ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে অন্তত ১৫০ জনের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে, উদ্ধার করা হয়েছে আরো অন্তত দেড়শত জনকে। স্বপ্নের ইউরোপ পৌঁছাতে আর কত অভিবাসীর লাশ ভাসবে সাগরে? বৃহস্পতিবার লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলির ১২০ কিলোমিটার দূরের আল খোমস থেকে নৌকাটি ছেড়ে এসেছিল বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। ইতিমধ্যে বৃহস্পতিবারের নৌকাডুবির ঘটনাকে ভূমধ্যসাগরে সবচেয়ে ভয়াবহ ট্র্যাজেডি আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। প্রতি বছর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অসংখ্য অভিবাসনপ্রত্যাশী ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সালের প্রথম চার মাসে লিবিয়া থেকে ইউরোপ যাওয়ার পথে ১৬৪ জন মানুষ সমুদ্রে প্রাণ হারান। ২০১৫ সালের ২৭ আগস্টে সমুদ্রপথে লিবিয়া যাওয়ার পথে ২৪জন বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের অভিবাসী প্রত্যাশীদের মধ্যে ১১৮ জনের মৃত্যু হয়। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৭ হাজার ২১৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এর মধ্যে ১১ হাজার ৭১৫ জনের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া থেকে ইটালি যাওয়ার পথে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে প্রায় ১৬হাজার শরণার্থী ও অভিবাসনপ্রত্যাশী ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন।গত বছরের শুরুর তিন মাসের তুলনায় যা প্রায় ১৭ শতাংশ কম। এই হার কমে আসার পেছনে কাজ করেছে নতুন একটি নীতি। সমুদ্রে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের উদ্ধার করা হলে তাদের আবার লিবিয়ায় ফেরত পাঠাতে বাধ্য করছে ইতালি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ নীতির নিন্দা জানিয়েছে। ইউরোপের পাড়ি দেয়ার উদ্দেশে ভূমধ্যসাগরে অনেক লাশ নিখোঁজ থাকে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ইউরোপের বেশকটি মানবাধিকার সংগঠন। জাতিসংঘও বারবার বলেছে, ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের পুনরায় লিবিয়ায় ফেরত পাঠানো উচিত নয়। লিবিয়ায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের যেমন অমানবিক পরিস্থিতিতে জীবনধারণ করতে হয়, সেটি বিবেচনায় নিয়েই তাঁদের লিবিয়ায় ফেরত পাঠানোর বিপক্ষে মত দেয় জাতিসংঘ।
প্রশ্ন হচ্ছে, এত সংখ্যক মানুষ কেন ইউরোপে আশ্রয় চাইছেন? শরণার্থী, হিউম্যানিটারিয়ান ও সাবসিডিয়ারি এই তিন ক্যাটাগরিতে আশ্রয় দেয়া হয়ে থাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যারা শরণার্থী স্ট্যাটাসের যোগ্য নন কিন্তু দেশে ফিরে গেলে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের সাবসিডিয়ারি সুরক্ষা দেয়া হয়। আর অসুস্থতা ও অভিভাবকহীন শিশুদের মানবিক (হিউম্যানিটারিয়ান) বিবেচনায় আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়।
ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যত মানুষ প্রবেশ করেছেন, সে তালিকার শীর্ষ দশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রায়ই বাংলাদেশও থাকছে। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ১২৬ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন। ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ২১ হাজার ৪৬০ বাংলাদেশি ইউরোপ গেছেন ২০১৫ সালে। অথচ ২০১৪ সালে ওই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৩৫। ২০১৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৯ হাজার ৪৯০ জন। ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭ হাজার ৮৫, ৮ হাজার ৮৭০, ৯ হাজার ৭৭৫, ১১ হাজার ২৬০ ও ১৫ হাজার ৩৬০ জন। এভাবে সাগরপথে আসতে গিয়ে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু, তবুও ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা থেমে নেই। প্রশ্ন হলো কবে থামবে? স্বপ্নের ইউরোপ পৌঁছাতে আর কত লাশ সাগরে ভাসবে। আর কত মানুষের প্রাণ গেলে হুঁশ ফিরবে আমাদের? আর কবে সচেতন হবে মানুষ? অনেক বাংলাদেশিরই জানা নেই, ইউরোপের পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। ইউরোপ এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, বরং কাগজপত্রহীন মানুষগুলোকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই তো বছর দুয়েক আগে ইউরোপ বলে বসলো, এক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি আছে ইউরোপের দেশগুলোতে। তাদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা বন্ধের হুমকিও দিয়েছিল ইউরোপ। তবে ইউরোপে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের সংখ্যা নিয়েও আপত্তি রয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। ২০১৮ সালে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন জমা পড়েছে ৭ হাজার ৯৬৩, ইতালিতে ৪ হাজার ১৬২, গ্রিসে ২ হাজার ৪৯৮জন।
সংবাদ টি পড়া হয়েছে :
৫৮ বার