হাওরের বাঁধ নির্মাণে প্রভাবশালীরা অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে : টিআইবি
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) মাধ্যমে বাস্তবায়িত জলবায়ু প্রকল্পগুলোতে সুশাসনের উল্লেখ্যযোগ্য ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।সংস্থাটি বলছে, জলাবায়ু প্রকল্পগুলোতে স্থানীয় জনগণ থেকে শুরু করে সাবেক মন্ত্রীর আত্মীয়, সংসদ সদস্য, সচিব ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের প্রভাবকে গুরুত্ব দিচ্ছে পাউবো। বাঁধনির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়ম ও দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে। জনগণকে উপেক্ষা করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি করছে।
বুধবার সকালে রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে ‘জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সুশাসন: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’ শীর্ষক টিআইবির এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। অনুষ্ঠানে গবেষণাপত্র উত্থাপন করেন টিআইবি’র প্রোগ্রাম ম্যানেজার গোলাম মহিউদ্দিন।
এ সময় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা ড. সুমাইয়া খায়ের, প্রোগ্রাম ম্যানেজার রাজু আহম্মেদ মাসুম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।গবেষণা প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, ছয়টি প্রকল্পের বিষয়ে স্থানীয় জনগণ জানে না। সবার অগোচরে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে পাউবো। ছয়টি প্রকল্পের মধ্যে চারটিতে বিভিন্ন পর্যায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থানীয় সংসদ সদস্য, সচিব ও ইউপি চেয়ারম্যান প্রভাব খাটিয়েছেন। এসব প্রকল্পে পাউবোর যোগসাজশে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রীর আত্মীয় ও স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রভাব খাটিয়েছেন। জনগণের কথা গুরুত্ব না দিয়ে প্রভাবশালীদের প্রাধান্য দিচ্ছে পাউবো।
একটি প্রকল্পের ঠিকাদার খাল খননের মাটি বাঁধের পাড় টেকসই না করে নিজের ইটভাটায় ব্যবহার করছেন। বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে অনিয়ম চরমে উঠেছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। হাওর অ্যাডভোকেসি প্লাটফর্ম’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বিভিন্ন সময় হাওর এলাকা পরিদর্শন করে পাউবোর বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সন্ধান পেয়েছে। হাওরে বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে পাউবো কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের যোগসাজশে দুর্নীতি হয়েছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ডের (বিসিসিটিএফ) অর্থায়নে পাউবো ২০০৯-১০ অর্থবছরে চলতি বছরের জুলাই কার্যক্রমের প্রতিবেদন প্রকাশেরও সুপারিশ করেছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, অসময়ের বন্যা কিংবা বারবার বন্যার কারণে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের বিষয়টি যখন আলোচিত তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড জলবায়ু সংক্রান্ত প্রকল্প গ্রহণ করে কি করছে তা দেখাই ছিল টিআইবির গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। এতে টিআইবি পাউবোর ৬টি প্রকল্প যাচাই করে। তবে গবেষণার ফলাফলে টিআইবি সংখ্যার হিসাবে চূড়ান্ত কোনো তথ্য না দিয়ে বরং ছোট বড় নানা রকম দুর্নীতি হচ্ছে সেই বিষয়টি তুলে ধরা হয়। এ সময় টিআইবির গবেষক গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘ঠিকাদারের নিজস্ব ইটভাটার বিজনেস আছে। খাল যে কেটেছেন সে মাটিটা বাঁধের পাড় শক্ত করার জন্য দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উনি নিজের ইটভাটায় নিয়ে চলে গেছেন। একটি প্রকল্পে রাস্তার নির্মাণ কাজের সময় ঠিকাদার ১০ থেকে ১৫টি গাছ, সেই যে রাস্তায় আছে, সেগুলি কেটে গাছপ্রতি গড়ে ২৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। ঠিকাদার অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কেউ ভয়ে কিছু বলেনি।’
গবেষণায় দেখা যায়, জলবায়ু প্রকল্প যে এলাকার জন্য বেশি প্রয়োজন সেখানে তা বাস্তবায়ন না হয়ে হচ্ছে তুলনামূলক কম প্রয়োজনীয় এলাকায়। এমনটি পর্যবেক্ষণ করে টিআইবির গবেষণা দল খুঁজে পায়, ৬টি প্রকল্পের ২টিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য, ১টিতে প্রাক্তন মন্ত্রীর আত্মীয়, ১টি ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং ১টি প্রকল্প পেতে জনৈক সচিবের প্রভাব মূল ভূমিকা পালন করেছে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যারা ঘুষ লেনদেন করে তারা কী আপনাকে বলবে যে আমরা ঘুষ লেনদেন করেছি। সেটা তো হয় না, সম্ভব না। এখানে প্রভাবটা বেশি প্রাধান্য পেয়েছে সেটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভালনারেবিলিটি ম্যাপ যেটি, সেই ম্যাপের সাথে কিন্তু প্রকল্পের লোকেশনগুলো কনসিসটেন্ট না। মিলছে না। এটা হচ্ছে যেইখানে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ আছে সেইখানে প্রকল্পের লোকেশন। এই জিনিসটা কিন্তু খুব পরিষ্কার। এমন প্রেক্ষাপটে পাউবো যে জলবায়ু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তার সুফল আদৌ ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ পাবে কি না এবং এসব দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের কাছ থেকে জলবায়ু তহবিলের অর্থ ঠিকমতো পাবে কি না- এ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে টিআইবি।