স্বাধীনতা মানে কী?-তসলিমা নাসরিন
আমি আর সবার মতো বলতে চাইছি না ছবিতে খিলজি আর পদ্মাবতীর কোনও অন্তরঙ্গ দৃশ্য নেই। আমি বলতে চাইছি, যদি থাকেই, তাহলে ক্ষতি কী? ইতিহাসে পদ্মাবতীর কোনও উল্লেখই নেই, কিন্তু কাব্যে আছে বলে পদ্মাবতীকে আজ ঐতিহাসিক চরিত্র বলে ভেবে নেওয়া তো ঠিক নয়। সত্যিকার ঐতিহাসিক চরিত্রগুলোকেই শিল্পী সাহিত্যিকরা নতুন করে নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে চিরকালই লিখেছেন, এঁকেছেন। চলচ্চিত্রে, নাটকে, গানে চরিত্রগুলো বারবার এসেছে, সবসময় যে একই রূপে, একই গল্পে তা নয়। ইতিহাস নিয়ে প্রচুর চলচ্চিত্রই নির্মিত হয়েছে, যেগুলোতে রয়ে গেছে প্রচুর ভুল। ১৯৯৮ সালে শেখর কাপুর এলিজাবেথ নামে একটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন, ওই ছবিতে তিনি দেখিয়েছেন রানী এলিজাবেথ তাঁর উপদেষ্টা স্যার উইলিয়াম সেসিলকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য করেছেন। বাস্তবে কিন্তু উল্টোটা ঘটেছিল, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্যার উইলিয়াম সেসিল রানীর সবচেয়ে বিশ্বস্ত মানুষ হয়ে রানীর পাশে ছিলেন। পাশ্চাত্যের উচ্চাঙ্গ সংগীত তারকা পিয়ানোবাদক মোজার্টের জীবন কাহিনি নিয়ে ‘আমেডিউস’ নামের চলচ্চিত্রে মোজার্টকে দেখানো হয়েছে একটা নষ্ট ছোঁড়া হিসেবে, বাস্তবে মোজার্ট মোটেও তা ছিলেন না। সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি টাইটানিক ছবিতে জাহাজ দুর্ঘটনা সত্য , কিন্তু জ্যাক ডোসন আর রোজের প্রেম কাহিনি সত্য নয়। ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ ছবিতে ব্রিটিশ ট্রুপের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ‘ইউ-৫৭১’ ছবিতেও ব্রিটিশের বদলে আমেরিকান সৈন্য দেখানো হয়েছে। এসব নেহাতই ইতিহাস বিকৃতি। ইতিহাস বিকৃতি আরও কত যে ছবিতে প্রকট, গ্ল্যাডিয়েটর, ব্রেভহার্ট, দ্য পেট্রিয়ট, মারি আন্তোয়ানেত, সেক্সপিয়র ইন লাভ…। সমালোচকরা বিকৃতির এবং ভুল তথ্যের নিন্দে করেছেন। কেউ কেউ আবার শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ছবি নিষিদ্ধ করেননি, কেউ পরিচালকের মাথার মূল্য ঘোষণা করেননি, কেউ অভিনেতা বা অভিনেত্রীর নাক-কান কেটে ফেলার ফতোয়া দেননি। এসব দেওয়া হচ্ছে ভারতের মতো নানা ধর্মের, নানা ভাষার, নানা রঙের মানুষের গণতন্ত্রে। আর কোনও দেশে না হোক, খাজুরাহো আর ইলোরা অজন্তার দেশে শিল্পীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করাটা দেশকেই, দেশের শিল্পকেই, চরম অপমান করা।
ইতিহাসের রদ-বদল এবং বিকৃতি হামেশাই হচ্ছে। কেউ যখন আমরা সঠিক করে জানি না ঠিক কী ঘটেছিল সুদূর অতীতে, আমরা কল্পনা করে নিই অনেক ঘটনা। চার্লস ডিকেন্সকে নিয়ে লেখা হয়েছে ‘দ্য লাস্ট ডিকেন্স’, এডগার অ্যালেন পোকে নিয়ে ‘দ্য পো শ্যাডো’, এসব তো আছেই, আলেক্সান্দ্র দুমা লিখেছেন ‘কুইন মারগো’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে লেখা হয়েছে ‘প্রথম আলো’। এরকম নানা বইয়ে মেশানো হয়েছে সত্যের সঙ্গে মিথ্যে, অথবা খানিকটা সত্যের সঙ্গে অজস্র কল্পনা। বইয়ে কতটুকু সত্য আর কতটুকু কল্পনা তা নিয়ে বিতর্ক হয় হোক। ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে শুধু তথ্যচিত্র হতে পারে, কোনও চলচ্চিত্র নয়। এ নিয়ে হোক বিতর্ক। হোক কলরব। আবারও বলছি, বিতর্ক হওয়া ভালো, কিন্তু বই বা চলচ্চিত্র, বা কোনও শিল্পকর্ম নিষিদ্ধ করা আর গণতন্ত্রকে নিষিদ্ধ করা একই জিনিস। আমরা গণতন্ত্র নিষিদ্ধ হোক চাই না। মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে এখনও অধিকাংশ মানুষের কোনও ধারণা নেই। তারা গণতন্ত্র মানে এখনও বোঝে নির্বাচন, ভোটে হারা, ভোটে জেতা। মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করলে এখনও অধিকাংশ মানুষ রায় দেয়, মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অধিকার কারোর নেই। তারা বলতে চায়, কারওরই এমন কোনও কথা বলা বা কাজ করা উচিত নয়, যা দেখে বা পড়ে বা শুনে অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। এর মতো অগণতান্ত্রিক মন্তব্য আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। কেউই, বিশেষ করে প্রতিভাবান কেউ, সবাইকে খুশি করে বা সুখী করে চলতে পারে না। ভিন্ন মতে বিশ্বাস করে যারা, তাদের হয় মুখ বুজে থাকতে হবে অথবা মরে যেতে হবে।
পদ্মাবতী ইতিহাসের অংশ নয়। অংশ হলেও তাকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করার অধিকার সবার আছে। সাধারণ মানুষের আছে, কবি সাহিত্যিকদের আছে, চলচ্চিত্র পরিচালকদের আছে। আর যদি ইতিহাসের অংশ না হয়, তাহলেও পদ্মাবতীকে যেমন ইচ্ছে গড়ার স্বাধীনতা শিল্পীদের আছে। শিল্পীদের হাত থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নিলে তাদের আর কিছুই থাকে না। একটি সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক এবং কতটা সভ্য, তা নির্ভর করে সেই সমাজের নারীরা এবং শিল্পীরা কতটা স্বাধীন। পদ্মাবতীর নিষিদ্ধকরণ বুঝিয়ে দিচ্ছে ভারতবর্ষের সমাজ এখনও পড়ে আছে অগণতন্ত্রের অন্ধকারে। ‘পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের নাম ভারত’ – এই স্লোগান না দিয়ে বরং ‘গণতন্ত্র কাকে বলে’ তা শিখতে হবে ভারতবাসীকে। এও বুঝতে হবে, তোমার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তোমার সামাজিক অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে, তোমার রাজনৈতিক অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে–এ সমস্যা তোমার, অন্য কারোর নয়। এই সমস্যার সমাধান তোমাকেই করতে হবে, অনুভূতির আঘাত নিয়ে ঝামেলা হলে নিজের অনুভূতির আঘাত নিজে সারাও। কিন্তু সহিংস হয়ে নয়, অন্যকে হুমকি দিয়ে নয়, অন্যকে শারীরিক আঘাত দিয়ে নয়। মৌলবাদীদের যুক্তি অনেকটা ধর্ষকদের যুক্তির মতো। মেয়েরা ছোট পোশাক পরলে আমরা উত্তেজিত হই, সুতরাং আমরা ধর্ষণ করি। একইভাবে চলচ্চিত্রে এমন দৃশ্য দেখিয়েছ যা আমাদের অসন্তুষ্ট করে, উত্তেজিত করে, রাগান্বিত করে, সুতরাং তোমার চলচ্চিত্র আমরা নিষিদ্ধ করবো, তোমার মুন্ডু কেটে নেবো, তোমার নাক কেটে নেবো। মৌলবাদীদের যুক্তিতে পদ্মাবতীর নিষিদ্ধকরণ আর মাথার মূল্য ধার্যকরণ মেনে নেওয়া মানে–ধর্ষকের যুক্তিতে ধর্ষণ মেনে নেওয়া। এ দুটোতে তফাৎ কিছু নেই। নারীর এবং শিল্পীর স্বাধীনতা অধিকাংশ মানুষ না মানলে সমাজে নারী এবং শিল্পীদের বিরুদ্ধে যে বর্বরতা দেখি, সেই বর্বরতাই আজ দেখছি ভারতবর্ষে।
লেখক: কলামিস্ট