সুনামগঞ্জের কৃষক এখন কাজে’র খূজে ঢাকা
তিনি জানান, তারা দুই ভাই (বড় ভাই আবুল কালাম) মিলে মা, বাবা, স্ত্রী, ছেলে মেয়েসহ ভাইবোনদের ৮ জনের সংসার চালান। এখন নিজের এলাকায় দু’জনেরই আয়ের পথ বন্ধ। হাওর বিপর্যয়ের পর কাজের সন্ধানে দিন কয়েক আগে চলে আসেন রাজধানীতে। তাতে যদি ভাগ্য কিছুটা ফেরে। আবু তাহেরের ভাই আবুল কালাম জানান, এমনিতে তিনি রাজধানীতে থাকলেও বছরের এই সময়টাতে চলে যেতেন নিজ এলাকায়। শুধু ঢাকার আয়ে সংসার চলে না, তাই সেখানে কয়েক মাস শুধু ধান কাটাতেই ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু এবারের হাওরের বিপর্যয়ের কারণে আয়ের একটি পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায়ও প্রতিদিন কাজ পান না। কোনো কোনো দিন কাজ থাকে না। তখন ধার-দেনা করে চলতে হয়।
শুধু আবু তাহের বা আবুল কালামই নন, রাজধানীতে এখন কাজের সন্ধানে আসা মানুষদের ভিড় বাড়ছে। হাওর অঞ্চলের হাজার হাজার কৃষকের ধান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে এখন কোনো কাজ নেই। তাই সংসারের খরচ জোগাতে প্রতিদিন ওই এলাকা থেকে অসংখ্য মানুষ রাজধানীতে পাড়ি দিচ্ছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী ও শিশুও রয়েছেন। এদের বেশির ভাগই আসছেন সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চল থেকে। শুক্রবার রাজধানীর ফকিরাপুল, মিরপুর ১০ ও ১ নম্বর, নিউ মার্কেট, আজিমপুর এলাকার সকালের শ্রমের হাট ঘুরে দেখা গেছে এমনই চিত্র। শ্রমের হাটগুলোতে প্রতিদিনই ভিড় বাড়ছে। এদের প্রায় সবাই হাওরের বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন। এখন সেই বিপর্যয় কিছুটা সামাল দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা তাদের। পরিবারের সবার মুখে আবারো হাসি ফোটানোর জন্য নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন তারা। কাজের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছেন রাজধানীতে। তবে, কবে নাগাদ এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা যাবে, সেই দুশ্চিন্তা তাদের চোখে-মুখে।
রাজধানীতে দেশের অন্য সব জেলা থেকে যারা কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছেন বা আসছেন সেই নিয়মিত শ্রমিকরা জানান, আগে যেসংখ্যক শ্রমিক রাজধানীর বিভিন্ন শ্রমের হাটে আসতেন এখন তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আসছেন শ্রমের হাটগুলোয়। এদের একাংশ হাওরের সম্পন্ন কৃষক আর বাকিরা হাওরের এ মৌসুমে বিভিন্ন শর্তে অন্যের জমিতে ধান কাটা, মাড়াই থেকে শুরু করে নানা কাজ করতেন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে দশটায় মিরপুর-১ নম্বর এলাকার পদচারী সেতুর নিচের ফুটপাতে কথা হয় দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েকজন নারী, পুরুষ শ্রমিকদের সঙ্গে। তারা জানান, আগে সিলেট, নেত্রকোনাসহ অন্যান্য হাওর অঞ্চল থেকে এত বেশি মানুষ আসেনি। কদিন ধরেই তারা আসছেন। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় দলবদ্ধভাবে, কখনও এখানে-সেখানে ঘুরে কাজের সন্ধান করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাওর থেকে আসা বানভাসী মানুষেরা ঢাকায় পুরনো ও পরিচিত শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে কাজ করছেন। তবে, বেশিরভাগই কাজ করছেন রঙমিস্ত্রি, নির্মাণশ্রমিক ও মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে। আর নারী ও শিশুদের একাংশ কাজ করছেন বাসাবাড়ি কিংবা রেস্টুরেন্টে। এদের অনেকেই আবার ইটভাঙা ও মাটিকাটার কাজও করছেন। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার শ্রমের হাট ঘুরে বানভাসী কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাদের কেউ অবস্থা সম্পন্ন কৃষক ছিলেন, কেউ অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতেন, কেউ বা অন্যের জমিতে ধান কেটে সংসার চালাতেন। তবে, দুর্ভাগ্য তাদের এখন এক কাতারে এনেছে
আবদুর রহমান (৫০)। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা। তার কৃষিজমি ছিল সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা এলাকার ধারাম হাওরে। আবদুর রহমানের পরিবারের সারা বছরের আয়ের উৎস ছিল ওই হাওরের ৪০ কাঠা কৃষিজমির প্রায় ২০০ মণ ধান; যা দিয়ে পরিবারের ২১ সদস্যের এক বছরের খাদ্যের অভাব ঘুচতো। কিন্তু কদিন আগের হাওর বিপর্যয় আবদুর রহমানকে এখন নিঃস্ব বানিয়েছে। চোখের সামনে তলিয়ে গেছে তার ফসলের ধান। একই সঙ্গে তার স্বপ্ন। যে তিনি এ সময়ে ফসলের ধান কেটে সেই ধানের চালের ভাত পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেতেন, আত্মীয়স্বজন গরিবদের খাওয়াতেন; আজ সে-ই তিনি বাবা, মা, স্ত্রী ছেলে, মেয়ে, ভাইদের ভাতের কষ্ট দূর করতে চলে এসেছেন ঢাকায়। কিছুদিন আগের সম্পন্ন গৃহস্থ আবদুর রহমান এখন রাজধানীর এখানে-সেখানে কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়ান। কখনো কাজ পান, কখনো পান না। আর যেদিন কাজ পান না সেদিন অবধারিতভাবেই দিশেহারা হয়ে যান তিনি।
রাজধানীর ফকিরাপুলের পানির ট্যাঙ্কি এলাকার ফুটপাতে কথা হয় আবদুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এর আগে কোনো দিন ভাতের কষ্ট করতে হইছে না। কিন্তু হাওরের পানি আমার সব কাইড়া নিছে। এ ২০০ মণ ধান দিয়া পুরা সংসার চলতো। কিন্তু এহন আমার কিছুই নাই।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি সাহায্য যা পাই তা দিয়া সবার অয় না। এল্লাইগ্গা দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় আয়া পড়ছি। লগে আমার ভাইও আইছে।
তিনি জানান, বোরো মৌসুমে কৃষিজমির জন্য স্থানীয় ব্যাংক থেকে কিছু টাকা লোন নিয়েছিলেন। সেই টাকা সুদে-আসলে বাড়ছে। এছাড়া আরো কিছু ধার করেছিলেন সুদে। এই টাকা কবে শোধ হবে তা তিনি বলতে পারছেন না। আর এ বিপর্যয়ের রেশ কত দিন টানতে হবে তা-ও তিনি জানেন না। তিনি আরো বলেন, এই মৌসুমে ওই এলাকার যেসব কৃষকের ঘরে ৫০০ থেকে ১ হাজার মণ ধান উঠতো তারাও এখন সরকারি ত্রাণের জন্য লুকিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কেউ কেউ তার মতো কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসেছেন। যে হাওর এলাকায় এই সময়ে নতুন ধানের গন্ধে ম ম করতো, সেই হাওরের ঘরে ঘরে এখন হাহাকার বলে জানালেন আবদুর রহমান।
নেত্রকোনার একই এলাকার বাসিন্দা জামাল মিয়া (৪২)। তারও জমি ছিল ধর্মপাশা এলাকার ধারাম হাওরে। হাওরের নতুন ধান তাকে ও তার ভাই সালামকে স্বপ্ন দেখাচ্ছিল। কিন্তু এপ্রিলের শুরুতেই হাওরের জমিতে ওঠা পানি তার সেই স্বপ্ন শেষ করে দিয়েছে। ৩২ কাঠা জমিতে প্রতি বছর দুই ভাই ধান পেতেন প্রায় ২৫০ মণ। এদিয়ে পুরো পরিবার এক বছর নিশ্চিন্ত থাকতো। কিন্তু এই এক বছরের বিপর্যয় আরো কয়েক বছর তাদের বইতে হবে বলে জানান জামাল মিয়া। কারণ, এ কৃষিজমির জন্য তিনি স্থানীয় একটি ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার টাকা লোন নিয়েছেন। তিনি বলেন, কিছুদিন আগে কাজের লাইগ্গা ঢাকায় আইছি। আগে এই সময়ে ধান কাডার লাইগ্গা হাওরে থাকতাম। তখন মনে আনন্দ ছিল। কিন্তু এবার শোকে পাথর হইয়া গেছি। খালি জানডা ছাড়া আমরার আর কিছুই নাই। সামনের দিনগুলো কীভাবে যাবে- এমন প্রশ্নে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন জামাল মিয়া। কোন উত্তর নেই তার মুখে।
সুনামগঞ্জের ছাতক দোয়ারা এলাকার রহমান (৩৫)। সেখানকার একটি হাওরে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৩০ কাটা কৃষিজমি থেকে যে ধান পেতেন তাই দিয়ে পুরো পরিবারের চলে যেতো। মধ্য এপ্রিলে সেই এলাকা তলিয়ে যাওয়ায় তার ধানও পানির নিচে চলে যায়। কিছু ধান ওঠানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেই চেষ্টা বৃথাই যায়। চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তার। পরে ভবিষ্যৎ চিন্তায় দুই সপ্তাহ আগে কাজের সন্ধানে চলে আসেন ঢাকায়। তিনি জানান, প্রতি এক হাজার টাকায় ১ মণ ধান-এই শর্তে কৃষিজমির জন্য স্থানীয় সুদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তিনি।
রহমান বলেন, প্রতি বছরই তিনিসহ ওই এলাকার আরো যাদের কৃষিজমি আছে তারা এই মৌসুমে বিভিন্ন সুদ ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন। কিন্তু এবারের এ বিপর্যয়ে সেই টাকা কেউই আর ফেরত দিতে পারেবন না। তিনি বলেন, এহন টেহাও দেয়া লাগবো, ধানও দেয়া লাগবো। আর না দিলে পাওনাদাররা রেহাই দিব না।