হায়রে লন্ডন শান্তি নাই!
অনেক স্বপ্ন নিয়ে জব্বার মিয়া এসেছিলেন বিলেতে। দীর্ঘ জীবনের কষ্টে রুজি-রোজগারের পর ছেলে হয়ে যায় সন্ত্রাসী, ড্রাগ ডিলার, ছিনতাইকারী। এমন গল্প নিয়ে আজ থেকে ১৫ বছর আগে ব্রিটেনের বাংলা কমিউনিটিতে নির্মিত হয় নাটক ‘হায়রে লন্ডন শান্তি নাই!’ আলোড়ন তোলা ওই নাটকটিই আসলে ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের একটা অংশের বাস্তব চিত্র। এ কমিউনিটিতে যেমন রয়েছে বিস্তর সাফল্যগাথা, তেমনি রয়েছে বোবা কান্না আর অশান্তির দীর্ঘশ্বাস। বাংলাদেশ থেকে যেভাবে ব্রিটেনের চাকচিক্যময় সুখের এক ছবি আমরা দেখে থাকি তার বাইরেও এক চিত্র রয়েছে, যা রয়ে যায় অজানা। ইস্ট লন্ডনের রফিক আলী, বয়স ৭০। ৫০ বছরের বিলেতে যা উপার্জন করেছেন সবই দেশে সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুরে ভাইয়ের কাছে বিনিয়োগ করেছেন। ফ্যাক্টরিতে দিনে-রাতে পরিশ্রম করে, নিজের বিলেতে থাকা পরিবার, সন্তানদের ঠিকমতো লালন-পালন না করে শুধু বাংলাদেশে শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। নিজের সন্তান বড় হয়েছে অবহেলায়, অনাদরে কিন্তু দেশ থেকে ভাইয়ের চিঠি আসামাত্রই পাগলের মতো টাকা পাঠিয়েছেন। আজ জীবন সায়াহ্নে এসে দেখেন সবই গেছে। ভাই মারা যাওয়ার পরই ভাতিজা-ভাতিজিরা ওসব স্থাবর সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে। রফিক আলী স্বপ্ন দেখতেন মৃত্যুর পর তার কবর হবে বাবা-মা-ভাইয়ের পাশে, দেশের মাটিতে। তার সেই স্বপ্নও চুরমার। ভাতিজারা হুমকি দিয়েছে রফিক মিয়া দেশে গেলে তাকে জানে মেরে ফেলবে। এদিকে রফিক আলী যেহেতু সারা জীবন সন্তান-পরিবারকে কষ্ট দিয়েছেন এখন সেই পরিবারে তিনি লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকার! দুই ছেলের একটি হয়েছে সন্ত্রাসী আর একটি মাদকাসক্ত। পালা করে জেল খাটে দুই ভাই! সিলেট জেলার বালাগঞ্জের আরেক প্রবাসী সোনা মিয়া কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি বানিয়েছিলেন। জীবনের বড় অংশের রোজগারের টাকা চলে গেছে বাড়ি নির্মাণে। বিলাসবহুল বাড়িতে থাকার সুযোগ হয়েছে সাত দিন মাত্র। আর নিজের যে পরিবারকে কষ্ট দিয়ে তিনি এ অট্টালিকা করেছেন সেই পরিবার তো সেই বাড়ির শুধু ছবি দেখেছে! থাকারই সুযোগ হয়নি। সোনা মিয়ার বাড়ি দখল করেছেন আপন মায়ের পেটের ভাই। ইতালি থেকে ইউরোপীয় নাগরিক হিসেবে ব্রিটেনে এসে বছর দুয়েক হয় স্থায়ী হয়েছেন সুফিয়ান মালিক। চাঁদপুরে নিজের আপন ছোট বোন জামাইয়ের মাধ্যমে সাড়ে তিন কোটি টাকা খরচ করে মার্কেট করেছেন। সেই মার্কেট দখল করেছে ছোট বোন জামাই। সুফিয়ান বলেন, ২৭ বছর ধরে ইতালিতে যা আয় করলাম সবই চলে গেল এই মার্কেট করার পেছনে। আজ আমি নিঃস্ব হয়ে লন্ডনে ট্যাক্সি চালাই আর সরকারের সামাজিক ভাতা নিয়ে চলি। মূলত ব্রিটেনে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের অনেকেই দেশের মায়ায়, আত্মীয়স্বজনের টানে, নিজ এলাকায় প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানোর নেশায় এভাবে নিজেদের কষ্টার্জিত টাকার বৃহদাংশ বিনিয়োগ করেছেন দেশে।
এরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন নিজের ভাই-ভাতিজা-আত্মীয়স্বজনের হাতে। এদের ব্রিটেনের পরিবারে রয়েছে অশান্তি! তরুণ ক্যাবচালক রফি হক বলেন, আমার বাবা সারা জীবন দেশের আত্মীয়স্বজনকে দেখভাল করতে গিয়ে আমাদের ঠিকমতো লেখাপড়াই করাননি। তাই জিসিইসির পরই লেগে যাই রেস্টুরেন্টে কাজে। এখন ক্যাব চালাই। বাবা দেশে যে সম্পদ করেছেন তা আমরা ভোগ করা তো দূরের কথা, ওই সম্পদই আমাদের জন্য কাঁটা হয়েছে। জানের মায়ায় এখন দেশেই যাই না। সোনা মিয়া আক্ষেপ করে বলেন, ‘দেশে তো আসলে জমির দলিল কিনি নাই, মনে হয় আমার পরিবারের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা কিনেছি। দেশে আইনের আশ্রয় নিলেও হয়রানির শেষ নাই। মেম্বার, চেয়ারম্যান, থানা, পুলিশ সবাই ওদের পক্ষে কথা বলে। ’ রফিক আলী, সোনা মিয়া বা সুফিয়ান মালিকের মতো ঘটনা ব্রিটেনে হাজার হাজার পরিবারে রয়েছে। শত শত পরিবারের দীর্ঘশ্বাসে ‘হায়রে লন্ডন শান্তি নাই!’ মাতম লুটোপুটি খায় চাকচিক্যময় ব্রিটেনের নিয়ন আলোয়!