বার্তা ডেস্ক :: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) সুলতান মোহম্মদ মনসুর আহমদের এখনকার রাজনৈতিক ঠিকানা বা অবস্থান কী—এমন প্রশ্নের জবাব সম্ভবত তিনি নিজেও দিতে পারবেন না। কারণ রাজনীতিতে যাঁর উত্থান আওয়ামী লীগ দিয়ে সেই দলেই এখন তাঁর প্রাথমিক সদস্য পদ নেই। আবার গত নির্বাচনে যে দলের সদস্য পদ নিয়ে তিনি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, সেই গণফোরাম থেকেও বহিষ্কৃত সুলতান। পাশাপাশি নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচিত সুলতানের সঙ্গে বিএনপিরও এখন ঘরে-বাইরে শত্রুতা। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সুলতান তুমি কার! অবশ্য রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর বলেন, ‘পদ-পদবি না থাকলেও আমি আওয়ামী লীগেই আছি। তা ছাড়া অন্য কোনো দলে আমি যোগদানও করিনি।’ গত বছর ৭ মার্চ সংসদে যোগদানের পর থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্ক নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯৬৮ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে আছি। বঙ্গবন্ধুবিরোধী রাজনীতির যে ধারা, তার সঙ্গে আমি নেই।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সুলতান আমাদের ফ্রন্টের কেউ নন। কারণ তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’ দীর্ঘদিন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় এবং বর্তমানে দলটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বলেন, ‘সুলতান মনসুর এখন আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে নেই। কুলাউড়ার স্থানীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ নেই বলেই জানি।’ ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগে সুলতান মনসুরের ফেরার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি সময় বলে দেবে।’ প্রায় ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সুলতান কখনো স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেননি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে একসময়ের সৎ, পরিচ্ছন্ন ও সুনীতির এই মানুষটি যেন এখন সুবিধাবাদী রাজনীতির উদাহরণ হয়ে উঠেছেন। অবশ্য ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সুলতান সংসদে যোগ দেওয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকে খুশিও হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁকে ধন্যবাদ জানান।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক নিবন্ধে আশাবাদ ব্যক্ত করে লিখেছিলেন, ‘সুলতান ঘরে ফিরবেন। তিনি সাময়িকভাবে পথ হারিয়েছেন। পথভ্রষ্ট হননি।’ নির্বাচনের পর আরেক নিবন্ধে সুলতান ও মোকাব্বির খানকে তিনি বেঈমান নয় দেশপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করেন। তবে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার স্থানীয় রাজনীতিতে সুলতানকে নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কারণ মৌলভীবাজার-২ আসনের এই সংসদ সদস্যের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বেশির ভাগ নেতাই এখন নেই। যদিও নির্বাচনের আগে ধানের শীষের কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটভুক্ত দলগুলোর নেতাকর্মীরা তাঁর সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে যোগ দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে সবাই চলে গেছেন। কুলাউড়া বিএনপির সভাপতি জয়নাল আবেদীন বাচ্চু বলেন, ‘সুলতান মনসুরের পক্ষে স্থানীয় আওয়ামী লীগও নেই, বিএনপিও নেই। তিনি জাস্ট কুলাউড়ার এমপি। ফলে তাঁকে এমপি-লীগ বা এমপি-দল বলা যায়।’
মৌলভীবাজার-২ আসনে গত নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন একসময়ের বিএনপির নেতা ও সংসদ সদস্য এম এম শাহীন। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, ‘উনি হলেন এখন নিঃস্ব মনসুর। কোথাও কেউ ওনার সঙ্গে নেই। গত বছর ডিসেম্বরের পরে তিনি আর এলাকায় যাননি।’ আওয়ামী লীগ সুলতানকে আবার গ্রহণ করবে কি না জানতে চাইলে শাহীন বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর জীবদ্দশায় এটা ঘটবে বলে মনে হয় না। সে রকম হলে প্রধানমন্ত্রী আগেই তাঁকে মনোনয়ন দিতেন।’ মূলত ২০০৭ সালের এক-এগারোর পর সংস্কারপন্থী হিসেবে আখ্যা পাওয়ায় আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়েন সুলতান। ওই সময় তিনি সরাসরি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা না বললেও সংস্কারপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। কুলাউড়ার স্থানীয় নেতারা মনে করেন, সুলতানের অনানুষ্ঠানিক কিছু কথাবার্তার রেকর্ড তাঁর শত্রুরা প্রধানমন্ত্রীকে শুনিয়েছেন। এই কারণে প্রথম দফায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হন। এরপর ২০০৯ সালের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ পড়েন সুলতান। সবশেষে নিজ জেলা মৌলভীবাজার জেলা কমিটি থেকেও বাদ দেওয়া হয় তাঁকে।
কুলাউড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের মূলধারার সঙ্গে সুলতান মনসুরের কোনো সম্পর্ক নেই। এমপি থাকায় তৃণমূলের দু-একজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘উনি ব্যক্তিগত স্বার্থে কখন কার সঙ্গে সুর মেলান, সেটা বলা মুশকিল। সকালে এক কথা এবং বিকেলে এক কথা, সবার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’ ১০ বছরে গণমাধ্যমে সুলতানের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এক-এগারোর সময় কিছুটা ‘কৌশলী’ ভূমিকা পালন করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে সরকারের বিরুদ্ধে বেশ সরব হয়েছেন সুলতান। ওই সময় নির্বাচনী জনসভাগুলোতে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হন। সুলতান বলেন, ‘দেশে আজ গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত। খালেদা জিয়াকে মাত্র দুই কোটি টাকার জন্য আটকে রাখা হয়েছে। ভোটারবিহীন এমপি ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দেশের জনগণ অবস্থান নিয়েছে।’ বিএনপির পাশে মুজিব কোট পরেই তিনি ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ বলতেন।
অবশ্য সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সুলতান একবারও খালেদা জিয়ার নাম নেননি। উল্টো নির্বাচন পরবর্তীকালে তিনি বলেন, ‘আমি আজন্ম আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ কর্মী এবং বঙ্গবন্ধুর অনুসারী। একই কথা বারবার বলে আসছি, আমার রাজনৈতিক আদর্শ জয় বাংলা।’ গত বছর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তিনি জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তিনি।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েও তিনি বলেন, ‘যেই দল থেকেই নির্বাচিত হই না কেন, জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে কোনো আপস নেই।’ ২০০৮ সালের পর ২০১৪ সালের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর। ওই নির্বাচনে তিনি অংশও নেননি। কিন্তু ওই নির্বাচনের পর আস্তে আস্তে অবস্থান বদল করে তিনি ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় শামিল হন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ১০ নভেম্বর গণফোরামের সদস্য পদ পান মনসুর। পরে ৯ ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন পান তিনি। ধানের শীষের মনোনয়ন ফরমে তখন স্বাক্ষর করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পরই অবস্থান বদল করে ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন সুলতান। ওই সময় তিনি বলেন, ‘আমি গণফোরামের কেউ ছিলাম না। এখনো নেই। আমি আওয়ামী লীগকর্মী।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করার সময় একটি নিবন্ধিত দলের সদস্য পদ নিতে হয়। আমার চিন্তার কাছাকাছি একটি দলের সদস্য পদ নিয়েছিলাম। এটি শুধু নির্বাচনের কারণে এবং নিয়ম রক্ষার জন্য করেছি।’ এর পর ৭ই মার্চ সংসদে যোগদান করেন মনসুর। ওই দিন বিকেলেই তাঁকে গণফোরাম তথা ঐক্যফন্ট থেকে বহিষ্কার করা হয়। সংসদে তাঁর যোগদানে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসেন তখন সুলতান মনসুর সম্পর্কে বলেন, ‘মানুষের মাথা কেনা যায় না। গরু-ছাগলের মাথা কেনা যায়। যারা গরু-ছাগলের মতো বিক্রি হয়, তারা দালাল হিসেবে পরিচিত।’
একই সময় ঐক্যফ্রন্টের সিদ্ধান্তের বাইরে সংসদে যোগদানকারীকে বেঈমান বলে আখ্যায়িত করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘সুলতান মনসুর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়ী হয়েছেন। লোভে পড়ে সংসদে গিয়ে তিনি নিজেকে ছোট করেছেন। জাতির সঙ্গে তিনি প্রতারণা করেছেন।’ গণফোরামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ‘সুলতান মনসুর, জনগণের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন।’ আর ‘সুলতান মনসুরের শপথে টাকা-পয়সার লেনদেন থাকতে পারে’—এমন মন্তব্য করেন ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের অধিকারী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর ১৯৮৬ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন। তার আগে ১৯৬৮ সালে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে ডাকসুর ভিপি পদে তাঁর বিজয় হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র সুলতানই ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ডাকসু ভিপি। ২০০২ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে তাঁকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়। ১৯৯৬ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এক-এগারোর পরে পদস্খলন ঘটলেও ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা ছিলেন সুলতান। পঁচাত্তর-পরবর্তী ডাকসু ভবনে তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি উত্তোলন করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে প্রতিরোধ আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এ কারণে জীবনের বড় একটা সময় তাঁর কাটতে হয়েছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ে আত্মগোপনে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আক্ষেপ করে সুলতান বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ ছেড়ে আসিনি। আওয়ামী লীগই আমাকে ছেড়েছে। আমার পদ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।’-কালের কণ্ঠ
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৭০ বার