সৌদি-ইসরাইল মিত্রতায় ঝুঁকির মুখে ফিলিস্তিন
পূর্ব জেরুজালেম: গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে আরব বিশ্বের পরিস্থিতি। উপসাগরীয় এই অঞ্চলটিতে এখন চলছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা। এই স্বার্থের কাছে ফিলিস্তিন সমস্যা ও ইসলামি বিষয় আর পাত্তা পাচ্ছে না। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরাইল। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা হলেও বিবেকবান মানুষের নৈতিক সমর্থন পায়নি দেশটি। ইহুদিবাদী দেশটির পরবর্তী ইতিহাস শুধু যুদ্ধ আর রক্তের। আরব আর ফিলিস্তিনিদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আছে দেশটি। এজন্য মিশর থেকে যুদ্ধ করে অনেকটা জোরপূর্বক স্বীকৃতি আদায় করলেও এতোদিনে আরব বিশ্বের আনুষ্ঠানিক সমর্থন পায়নি দেশটি। এখনো দখলদার দেশটির বিরুদ্ধে অনেকটা খালি হাতে লড়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। হয়তো এমন আশা- একদিন আরব মুসলিম ভাইদের সহযোগিতায় নিজ ভূখণ্ড উদ্ধার করে উদ্বাস্তু ও অবরুদ্ধ জীবনের অবসান ঘটবে। কিন্তু পরিস্থিত এখন অনকেটাই ভিন্ন। ফিলিস্তিনিদের দখলদার বিরোধী আন্দোলন নিয়ে এখন আর মাথা ঘামাতে প্রস্তুত নয় আরব দেশগুলো। এতোদিন বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসরাইলের জাতিগত নিধনযজ্ঞের প্রতিবাদ জানালেও এখন সেই অবস্থান থেকেও সরে আসছে তারা।
ফিলিস্তিন ইস্যু আরবদের এজেন্ডা থেকে বেশ কয়েক বছর আগেই বাদ পড়েছে। দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল গোপন সম্পর্ক। ইসরাইলি নৃশংসতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের অনুভূতি উপলব্ধি করে এটা প্রকাশ্যে আনতে ইচ্ছুক ছিল না আরব বাদশাহ ও একনায়করা। তবে সেই রাখঢাক এখন আর রাখতে চাইছে না সৌদি আরব। বিশেষ করে সৌদির নতুন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ‘মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার নতুন কাঠামো’ দিতে গিয়ে ইসরাইল বিরোধীতার ধারা থেকে প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে চান। আর এই সুযোগে আরব সমাজে ‘ইসরাইল-ট্যাবু’ ভাঙতে চান দখলদার ইহুদি শাসকরা।
সম্প্রতি ইসরাইলের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা ঘটা ঘরেই আরব বিশ্বের সঙ্গে তাদের এতোদিনের চলে আসা গোপন সম্পর্ক সামনে নিয়ে এসেছেন। আরব বিশ্বে যত দ্রুত ‘ইসরাইল-ট্যাবু’ ভাঙবে ততোই লাভ তেলআবিবের। সৌদি আরব ও ইসরাইলকে এই মিত্রতায় নিয়ে এসেছে ‘একই শত্রু’ ইরান। দেশ দুটি মনে করে, এখন ফিলিস্তিন ইস্যুর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব ঠেকানো। বিশেষ করে সিরিয়া ও ইয়েমেনে ধরাশায়ী হওয়া সৌদি আরব এখন যেকোনো মূল্যে ইরানকে ঠেকাতে চায়।এক্ষেত্রে সৌদিকে সামরিক, বেসামরিক, কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা সমর্থন দিয়ে সাহায্য করতে পারে ইসরাইল। পাশপাশি সৌদির সঙ্গে রয়েছে মিশর, জর্ডান, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নিয়ে গঠিত কথিত ‘সুন্নি ব্লক’। সৌদির এই নতুন নীতিতে সমর্থন না থাকায় ইতোমধ্যে কাতারকে একঘরে করা হয়েছে। ইসরাইলের এতোদিনের কৌশল ছিল ‘শান্তি প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখে’ ধীরে ধীরে উচ্ছেদের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের জর্ডানে ঠেলে দেয়া। মধ্যপ্রাচ্যের ‘পাওয়ার হাউজ’ সৌদির সমর্থন পেলে তাদের জন্য কাজটি আরো সহজতর হবে।
অবশ্য আনুষ্ঠানিক মিত্রতার আগে সৌদি আরব চাচ্ছে ইসরাইল ফের ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কথিত শান্তি আলোচনায় বসুক। এতে ফলাফল না আসলেও অন্তত জনগণের কাছে তাদের মুখরক্ষা হবে। বিষয়টি নিয়ে দোড়-ঝাপ অব্যাহত রেখেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্পের ইহুদি জামাতা জারেড কুশনার। এজন্য তিনি একটি ‘নতুন পরিকল্পনা’ নিয়েও এগোচ্ছেন যাকে ট্রাম্প ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। সৌদি আরব এখন আর মুসলিমদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস দখলমুক্ত করা নিয়ে এতোটা আন্তরিক নয়। তারা আপাতত হারামাইন শরিফ- মক্কা ও মদীনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান। সৌদি নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, ফিলিস্তিন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে এখন অনেক ইস্যু তৈরি হয়েছে যা আগে সমাধান দরকার। পশ্চিমতীরের রামাল্লাহ ভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক খালিল শাহীন বলেন, ‘আঞ্চলিক হুমকির এই নতুন কাঠামো প্রদানের বলি হবে ফিলিস্তিন ইস্যু। (ইসরাইলের সঙ্গে) সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ এখন আর বিতর্কিত নেই। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের এই সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় ধরনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।’ তিনি বলেন, ‘আরব দেশগুলো এখন তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার দৌড়ে রয়েছে। এই বিষয়টিই তাদেরকে এই অঞ্চলের শক্তিশালী দেশটির (ইসরাইল) দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’