজরা অনেকে আক্ষেপ করে বলেন তিনি যদি সর্বক্ষেত্রে বিচরন না করতেন। যদি রাজনীতি, লেখক অথবা সংস্কৃতি কোন একটাতে স্থির থাকতেন তাহলে গোটা বাংলাদেশের একজন আলোকিত মানুষ হতেন। পুরো দেশের মানুষ উনাকে নিয়ে গর্ব করত। পুরো জাতিকে অনেক কিছু দেবার প্রতিভা নিয়ে, মেধা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন।
স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জ শহরে তিনি যে লোক উৎসব করেছিলেন আজো সেই উৎসবের কথা মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। প্রশংসায় -সম্মানে।তিনি স্বল্প আয়ু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন। যদি দীর্ঘায়ু হতেন হয়ত আরো অনেক কিছু দিয়ে যেতেন। আমাদের স্কুল জীবনেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আব্দুল হাই এর মত গুনি মানুষদের জন্মের জন্য জল-জোছনার শহরকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এমন মানুষেরা আসেন। উনার মত মানুষের আকালের যুগে তাই বুদ্ধিবৃত্তিক মেধার চর্চা হয়না। সুরম্য ভবন বৃদ্ধি হতে হতে ইট পাথরের শহরে সংস্কৃতি হারিয়ে যায়। আদর্শিক রাজনীতিতে আত্নসম্মান নিয়ে রাজনীতি আলোকিত হয়না। সমাজ রুগ্ন হয়। শিল্প-সাহিত্যের বদলে, আলোকিত রাজনীতির বদলে বামুনদের আত্নম্বরিতা বাড়ে। সাদামাটা জীবনের আদর্শিক রাজনীতি নিভু নিভু করে জ্বলে। আলোকিত হয়না শহর-সমাজ।
আব্দুল হাই এর মত মানুষ কিছু নিতে জানতেন না। সমাজকে দেবার জন্য দিতে এসেছিলেন। শিক্ষায়-জ্ঞানে-পান্ডিত্যে সমাজকে দিয়েই গেছেন।
অস্থির সময়ের নষ্ট মানুষদের দাপট আজ আমাদের প্রান্তিক শহরেও। ক্রমশ অন্ধকার গ্রাস করছে সর্বত্র। আদর্শিক মানুষেরা নীচুস্বরে কথা বলেন। অন্ধকারের আওয়াজ শক্তিশালী। ভালবাসার শহরে অন্ধকার তাড়িয়ে দিতে আব্দুল হাই এর মত বাতিঘর বড়বেশী প্রয়োজন।
আজকের প্রজন্ম বাতিঘর আব্দুল হাইকে জানেনা। এর দায় সবার। সুন্দর সমাজ এবং আলোকিত তারুন্যের প্রয়োজনে উনাকে পাঠ করতে হবে। আমাদের উজ্জল নক্ষত্র আব্দুল হাই। আলোকিত নক্ষত্রকে পাঠ করার সুযোগ করে দিতে হবে। উনার প্রয়োজনে নয়। জীবদ্দশায় ও উনি কিছু নেন নি। দিয়েই গেছেন। এখন ত সব কিছুর উর্ধে। প্রয়োজন আমাদের। এই শহর নষ্ট হতে পারেনা। আলোকিত মানুষ চাই। আলোকিত সুনামগঞ্জ চাই।
লেখক- পীর ফজলুর রমান মিসবাহ- রাজনীতিবিদ ও সাংসদ সুনামগঞ্জ ৪ আসন।
le