হাওরে এখনও অনিরাপদ নৌযানই ভরসা
এনামুল হক- পঞ্চাশোর্ধ আক্কাস আলী সাঁতার জানেন না। তবুও তিনি ট্রলারে চড়ে বসেছেন। এ ট্রলার পথিমধ্যে কোনো কারণে ডুবে গেলে কী করবেন তাও জানা নেই তাঁর। তবে সম্প্রতি গুমাই নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনার কথা মনে গেঁথে আছে তাঁর। তাই কিছুটা ভয়েও আছেন তিনি। তবুও বাড়ি ফেরার তাড়নায় উঠতে হয়েছে ট্রলারে। আক্কাস আলীর বাড়ি নেত্রকোনার কলামাকান্দা উপজেলার কালাইকান্দি গ্রামে। কিছুদিন আগে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে আত্মীয়র বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন তিনি। গত রোববার দুপুর সাড়ে বারোটায় বাড়ি ফেরার জন্য মধ্যনগর ট্রলারঘাটে আবির হাসান-২ নামের ট্রলারে বসে এ প্রতিনিধির সাথে আলাপচারিতায় আতঙ্কগ্রস্থ এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বলেন, ‘বাঁচি আর মরি, বাড়িতে যাওনতো লাগবো। ট্রলার ছাড়া বাড়িতে যাওয়ার বিকল্প কিছু নাই।’আবির হাসান-২ ট্রলারটি দুপুর ১টায় মধ্যনগর থেকে কমলাকান্দার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। এ ট্রলারে আক্কাস আলীর মতো আরো অনেক যাত্রী রয়েছেন। শিশু ও নারী যাত্রীরা ট্রলারের ছৈয়ের নিচে বসেছেন। পুরুষেরা বসেছেন ছৈয়ের উপর। চলতি পথে এ ট্রলার দুর্ঘটনায় কবলিত হলে জীবন সুরক্ষার জন্য লাইফ জ্যাকেট বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। ট্রলারটি নৌপথে চলার উপযোগী কী না, চালক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কী না তাও জানা নেই যাত্রীদের। গত ৯ সেপ্টেম্বর মধ্যনগর থেকে নেত্রকোনার ঠাকুরাকোনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া একটি যাত্রীবাহী
ট্রলার বাল্কহেড নৌকার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে গুমাই নদীর কলমাকান্দা অংশে ডুবে গিয়ে ১২ জনের মৃত্যু হলে নৌপথে চলাচলকারী নৌযানের দুর্ঘটনা এড়াতে অভ্যন্তরীণ নৌযানসমূহকে ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং নিবন্ধন করে তা নৌযানে প্রকাশ্য স্থানে ঝুলিয়ে রাখা, প্রতিটি নৌযানে আসন সংখ্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সংখ্যক লাইফ জ্যাকেট যাত্রী সাধারণের হাতের নাগালের মধ্যে রাখাসহ প্রচলিত আইন ও বিধি-বিধানের নিয়ম মেনে চলার জন্য সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেন। কিন্তু সেই গণবিজ্ঞপ্তির কথা জানেন না আবির হাসান-২ এর চালক সানুক মিয়া। ট্রলারে লাইফ জ্যাকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট রাখার বিষয়টিও তাঁর অজানা। তিনি জানান, তাঁর ট্রলারে ১২০ জন যাত্রী অনায়াসে চলাচল করতে পারে। যাত্রী বেশি হলে অতিরিক্ত যাত্রীও পরিবহন করেন। কেন অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সানুক মিয়া বলেন, ‘যাত্রী বেশি আইলে থইয়া যাওন যায় না। যাত্রীরও লাভ, আমরাও লাভ।’ট্রলারের চালক হিসেবে সানুক মিয়ার কোনো প্রশিক্ষণ নেই। তবে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি ট্রলারের চালক হিসেবে কাজ করছেন বলে দাবি করছেন। এ সময় সানুক মিয়ার সহযোগী স্বপন মিয়া বলেন, ‘আমিও দেইখ্যা দেইখ্যা ট্রলার চালানো শিখতাছি। প্রশিক্ষণ কই লইয়াম?
মধ্যনগর-তাহিরপুর নৌ রুটে চলাচলকারী সজিব-সাকিব নামের ট্রলারেও কোনো জীবন সুরক্ষা সামগ্রী দেখতে পাওয়া যায়নি। তবে এ ট্রলারের চালক তাহিরপুর উপজেলার রতনশ্রী গ্রামের বাসিন্দা সাইকুল মিয়া জানান, সাধারণ যাত্রী পরিবহনের সময় লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করেন না। তবে পর্যটক নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে গেলে পর্যটকদের লাইফ জ্যাকেট সরবরাহ করেন। কিন্তু এর জন্য পর্যটকদের কাছ থেকে প্রতি লাইফ জ্যাকেটের ভাড়া বাবদ ৫০/১০০ টাকা করে আদায় করা হয়। মধ্যনগর ঘাটে থাকা আকাশ পরিবহন নামক ট্রলারে দেখা যায়, ট্রলারের পেছনের অংশে সংস্কার কাজ চলছে। সেখানে উপস্থিত থাকা ওই ট্রলারের মালিক রেজাউল পারভেজ বলেন, ‘আমার ট্রলারটি বেশির ভাগ সময় পর্যটকদের নিয়ে ভাড়ায় যায়। পর্যটকেরা কখনও কখনও ট্রলারের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে সেখান থেকে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সহজেই যেন পেছনের অংশে দাঁড়াতে পারে এবং কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সেজন্য লোহার গ্রীলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’ কলামাকান্দার যাত্রী সিধলী গ্রামের বাসিন্দা সাগর বলেন, ‘দুর্ঘটনা কখন ঘটে তা বলা যায় না। কিন্তু ট্রলারে লাইফ জ্যাকেট থাকলে অনেকের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব। ট্রলারে লাইফ জ্যাকেটের ব্যবস্থা না থাকলেও আমাদেরকে বাধ্য হয়ে যেতে হয়।’ মধ্যনগর থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আলাউদ্দিন বলেন, হাওরাঞ্চল পর্যটনের জন্য এক সম্ভাবনার ধার খুলে দিয়েছে। যদি নৌ দুর্ঘটনা প্রতিরোধ না করা যায় কিংবা তা বাড়তে থাকে তাহলে হাওর পর্যটন শিল্প বাধাগ্রস্থ হবে।’
রোববার দুপুরে মধ্যনগর নৌঘাটে ছোট বড় অন্তত অর্ধশতাধিক ট্রলার দেখতে পাওয়া যায়। সেসব নৌকার কোনোটিতেই দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বা জীবন সুরক্ষা সামগ্রী দেখতে পাওয়া যায়নি। দুয়েকটি ট্রলারের গোটা কয়েক লাইফ জ্যাকেট শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য রাখা হয়েছে। মধ্যনগর থেকে তাহিরপুর, সুনামগঞ্জ, জামালগঞ্জ, ঠাকুরাকোনা, কলমাকান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় যাত্রীবাহী ও মালবাহী নৌ চলাচল করে। মধ্যনগর ফেরিঘাট থেকে শুধুমাত্র তাহিরপুর পর্যন্ত স্পিডবোট চলাচল করে। এ রুটে তাহিরপুর পৌঁছাতে হলে কয়েকটি বড় হাওর পাড়ি দিতে হয়। কিন্তু স্পিডবোটে চড়ার সময় চালকসহ কেউই লাইফ জ্যাকেট ব্যবহার করেন না। স্থানীয় হাওর বিলাস স্পিডবোট সমিতির সভাপতি দুলাল মিয়া বলেন, যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট দিলেও তারা তা পড়তে চান না। আমাদের সংরক্ষণে লাইফ জ্যাকেট রয়েছে। গরম লাগে কিংবা করোনার জীবাণু থাকতে পারে এমন ভয়ে লাইফ জ্যাকেট এড়িয়ে চলেন যাত্রীরা।’ এদিকে মধ্যনগরসহ আশপাশের নৌ দুর্ঘটনার জন্য পাথর কিংবা বালুবাহী বাল্কহেড নৌকাকে দায়ী করেছেন এলাকাবাসী। স্থানীয় নদীগুলো সরু থাকায় এবং অবাধে বাল্কহেড নৌকা চলায় দুর্ঘটনা ঘটছে। গুমাই নদীতে যে স্থানে ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটেছিল সেই স্থানটিও ছিল সরু এমনটি জানিয়ে মধ্যনগর থানা যুবলীগের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘গুমাই নদীতে ট্রলারডুবির সময় জেলা প্রশাসক এসেছিলেন। আমরা সে সময় বাল্কহেড নৌকা চলাচল বন্ধের জন্য আবেদন জানিয়েছিলাম উনার কাছে। কিন্তু এখনও অবাধে বাল্কহেড নৌকা চলছে। কিছুদিন আগেও দুটি বাল্কহেড নৌকার সংঘর্ষে একজন নৌ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।’ মধ্যনগর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি অমরেশ রায় চৌধুরী, ‘ট্রলারে অতিরিক্ত যাত্রী থাকা সত্ব্যেও অনেকই ট্রলারে উঠেন পরবর্তী ট্রলারের অপেক্ষা না করেই। যাত্রীদের এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সবার আগে যাত্রীদের সচেতন হতে হবে।’ মধ্যনগর উপজেলা বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি অ্যাড. আব্দুল মজিদ বলেন, ‘অতিরিক্ত লাভের জন্য অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন বন্ধ করার পাশাপাশি চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। অদক্ষ চালকের জন্য দুর্ঘটনা ঘটে।’
মধ্যনগর নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি এরশাদ তালুকদার বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মোতাবেক সকল নৌযানে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা সামগ্রী রাখার জন্য বলা হয়েছে। যদি নৌযান চলাচলের নিয়ম বিধি কেউ না মানে তাকে এই নৌরুটে নৌযান চালাতে দেওয়া হবেনা।’ মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদার বলেন, ‘প্রতিটি ট্রলারের ফিটনেস ও দক্ষ চালক আছে কী না, অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহণ করছে কী না তা নিশ্চিত করতে হবে প্রশাসনকে। মূলত নৌ চলাচলের নির্ধারিত নিয়ম মেনে চললে নৌদুর্ঘটনা প্রতিরোধ সম্ভব।’ নৌ দুর্ঘটনা এড়াতে জেলা প্রশাসকের নির্দেশিত গণবিজ্ঞপ্তিটি ওয়েবপোর্টাল, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারসহ মাইকিং করা হয়েছে জানিয়ে ধর্মপাশা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মুনতাসির হাসান বলেন, ‘নৌযানের ফিটনেস ও দক্ষ চালক নিশ্চিত করতে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নৌপথে আর যেন দুর্ঘটনা না ঘটে সে জন্য শুন্য সহনশীল নীতি গ্রহণ করার পাশাপাশি লাইফ জ্যাকেট সরবরাহের জন্য এডিপি থেকে বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে।’